বিজ্ঞাপন

ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক আর নেই

July 25, 2024 | 2:17 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক আর নেই। তাঁর মৃত্যুতে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার দিবাগত রাত পৌনে ২টায় ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শুক্রবার সকাল ১০টায় প্রয়াতের মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রয়াতের ছোট ভাই নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, মাহবুবুল হক দীর্ঘসময় ধরে কিডনি রোগে ‍ভুগছিলেন। গত মাসে (জুন) তিনি স্ট্রোক করেন। এনজিওগ্রামের পর তার হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে চলতি মাসের (জুলাই) তার বাইপাস সার্জারি সম্পন্ন হয়। এর তিনদিন পর তিনি আবার ব্রেইন স্ট্রোক করেন।

‘আগে থেকেই উনার কিডনি ডায়ালাইসিস চলছিল। সাত-আটদিন আগে তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত (বুধবার) রাত ১টা ৪৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন,’ – বলেন আশরাফুল ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. চন্দন দাশ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে শুক্রবার (২৬ জুলাই) সকালে প্রয়াত মাহবুবুল হকের মরদেহ চট্টগ্রামে আনা হবে। এরপর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ সকাল দশটায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে নেওয়া হবে।

আশরাফুল ইসলাম জানান, শিল্পকলা একাডেমি থেকে প্রয়াতের মরদেহ জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নেওয়া হবে। জুমার নামাজের পর জানাজা শেষে সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হবে। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

ড. মাহবুবুল হকের পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। রেলওয়ে কর্মকর্তা বাবার চাকরি সূত্রে তারা সপরিবারে চট্টগ্রাম নগরীতে স্থায়ী বসতি গড়েন। নগরীর লালখান বাজারের বাঘঘোনা এলাকায় তাদের স্থায়ী নিবাস।

বিজ্ঞাপন

১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় তাঁর জন্ম। বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রয়াতের ছেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগী অধ্যাপক। উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। মেয়ে ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

জানা গেছে, মাহবুবুল হক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে পিএইচডি অর্জন করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে প্রথমে তিনি বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে তিনি অবসরে যান।

শিক্ষকতার পাশাপাশি মাহবুবুল হক বাংলা ও নৃতাত্ত্বিক ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মরীতি প্রণয়নে ভূমিকা রেখে তিনি ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি পান। বাংলাদেশ, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তার চল্লিশটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকে শিক্ষানীতি ও পাঠ্যবই প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১৯ সালে তিনি ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক পান। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

মাহবুবুল হকের মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবু তাহের, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) বেণু কুমার দে এবং উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সেকান্দর হোসেন গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

ছাত্রজীবনেই মাহবুবুল হক প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে ভূমিকা রেখেছেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি অশোক সাহা ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া এক বিবৃতিতে অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।

শোকবার্তায় সিপিবি নেতারা বলেন, ‘ষাটের দশকে মাহবুবুল হক চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও তিনি এ পদে ছিলেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা যুব ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। জেলা সিপিবির সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রামে উদীচী এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিরও নেতা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, গুণী সংগঠক ও গবেষককে হারাল, যে শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।’

উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. চন্দন দাশ এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্তা এক শোকবার্তায় বলেন, ‘অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক উদীচী চট্টগ্রাম জেলার সদস্য ছিলেন। তিনি দীর্ঘসময় ধরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশের সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এদেশে শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা এবং সংস্কৃতির সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’

সারাবাংলা/আরডি/ইআ

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন