বিজ্ঞাপন

বিশ্ব অর্থনীতির সামনে নতুন বিপত্তি

July 24, 2024 | 4:26 pm

রজত রায়

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার পরে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যা সাহায্য করেছে বিশ্ব অর্থনীতির গতি বৃদ্ধিতেও। কিন্তু এখন নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিম এশিয়ার অশান্তি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জোগান শৃঙ্খলের সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, বেসরকারি লগ্নি হ্রাস পাওয়া ও ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য।

বিজ্ঞাপন

আমেরিকার অর্থসচিব জ্যানেট ইয়ালেনের সতর্কবার্তা, ইসরায়েলের উপরে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলার প্রেক্ষিতে তেহরানের উপরে নতুন আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কথা চিন্তাভাবনা করছে তার দেশ। আর তার বাস্তব রূপায়ন হলে পশ্চিম এশিয়ার জটিলতা বিশ্ব অর্থনীতির সামনে নতুন বিপত্তি তৈরি করতে পারে। এই অবস্থায় ইরানের উপরে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা চাপলে তার প্রতিক্রিয়া বিশ্বের বিভিন্ন অংশে পড়তে বাধ্য। মূল্যবৃদ্ধির হার এখনও প্রত্যাশিত জায়গায় না নামায় অদূর ভবিষ্যতেও রিজার্ভ সম্ভবত ব্যাংক সুদের হার কমাবে না। সাধারণ মানুষ ও হাত খুলে খরচের ব্যাপারে সতর্ক। তবে ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতি বাড়তে পারে ২.৫%। গত বছরের (২.৭%) চেয়ে যা সামান্য কম।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য মোতাবেক, দ্রুতগতির বিচ্যুতির মধ্যে, বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা সামনের বছরে পরীক্ষা করা অব্যাহত থাকবে। যদিও বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি কমেছে, প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ছে, আর্থিক অবস্থা আটসাট রয়েছে, বৈশ্বিক উত্তেজনা গভীর হচ্ছে এবং বৈষম্য বাড়ছে-টেকসই অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিবেগ গড়ে তোলার জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতার জরুরি প্রয়োজনকে তুলে ধরছে। বেশিরভাগেরই মতে, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পূর্ববর্তী বছরগুলির মতোই ২০২৪ সালেও মাঝারি প্রবৃদ্ধি (যথাক্রমে ৯৩ এবং ৮৬ শতাংশ) লক্ষ করা যাবে বলা হয়েছে। যদিও এই বিষয়ে চীন দুর্বল ব্যয়, শিল্প উৎপাদন হ্রাস এবং সম্পত্তির বাজারে উদ্বেগের কারণে মাঝারি (৬৯ শতাংশ) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।

চীনের অর্থনীতির গতি সামগ্রিকভাবে বাড়ছে না। দেশটির জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ আসে আবাসন খাত থেকে। সেই আবাসন খাত এখন নানামূখী সংকটে জর্জরিত। এমনকি গত মে মাসে দেশটির সরকার আবাসন খাত চাঙা করতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও কাজ হয়নি। এতে চীনের অর্থনীতি নিম্নমূখী হচ্ছে। বেসরকারি জরিপে আরও দেখা গেছে ইস্পাত, কপার ও অ্যালুমিনিয়ামের মতো কাঁচামালের দাম ও জাহাজ পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা চাপের মুখে আছেন। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির হার দুই বছরেরর মধ্যে সর্বোচ্চ। কাইজিন ইনসাইট গ্রুপের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজারে আত্মবিশ্বাসের অভাবও অপর্যাপ্ত চাহিদা এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

বিজ্ঞাপন

বড় ধরনের ঋণ সংকটে রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্বের সব দেশের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১ লাখ কোটি ডলার। এই অংক বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় সমান। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়- এই বিপুল পরিমাণ ঋণ মানুষের জীবনে বড় চাপ তৈরি করছে। ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে করোনাকালীন জরুরি পরিস্থিতির মোকাবিলা। জনগণও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা দিতে বিশ্বের সব দেশই ঋণ করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, ক্রমবর্ধমান এই ঋণের বোঝার কারণে মানুষের জীবনযাত্রার প্রভাব পড়ছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশেও।

উদীয়মান সূর্যের দেশ এর অর্থনীতি মন্দার মুখোমুখি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির তালিকায় ক্রমশ নীচের দিকে নেমে চলেছে দেশটি। কোভিডের পর থেকে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির হাল আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। তবে জাপানের অর্থনীতির ক্রম অবক্ষয় বিশেষজ্ঞদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও দেশের অর্থনীতির মান যখন পড়ে যেতে শুরু করে, সেই অবস্থাকে বলা হয় অর্থনৈতিক মন্দা। যখন কোনও দেশ আগের চেয়ে কম অর্থ উপার্জন করে আগের চেয়ে উৎপাদন যখন কমে যায়, তখন মন্দা আসে। দেশে উৎপন্ন পণ্য এবং উৎপাদনের মোট মূল্য নিয়ে জিডিপি তৈরি হয়। কোনও দেশের জিডিপি পর পর দুটি ত্রৈমাসিকে আগের চেয়ে কমলে দেশটি মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হয়। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী জাপানের ক্ষেত্রে গত ত্রৈমাসিকে তাদের অর্থনীতি ০.৪ শতাংশ কমেছিল। তার আগের ত্রৈমাসিকে জাপানের অর্থনৈতিক হ্রাসের হার ছিল ৩.৩ শতাংশ।

কোনও দেশের জিডিপি কেন হঠাৎ পড়তে শুরু করে? কেন মন্দা হয়? বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মানুষ যখন কম টাকা খরচ করতে শুরু করেন, তখনই দেশটির অর্থনীতি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। গ্রাহকদের খরচ কমিয়ে ফেলা মানেই বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া। আর চাহিদা কমলে উৎপাদনও কমে যেতে বাধ্য। যার উপর দেশের জিডিপি নির্ভর করে। চাহিদা কমলে দেশের বিভিন্ন সংস্থার উৎপাদনের পরিমাণ কমে। কর্মী ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। যার ফলে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। সার্বিকভাবে দেশটি মন্দার দিকে এগিয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

তাহলে জাপানের ক্ষেত্রে কী হয়েছে? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন জাপানের অর্থনীতি গত কয়েক দশকে তার প্রতিযোগী মনোভাব হারিয়ে ফেলেছে। সেখানে কমে গিয়েছে পণ্য উৎপাদন ক্ষমতাও। ডলারের সাপেক্ষে জাপানি মুদ্রা ইয়েনের মূল্য কমে যাওয়াও সেখানে অর্থনৈতিক মন্দার অন্যতম কারণ। বিশ্ব অর্থনীতিতে জিডিপি ডলারেই গোনা হয়ে থাকে।

চলতি বছর বিশ্বের অনেক দেশেই সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এসব দেশের রাজনীতিকরা ঋণসমস্যা একরকম উপেক্ষা করে যাচ্ছেন, অর্থাৎ ঋণের রাশ টানতে যে কর বাড়াতে হবে বা ব্যয় হ্রাস করতে হবে। সে বিষয়ে তারা ভোটারদের সঙ্গে সততার পরিচয় দিচ্ছেন না। ক্ষেত্রবিশেষে এই রাজনীতিকরা এমন এমন অঙ্গীকার করছেন যে, তার প্রভাবে মূল্যস্ফীতির সূচক আবারও উর্ধ্বমূখী হতে পারে বা নতুন কোনো আর্থিক সংকট তৈরি হতে পারে। দেশে দেশে ঋণ বাড়ছে। এর অর্থ হলো ঋণের সুদও আসল বাবদ সরকারের ব্যয়ও বাড়ছে। সরকারের আয়ের বড় অংশ সুদ ও আসল বাবদ ব্যয় হয়ে গেলে জরুরি সেবা যেমন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমে যাবে। সেই সঙ্গে মহামারি ও যুদ্ধের মতো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের হাতে যথেষ্ট অর্থ থাকে না।

সরকারি বন্ডের সুদ বাড়লে বাজারেও তার প্রভাব পড়ে। বন্ডের সুদ বাড়লে বন্ধকী ঋণের সুদহারও বাড়ে, তখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে ঋণ করতে হয়। এতে যেমন ব্যবসায়ীদের ব্যবসার খরচ বেড়ে যায়, তেমনি ব্যক্তি মানুষের ও ব্যয় বেড়ে যায়। ঋণের সুদহার বাড়লে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকারের পক্ষে ঋণ করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করাও কঠিন হয়। আর এসবের ফল হলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া।

ইউরোপে অর্থনৈতিক পুর্বাভাসে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই উল্লেখযোগ্য ভাবে অবনতি ঘটেছে, ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতাই দুর্বল বা খুব দুর্বল বৃদ্ধির আশা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ক্ষেত্রেও এই বছর মাঝারি বা শক্তিশালী বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ, যা আগের থেকে যথাক্রমে ৭৮ এবং ৭৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়েছে। যদিও এরই মধ্যে লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, সাব-সাহরান আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ায় প্রবৃদ্ধির উন্নতির প্রত্যাশা রয়েছে এবং মাঝারি প্রবৃদ্ধির আশা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ইনস্টিটিউট ফর ফিসক্যাল স্টাডিজের (আইএফএস) হিসেবে , গত দেড় দশকে যুক্তরাজ্যে আয় বেড়েছে সবচেয়ে ধীরগতিতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি এবং বেতন না বাড়ায় ব্রিটেনের জনগণ তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলানে হিমশিম খাচ্ছে। আলজাজিরা লিখেছে, যুক্তরাজ্যে আবাসন সংকটের পেছনে কারণগুলো হলো সম্পত্তির দাম ও ভাড়া বৃদ্ধি এবং নতুন ভবন নির্মাণের খরচ বৃদ্ধি।

“ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ” মন্দাকে কোন দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উল্লেখযোগ্য পতন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারাল রিজার্ভের নীতিনির্ধারণী সংস্থা “ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি” জুন মাসে অনুমান করেছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হতে পারে মাত্র ১ শতাংশ। ফেড রিজার্ভ ২০২৩ সালে চার বার সুদের হার বাড়িয়েছে যা আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজারকে টেনে নামিয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষার মতে, আমেরিকার কর্মসংস্থানের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। আমেরিকার বেকারত্বের হার ঐতিহাসিকভাবে কম, মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। আমেরিকা বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ায় সেখানে মন্দা দেখা দিলে তার প্রভাব পড়তে পারে ভারত-সহ অন্য দেশের উপরেও। সর্বত্র মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যা প্রকট হবে। সার্বিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশও বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আবার সরকারি সব ধরনের ব্যয়ে কৃচ্ছসাধন ও কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করা হয়েছে। মহামারি করোনার পর থেকে সরকারি সকল ধরনের ব্যয়ে কৃচ্ছসাধনের পথে হাঁটছে সরকার। দেশে ডলার সংকট রয়েছে। রিজার্ভের পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। এ অবস্থায় সরকারি ব্যয়ে আরও সতর্কতা প্রয়োজন।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন