বিজ্ঞাপন

টানা ২ দিন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ছিল আজিমপুর কলোনি

July 25, 2024 | 7:08 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউনের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল থেকেই আজিমপুর মোড়ে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। তারা নিউমার্কেট থেকে লালবাগ, লালবাগ থেকে নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজিমপুর, আজিমপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলাচলের সড়কগুলো বন্ধ করে দেয় ।

বিজ্ঞাপন

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের তাণ্ডব। সড়ক দ্বীপের নিরাপত্তা প্রাচীরের ভারী রেলিংগুলো বিকট শব্দে ভাঙতে থাকে তারা। এতে আজিমপুর কলোনির জোন-বি-তে থাকা ২৩টি ভবনের ১ হাজার ৭৪৮টি ফ্ল্যাটে বসবাসরত বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

দুপুর ২টার দিকে কলোনির ২ নম্বর গেটের সামনে টায়ারের আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। সামান্য দূরে থাকা বিদ্যুৎ অফিসে আশপাশে অন্তত তিনটি স্পটে আগুন দেয় তারা। আর বিরামহীনভাবে চলতে থাকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ।

বিকেল ৩ টার দিকে কলোনির দুই নম্বর গেটে গিয়ে দেখা যায়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাতে সড়কের নিরাপত্তা প্রাচীর ভাঙা লোহার বড় বড় লাঠি, বাঁশ-কাঠ-রড। কেউ কেউ ক্রিকেট স্ট্যাম্পসহ অবস্থান নিয়েছে সড়কে। এ ছাড়া নির্মাণ কাজের জন্য রাখা ইট ভেঙে পিকেটিং উপযোগী করে স্তূপাকারে রেখে দিয়েছে তারা। এদের প্রত্যেকেই ছিল মারমুখী ভূমিকায়।

বিজ্ঞাপন

ভারী যানবহান তো দূরের কথা রিকশা, মোটরসাইকেল এমনকি বাইসাইকেল আরোহীরাও রাস্তা পার হতে পারছিলেন না। এ সময় সেখানে মিডিয়াকর্মী, মিডিয়ার গাড়ি বা পুলিশের গাড়ি দেখা যায়নি। ‘কোটা না মেধা? মেধা…মেধা’ স্লোগানে প্রকম্পিত ছিল রাজপথ। সেখানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চেয়ে ত্রিশ/চল্লিশোর্ধ্ব পিকেটারের সংখ্যা ছিল বেশি। কিছু সংখ্যক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিকেও দেখা যায়। এরা কৌতূহলী দর্শক, নাকি আন্দোলনকারীদের সমর্থক— তা বোঝা যাচ্ছিল না।

দিনভর সড়ক অবরোধ করে রাখার পর বিকেল ৫টায় শুরু হয় পুলিশি অভিযান। বিচারপতিদের আবাসন, সচিব, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবনগুলোর নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে অনেকটা সহনশীলতার সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করলেও রাবার বুলেট বা কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করেনি তারা। এ সুযোগটিই গ্রহণ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং সুযোগ-সন্ধানী দুষ্কৃতকারীরা।

তারা কলোনির পকেট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং নির্মাণ কাজের জন্য রাখা ইট পুলিশের উদ্দেশে ছুড়ে মারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ কলোনির ভেতরে ঢুকলে ভবনের আড়াল থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে আন্দোলনকারীরা। কয়েকটি ভবনের ছাদ থেকেও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। এতে করে ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

ভবনের ছাদ থেকে ইট-পাটকেল মারা শুরু হলে পিছু হটে পুলিশ। তারা কলোনির বাইরে অবস্থান নেয়। যথারীতি কলোনির ভেতর থেকে শুরু হয় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। পুলিশও পাল্টা জবাব দিলে আন্দোলনকারীদের একজন রাবার বুলেট বিদ্ধ হন। পরে তাকে চার নম্বর গেট দিয়ে বের করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আহত হয় আরও ১০/১২ জন।

টানা পাঁচ ঘণ্টার প্রচেষ্টাতেও আন্দোলনকারী এবং দুষ্কৃতকারীদের কলোনি থেকে সরাতে না পেরে রাত ১০টার দিকে কলোনির ১ নম্বর গেট দিয়ে এপিসি কারসহ পুলিশের কয়েকশ’ সদস্য কলোনিতে ঢোকে। এ সময় অন্য তিনটি গেট খোলা থাকায় সেদিক দিয়ে বেরিয়ে যায় আন্দোলনকারী। এ সময় ২৩ নম্বর ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ৪ নম্বর ভবনের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা দুলাল (৪২) গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরও আহত হয়।

কমপ্লিট শাটডাউনের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) বাদ জুম’আ ফের আজিমপুর মোড়ে জড়ো হয় আন্দোলনকারীরা। এদিনও নিউমার্কেট থেকে লালবাগ, লালবাগ থেকে নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজিমপুর, আজিমপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলাচলের সড়কগুলো বন্ধ করে দেয় তারা। সড়কের পাঁচ/ছয়টি স্পটে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আন্দোলনকারীরা। ফলে কলোনির বাসিন্দারা আবারও আতঙ্কের মধ্যে পড়ে। আগের দিনের হতাহতের ঘটনার রেশ না কাটতে পরের দিন ফের আন্দোলনকারীদের অবস্থান সবার মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করে।

এদিন মাগরিবের পর শুরু হয় সংঘর্ষ। আজিমপুর মোড়ে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত দফায় দফায় চলে সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

বিজ্ঞাপন

টানা দুই দিনের এই তাণ্ডব-সংঘর্ষ শেষ হয় ২০ জুলাই প্রথম প্রহর থেকে কারফিউ ও সেনা মোতায়ের পর। এরপর আর আন্দোলনকারী ও দুষ্কৃতকারীদের আজিমপুর এলাকায় দেখা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যিালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজসহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন আজিমপুর কলোনির বাসিন্দারা ১৮ ও ১৯ জুলাই পড়েছিলেন রীতিমতো বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে। কলোনির ভবনগুলোতে বসবাসরত নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা চরম আতঙ্কের মধ্যে পার করে টানা ৪৮ ঘণ্টা। অদূর ভবিষ্যতে আবাসিক এলাকার মধ্যে এ ধরনের তাণ্ডব যেন আর না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

৩ নং ভবনের বাসিন্দা মাহমুদা জামান বলেন, ‘আন্দোলনে কোনো পক্ষভুক্ত না হয়েও কলোনির একজন নিরীহ বাসিন্দা গুলিবিদ্ধ হয়ে ‍মৃত্যুবরণ করেছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১২ জন। এটি খুবই দুঃখজনক। আমরা যদি আমাদের বাউন্ডারির মধ্যে নিজেদের বাসায় নিরাপদ থাকতে না পারি, তাহলে যাব কোথায়? এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে।’

সারাবাংলা/এজেড/একে

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন