বিজ্ঞাপন

ট্রাম্পকে হত্যা চেষ্টা: মার্কিন রাজনীতিতে বিপদজনক টার্নিং

July 15, 2024 | 1:44 pm

মাহমুদুল হাসান শামীম

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং যুক্তরাস্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ার বাটলারে এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। একটি বুলেট তার কান ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। এতে রক্তাক্ত হয়েছেন তিনি। তবে কয়েক মিলিমিটার এদিক সেদিক হলেই ট্রাম্প জীবন শংকায় পড়তেন। সৌভাগ্যবশত আহত হলেও প্রাণে বেঁচে গেছেন। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি নিউ জার্সির বাড়ীতে ফিরে যান কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। এ ঘটনায় সমাবেশে আসা এক রিপাবলিকান সমর্থক মারা গেছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও দুই জন। ট্রাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক স্নাইপারের গুলিতে ঘটনাস্থলেই তাৎক্ষণিক নিহত হয়েছেন হামলাকারী।

বিজ্ঞাপন

প্রত্যাক্ষদর্শীর বরাতে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, অনেকটা সিনেম্যাটিক স্টাইলে তার ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। ট্রাম্পকে হত্যা করতে আগ থেকেই পাশের একটি বাড়ির ছাদে অবস্থান নেয় হামলাকারী। ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশস্থল থেকে ভবনের দূরত্ব মাত্র ১২০ মিটার। বলা হচ্ছে, ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহার করা হয়েছে, এআর স্টাইলের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রাইফেল, যা দিয়ে কয়েক সেকেন্ডে ডজন ডজন গুলি ছোড়া সম্ভব। ট্রাম্পের ওপর এ ঘটনাকে হত্যাচেষ্টা বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। এফবিআই জানিয়েছে বন্দুকধারী যুবকের নাম থমাস ম্যাথিউ ক্রুকস। তার বয়স ২০ বছর। তিনি সামাবেশ স্থল থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরের বেথেল পার্ক এলাকার বাসিন্দা।

নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

ট্রাম্পকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। কড়া নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে কীভাবে গুলি করা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন সামনে আসতে শুরু করেছে। বিবিসির এক বিশ্লেষক বলেছেন ‘নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠতে যাচ্ছে। এটা ছিল একটা আউটডোর ভেন্যু ও সে কারণে এর কিছু প্যারামিটার আছে— কেন নিচু ছাদ গুলোতে তাদের কেউ ছিল না? কেন তারা সব ছাদ দেখেনি? কিভাবে একজন মানুষ একটি সেমি-অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে ছাদে গেল এবং সাবেক প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে পারল?’

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাস্ট্রের নেতাদের প্রতিক্রিয়া

ঘটনার পরপরই একটি টেলিভিশনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এ ধরনের সহিংসতার জায়গা যুক্তরাষ্ট্রে নেই। তিনি তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সব মতের রাজনীতিকরাই এক হয়ে বলছেন, গণতন্ত্রে সহিংসতার জায়গা নেই।

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা,জর্জ ডাব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন ও জিমি কার্টার দ্রুতই এ সহিংসতার তীব্র নিন্দা করেছেন। এ ঘটনার পর বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারদল সব ধরনের রাজনৈতিক বিবৃতি বন্ধ রেখেছে এবং টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলো না দেওয়ার জন্য কাজ করছে। কারণ তাদের বিশ্বাস ট্রাম্পের ওপর হামলার এই সময়ে এগুলো মানানসই হবে না। বরং যা ঘটেছে তার নিন্দা জানানোর দিকে মনোযোগ দেওয়াই ঠিক হবে। কিন্তু ট্রাম্পের কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সমর্থক সহিংসতার জন্য ইতিমধ্যে বাইডেনকে দোষারোপ করা শুরু করেছেন। একজন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান এক্সে প্রেসিডেন্টকে অভিযুক্ত করেছেন ‘হত্যাকাণ্ডের উসকানি দেওয়ার জন্য’। ট্রাম্পের সম্ভাব্য ভাইস প্রেসিডেন্টদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা সিনেটর জেডি ভান্স বলেছেন, বাইডেনের প্রচারণাই সরাসরি এ ঘটনার দিকে নিয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা ট্রাম্পকে হত্যা চেষ্টার নিন্দা করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের সবার বক্তব্যের মুল কথা – ‘গণতন্ত্রে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়’।‘গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, এমন যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সবাইকে অবশ্যই কঠোরভাবে দাঁড়াতে হবে’।

তবে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে অনেকটা যুক্তরাস্ট্রের রিপাবলিকান নেতারদের মতোই ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন রয়েছে, সেটা রাশিয়া বিশ্বাস করে না। তবে এই প্রশাসনই এমন পরিবেশ তৈরি করেছে যেটা এই ঘটনা উসকে দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরিয়ে দিতে সব আইনি কলাকৌশল ব্যবহার করা হয়েছে– আদালত, প্রসিকিউটর, রাজনৈতিকভাবে মর্যাদাহানি এত কিছুর পর বাইরের সবার কাছে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তার জীবন সংকটে রয়েছে।’

মার্কিন প্রেসিডেন্টদের উপর হামলা

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের নিরাপত্তায় রয়েছে আলাদা বিশেষ বাহিনী। সিক্রেট সার্ভিস নামে গঠিত বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে অবসরে গেলেও আজীবন তাদের এই বাহিনী নিরাপত্তা দেয়। বিশেষায়িত এই বাহিনীর নিরাপত্তা সত্ত্বেও হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। সবশেষ ঘটনা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী সভায় হামলা।

মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ তাদের উপস্থিতিতেই এর আগে চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন। আর ৭ জন প্রেসিডেন্ট, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হত্যা চেষ্টার শিকার হয়েছেন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশের ইতিহাসে এত সংখ্যক প্রেসিডেন্টের হত্যা চেষ্টার শিকার হওয়ার ইতিহাস নেই।

হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন

** আব্রাহাম লিংকন, ১৬তম প্রেসিডেন্ট — আব্রাহাম লিংকন ছিলেন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যাকে হত্যা করা হয়েছিল। একটি থিয়েটারে তার মাথার পিছনে গুলি করা হয়। পরদিন তিনি হাসপাতালে মারা যান।

** জেমস গারফিল্ড, ২০তম প্রেসিডেন্ট– গারফিল্ড হলেন হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া দ্বিতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কার্যভার নেওয়ার ছয় মাসের মাথায় তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইংল্যান্ডে যাওয়া জন্য ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এস সময় এক আততায়ী তাকে গুলি করে। কয়েজক সপ্তাহ চিকিৎসা নেয়ার পর তিনি মারা যান।

** উইলিয়াম ম্যাককিনলে, ২৫তম প্রেসিডেন্ট — ম্যাককিনলি ১৯০১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বাফেলোতে বক্তব্য দেওয়ার পরে স্থানীয়দের সঙ্গে করমর্দন করার সময় আততায়ী তার বুকে গুলি চালান। ম্যাককিনলি তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করার ছয় মাস পর ১৯০১ সালে।

** জন এফ. কেনেডি, ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট– ডালাস শহরে মোটর শোভাযাত্রা করে দশর্কদের ভিড়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেনেডিকে ঘাড় ও মাথার পেছনে গুলি করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পরেই চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন ৭ জন

থিওডোর রুজভেল্ট (২৬তম প্রেসিডেন্ট), ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট (৩২তম প্রেসিডেন্ট),হ্যারি ট্রুম্যান (৩৩তম প্রেসিডেন্ট), জেরাল্ড ফোর্ড (৩৮তম প্রেসিডেন্ট), রোনাল্ড রিগান (৪০তম প্রেসিডেন্ট), জর্জ ডব্লিউ বুশ (৪৩তম প্রেসিডেন্ট), বারাক ওবামা (৪৪তম প্রসিডেন্ট)।

হত্যাচেষ্টা থেকে সবশেষ বেঁচে গেলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং আসন্ন নির্বাচনের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নির্বাচনে প্রভাব

অতীতে যেসব প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন তারাই নির্বাচনে জিতেছেন। এবারও ধারণা করা হচ্ছে এই ঘটনার পর যুক্তরাস্ট্রের নির্বাচনী আবহাওয়ায় বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটবে। বিবিসি বলছে, মুখে রক্ত নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন ও সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা তাকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন—এ ছবি শুধু ইতিহাস বানায়নি, বরং এগুলোই নভেম্বরের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। জঘন্য এই রাজনৈতিক সহিংসতার প্রভাব নিঃসন্দেহে পড়বে নির্বাচনি প্রচারণায়।
গুলি লাগার পর ট্রাম্প ডান হাত দিয়ে তার ডান কান চেপে ধরেন। এরপর মঞ্চে বসে পড়েন। দ্রুত সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা ছুটে এসে ঘিরে ফেলেন ট্রাম্পকে। পরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন ট্রাম্প। দেখা যায়, ডান কান থেকে রক্ত ঝরছে তার। মুখমণ্ডলেও রক্ত। তখন ট্রাম্প মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে বলেন, ‘ফাইট, ফাইট, ফাইট!’

এই ফাইটটি কেমন হবে?

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, কেবল ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছি। আমরা আর ভয় পাব না। বিশ্বাসে দৃঢ় থাকব এবং দুষ্টতার মুখে প্রতিবাদী থাকব।

ট্রাম্প আরও বলেন, আমি সত্যিই আমাদের দেশকে ভালোবাসি, আপনাদের সবাইকে ভালোবাসি এবং এ সপ্তাহে উইসকনসিন থেকে আমাদের মহান জাতির উদ্দেশে কথা বলার অপেক্ষায় রয়েছি। তার ছেলে ট্রাম্প জুনিয়র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য লড়াই করা ট্রাম্প বন্ধ করবেন না।

কয়েকজন রিপাবলিকান রাজনীতিক বলেছেন- যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির বিপজ্জনক এই সময়ে এই ঘটনা ঘৃতাহুতি হবে। আমরা এখনি লড়াইটা দেখতে পাচ্ছি যা সামনে আরো কুৎসিত হয়ে উঠতে পারে, যা আসলে নির্বাচনি প্রচারণার ধরনটাকেই বদলে দেবে।’

১৯৮১ সালে গুলিতে রোনাল্ড রিগ্যান গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কোনো প্রেসিডেন্ট বা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ওপর এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন-ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলা দেশটির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। মার্কিন রাজনীতিতে সিকিউরিটি ও সেফটির যে ধারণা গত কয়েক দশক ধরে তৈরি হয়েছে সেটি নাটকীয়ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে।

অতীতে দেখা গেছে যুক্তরাস্ট্রে যখন কোন রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে তখন রাজনৈতিক মেরুকরণ ও অনাকাংখিত ঘটনা ঘটে। ব্যক্তির ইচ্ছায় যখন অস্ত্র ব্যবহ্রত হয় তখন এটি ইতিহাসের গতি প্রকৃতি পাল্টে দিতে পারে। এই হত্যাচেষ্টা নির্বাচনের বছরে মার্কিন রাজনীতিতে বিপদজনক মোড় নিতে পারে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন