বিজ্ঞাপন

কোটা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দায় এড়াতে পারেন না

July 28, 2024 | 4:54 pm

কাজী মাসুদুর রহমান

সম্প্রতি সরকারী চাকুরীর কোটা ইস্যুর সুযোগ নিয়ে প্রায় সমগ্র দেশ ষড়যন্ত্রকারীদের অগ্নিগর্ভে পতিত হয়েছে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্রজাতি, অঞ্চল, লিঙ্গ ও সাধারণ মানুষের যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য কোটার পদ্ধতি চালু করেছিলেন। এছাড়া নিহত, আহত ও চিরবিকলাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে স্বাবলম্বী রাখার জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অকৃত্রিম বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের মহতী কৃতিত্ব স্বরুপ তাদের সন্তানদের এই সুযোগ দান করেন। সে প্রেক্ষিতে ১৯৭২-১৯৭৬ সাল অবধি ২০% সাধারণ মেধা,বাকি ৮০% কোটাভিত্তিক মেধায় নিয়োগ দেওয়া হতো। পরে ১৯৭৬ সালে সাধারণ মেধার সংখ্যা ৪০% এ উন্নীত করে ৬০% কোটা বরাদ্দ রাখা হয়। ১৯৮৫ সালে ১ম ও ২য় শ্রেণির পদে ৪৫% সাধারণ মেধাভিত্তিক এবং ৫৫% অগ্রাধিকার তথা কোটা ভিত্তিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। ৫৫% এর মধ্যে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা, ১০% নারী, ১০% জেলা বা আঞ্চলিক, ৫% ক্ষুদ্র বা নৃজাতিগোষ্ঠী বিদ্যমান থাকে। পরে ১% প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করায় তা ৫৬% এ দাঁড়ায়। কিন্তু জাতির পিতাকে হত্যার পর দীর্ঘ একুশ বছরে আগত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সরকার গুলো মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট কোটাগুলো যথাযথ অনুসরণ করেনি। এমনকি প্রার্থীর জন্মস্থান গোপালগঞ্জ(বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান) হলে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তা যথাযথ অনুসৃত হয়ে আসছিল। এরই মধ্যে প্রচলিত কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ এর ব্যানারে একশ্রেণির শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। এ প্রেক্ষিতে ঐ বছরের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সকল প্রকার কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি করে। ঐ পরিপত্রের বিরুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট দায়ের করেন। রিটের প্রেক্ষিতে উচ্চআদালত ৫ জুন রুল অ্যাবসলিউট বা যথাযথ ঘোষণা করে সবধরনের কোটা বহালের পক্ষে রায় দেন। উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে ৪ জুলাই রাস্ট্রপক্ষ আপিল করেন। এভাবে কোটা ইস্যুটি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন অবস্থাতেই ছিল।

বিজ্ঞাপন

এমতাবস্থায়, সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে ঢাকায় কোটা সংস্কারের দাবীতে ধীরে ধীরে ফুঁসে উঠতে থাকেন। তারা দাবীর পক্ষে আদালতে দুইজন আইনজীবী নিয়োগের পরেও বিচার বিভাগ এড়িয়ে সরকারের নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের দাবী জানান। এক পর্যায়ে তারা শাহবাগ সহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ও কর্মব্যস্তময় জনপথ গুলো ঘন্টার পর ঘন্টা অবরুদ্ধ করে ফেলে। চরম ভোগান্তিতে পরে সাধারণ মানুষ। পরবর্তীতে এটি ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। বিশেষ করে ব্যস্ততম ঢাকা সহ সমগ্র দেশের যাতায়াতের মূলদ্বার আটকে দেওয়া হয়। অসংখ্য শিশু,আবাল,বৃদ্ধ, বনিতা চরম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পরেন। অসুস্থ রোগীও নিদারুণ অমানবিকতার শিকার হন। মালামাল পরিবহনে চরম ব্যাঘাত ঘটে। এতে ব্যাপক প্রভাব পরে গণঅর্থনীতির ওপর। দিন আনা খেটে খাওয়া বহু মানুষের উননে তখন অন্ন চরেনি। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চীন সফর শেষে বরাবরের মতো উম্মুক্ত মিডিয়া ডায়ালগের আয়োজন করেন। সেখানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে চলমান কোটা আন্দোলনের ব্রিফিং কালে তিনি আন্দোলনকারীদের দাবীর প্রতি সহমত পোষণ করেন। তবে, যেহেতু এটা আদালতে বিচারাধীন, সেহেতু তা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা করার জন্য পরামর্শ দেন এবং তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এরই মধ্যে রাস্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চতর আদালত চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা (status quo) জারি করে তা আগামী ৭ আগষ্ট শুনানির জন্য ধার্য করেন যা তাদেরই পক্ষে ইতিবাচক মর্মে তাদেরই নিয়োজিত আইনজীবি গণমাধ্যমে মতামত ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি মহামান্য আদালত জনদুর্ভোগ এড়াতে তাদেরকে পড়ার টেবিলে ফেরার অনুরোধ জানান। দেশের সুশীল সমাজও তাদেরকে অনুরোধ জানান। আন্দোলনের মধ্যে তাদেরকে ক্ষতি করে তৃতীয়পক্ষ রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করতে পারে মর্মে সরকারের তরফ থেকেও বারবার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করে তারা আন্দোলনে অনড় থাকে। ১৬ তারিখে সারা দেশে এক চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যে আন্দোলনে তৃতীয়পক্ষ ঢুকলে তা চরম সহিংস হয়ে ওঠে এবং অপরাজনীতিতে মোড় নেয়। আন্দোলনটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এটি ছাত্রলীগ বনাম জামায়াত-বি এন পির (সম্মিলিত) সংঘর্ষে ভয়াবহ রুপ ধারণ করে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়তলা ভবন থেকে ১৫ জন ছাত্রলীগ কর্মীকে নিষ্ঠুর ভাবে ছুঁড়ে ফেলে অস্ত্র দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তখন সারাদেশে ৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে পুলিশের সরসারি গুলিতে আবু সাইদ নামে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একছাত্রের মৃত্যুটি বেশ করুণ ছিল এবং সেটা সাধারণ মানুষের মনে বেশ দাগ কাটে। এমতাবস্থায় পরের দিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করা হয় এবং আন্দোলনের দাবানল তীব্র বেগে দেশব্যাপি ছড়িয়ে পরে। এমনকি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও রাজপথে নেমে আসেন। এই ঘোলাটের সুযোগে জামায়াত বি এন পি সহ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীবর্গ একাট্টা হয়ে মাঠে নেমে চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অবস্থা সংকটে মোড় নেয়ার আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৭ তারিখে পবিত্র আশুরার সন্ধ্যায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করেন এবং আন্দোলনকারীদের দাবীর সাথে তিনি আবারো সহমত পোষণ করে তাদেরকে হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানান এবং সকল হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। তবুও তারা কর্ণপাত না করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এরই মধ্যে রাস্ট্রপক্ষ লীভ টু আপিলের মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে নিবেদন করলে সর্বোচ্চ আদালত মামলার তারিখ এগিয়ে নিয়ে ২১ জুলাই রবিবার ধার্য করেন এবং এই বার্তাটি গণমাধ্যমে গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। একই সাথে তিনি আন্দোলন স্থগিত অথবা প্রত্যাহার করে ঐ রাতেই আলোচনায় বসার জন্য তাদের কাছে নিজেকে একজন পিতৃতুল্য নাগরিক হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করে নজিরবিহীন ভাবে অনুনয়-বিনয় করেন। কিন্তু তাতেও তারা সাড়া না দিয়ে বরং ‘ আমার ভাইয়ের রক্ত-লাশের ওপর দিয়ে আমরা আলোচনায় বসতে পারিনা’ মর্মে আন্দোলনের মধ্যে ইমোশনাল ক্রেজ সৃষ্টি করে দুর্বৃত্তদের ধ্বংসযজ্ঞের পালে তীব্র বাতাস যোগায়। ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমা নামাজের পর বর্বরতা আরো তীব্র রুপ ধারণ করে। দেশের রাস্ট্রীয় অবকাঠামোগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞতা চালানো হয়। সেতু ভবনের ৫৫টি গাড়ি ও ভবনের চারতলা পর্যন্ত পুড়িয়ে ছারখার করা হয়; পুড়ে ছাই হয়ে যায় জাতীয় গর্বের প্রতীক- পদ্মাসেতুর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সমূহ;ছাই হয়ে যায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অতীবগুরুত্বপূর্ণ সব ফাইলসমূহ। আগুন ও ব্যাপক ভাঙচুরের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞতা চালানো হয় মিরপুর দশ ও কাজী পাড়া রেল ষ্টেশনে যা সচল করতে একবছরেরও বেশী সময় লাগবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। বিধ্বংসী আক্রমণ চালানো হয় ডেটা বেস সেন্টারে। ফলে দেশব্যাপী সাইবারভিত্তিক অনলাইন কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশব্যাপী বিদ্যুত ও গ্যাসের অসংখ্য প্রিপেইড গ্রাহক চরম ভোগান্তিতে পরেন। আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। আক্রমণ চালানো হয় বিদ্যুতের সাবস্টেশন গুলোতে। অগ্নিসন্ত্রাস চালানো হয় দেশের অন্যতম রাস্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিটিভি ভবনে ; আমাদের দেশ ও জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক মুল্যবান দলিলপত্র সমুহ আগুনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যায়। অর্থাৎ, প্রজন্ম কে বিগত দিনের মতো আবারো বিকৃতির আঁধারে ছুঁড়ে ফেলার নীল নকশার অংশ হিসাবে এ বর্বরতা চালানো হয়। ভয়াবহ হামলা চালানো হয় নরসিংদী জেলখানায় ;এতে ৮২৬ জন আসামী বেরিয়ে যায় যার মধ্যে নয়জন দুর্ধর্ষ জঙ্গি; সাথে একহাজার রাউন্ড গুলি সহ ৮৫ টি অস্ত্র লুন্ঠিত হয়। বর্বরতা ও লুন্ঠন চালানো হয় রামপুরা আনসার ক্যাম্পে। রেললাইনে উপড়ে ফেলে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়। এতে সারাদেশের রেলনেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি মানবিকতার সর্বোচ্চ স্থান হাসপাতালও তাদের নৃশংসতা থেকে রেহাই পায়নি; রংপুরে মা ও শিশু হাসপাতাল এবং ঢাকা ও নারায়নগঞ্জের দুটি হাসপাতালে বর্বরতা চালানো হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও অবকাঠামো গুলোতে ভয়াবহ অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। এতে সমগ্র দেশ ও জনজীবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী ২৫ জুলাই অবধি দেশে ২০৪ জনের প্রাণহানী ঘটে যার মধ্যে পুলিশ, শিক্ষার্থী ও খেটে খাওয়া নিম্নবিত্তরাও আছেন। আদিম বর্বরতার মতো এক পুলিশ সদস্যকে মেরে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। উত্তরায় যুবলীগের এক কর্মীকেও সন্ত্রাসীরা হত্যাকরে এভাবে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল দেশ যুদ্ধকবলিত হয়ে পরেছে; অর্থাৎ কুচক্রী স্বার্থান্বেষী মহল দেশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। স্বাধীনতা উত্তর এমন ভয়ংকর সংকটে দেশ কখনো নিপতিত হয়নি।

অর্থনীতিবীদদের ধারনামতে, ২৪ জুলাই অবধি সংঘটিত পরিস্থিতিতে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ইতোমধ্যে, সহিংসতার সমর্থনে দেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার দুবাইতে বাংলাদেশের একশ্রেণির শ্রমিকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে তাদের ৫৭ জনকে যাবজ্জীবন সহ বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেওয়া হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশবিরোধীরা জাতীয় অর্থনীতির সবচেয়ে বড় উৎস প্রবাসী শ্রম বাজারকে ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র করছে। প্রশাসনের সকল প্রকার উইং থেকে একই প্রতিবেদন উঠে এসেছে আর তা হলো বি এন পি জামায়াতের বিশেষ প্রশিক্ষিত বাহিনী এই বর্বর তান্ডব চালিয়েছে কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নয়। ইতোমধ্যে, এসকল দলীয় দুর্বৃত্তদের সহিংসতার অডিও-ভিডিও ক্লিপস গণমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। বর্বরতার মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চলমান কোটা আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রুপ নিয়েছে মর্মে তাদের সৃষ্ট বর্বরতাকে কোটা আন্দোলনের সাথে ট্যাগ লাগিয়ে কোমলমতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের গায়ে বর্বরতার কালিমা লেপে দিয়েছেন। বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদ গণমাধ্যমে স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন যে, চলমান আন্দোলনে সরকার পতনের দ্বারপ্রান্তে। এভাবেই কোটা আন্দোলনে ভর করে তারা তাদের সরকার পতনের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। মোদ্দাকথা, এমনটাই হতে পারে মর্মে সরকার ও সরকারের বাইরে থেকে অনেকেই আন্দোলনকারীদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল; তবুও তারা আন্দোলন স্থগিত কিংবা বাতিল করেননি। সাধারণ মানুষদেরও বোধগম্য হয়েছিল যে, এই আন্দোলন যদি তারা স্থগিত অথবা প্রত্যাহার করতো তবে এতো ধ্বংসযজ্ঞতা সৃষ্টির মনস্তাত্ত্বিক দুঃসাহস দুর্বৃত্তরা পেতনা। দুঃখজনক হলো, প্রথম ধাপে বর্বরতা সৃষ্টিকারীদেরকে ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থী’ হিসাবে উপস্থাপন করে কিছু মিডিয়া এই ধ্বংসযজ্ঞতাকে কোটা আন্দোলনের রিঅ্যাকশন হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। এতে করে দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম অবলীলায় ব্যবহার করার সুযোগ পায় ; ফলে, দুর্বৃত্তরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে তা রাস্ট্রবিরোধী বিধ্বংসী ষড়যন্ত্রে টার্ন করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী আদেশে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাতে বেসামরিক বাহিনীকে সহযোগিতার লক্ষ্যে কারফিউ জারির সাথে সেনাবাহিনী নামানো হয়। সেই রাতেই বৈষম্য বিরোধী ঢাকাস্থ সমন্বয়কগণ সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি বর্গের কাছে কোটার বাইরে তাদের আটদফা দাবী পেশ করেন। দাবীমালায় ভিসি ও প্রোভিসিদের বিচার চাইলেও ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী কর্তৃক প্রোভিসিসহ পাঁচজন শিক্ষককে ঘৃণ্য লাঞ্ছনার বিষয়ে বিচার চাওয়া হয়নি যা নিরপেক্ষতা এবং তাদের নৈতিক মানদন্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি। ঘোষিত সময় অনুযায়ী গত ২১ জুলাই কারফিউ এর মধ্যে নজিরবিহীন ভাবে আদালত বসে এবং সর্বোচ্চ আদালত উভয় পক্ষের শুনানী শেষে জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ঐদিনই হাইকোর্টের কোটা বহালের রায় বাতিল করেন। এতে মেধা ৯৩%, মুক্তিযোদ্ধা ৫%, নৃগোষ্ঠী ১% এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ এর জন্য ১% কোটা বরাদ্দ রেখে রায় প্রদান করেন। একই সাথে সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রজ্ঞাপন ও গেজেট প্রকাশের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। এ প্রেক্ষিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সন্তোষ প্রকাশ করেন ঠিকই কিন্তু কোটা আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভুত অন্যান্য দাবীনামা পুরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলনরত থাকার ঘোষণা দেন। ইতোমধ্যে, ২২ জুলাই রাতেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রজ্ঞাপন অনুমোদন করেন এবং ২৩ জুলাই গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতেই আনুষ্ঠানিক ভাবে জনপ্রশাসন বিভাগ থেকে আদালতের গাইডলাইন অনুযায়ী সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। উপরন্তু সরকারি চাকুরির সকল গ্রেডে(৯ম-২০তম) এটি কার্যকর করার বিধান চালু হয়। বস্তুতঃ সরকারও এরকম একটা সমাধানের পথে আদালতে চেষ্টারত ছিল। উল্লেখ্য, যেটা ২১ জুলাই আদালতে সমাধান হলো সেটা আদালতেরই নির্দেশনার সূত্রে আগষ্টেই সমাধান হতে পারতো বৈকি। কিন্তু তারা সরকার, বিচার বিভাগ,সমাজের সুধীমহল সহ শান্তি প্রত্যাশি সকলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন। সর্বশেষ , তারা সংঘাতময় পরিস্থিতিকে নুন্যতম বিবেচনায় না নিয়ে এর মধ্যেই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় যা গভীর রহস্যের জন্ম দেয়। তবে কি তারা ও তাদের আন্দোলন সরকার বিরোধী কোনো গোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের হাতিয়ার হিসাবে পূর্ব পরিকল্পিত ছিল?এ সন্দেহ এখন সচেতন মহলে বেশ দানা বেঁধেছে। পরিশেষে, সহিংসতার দায় তারা নিবেনা মর্মে ঘোষণা দিয়ে নিজেদের দায় সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আইসোলেট করে রেখেছে। কিন্তু এমন বিশাল ধ্বংসযজ্ঞতার আগে যদি তারা এরকম ঘোষণা দিত তবে দুর্বৃত্তরা এতটা সাহস হয়তো পেতনা;ফলে তাদের এহেন ঘোষণা আদৌ সময়োপযোগী হয়েছে কিনা তা প্রশ্নের দাবী রাখে। বিষ্মিত বিষয় হলো,তারা এর দায় এড়ালেও চলমান সহিংসতার বিরুদ্ধে তারা কোনো ঘৃণা বা প্রতিবাদ দেখায়নি এবং তা বন্ধেরও আহ্বান জানায়নি যা খুবই দুঃখজনক। বিশেষজ্ঞমতে, ঘোষিত প্রজ্ঞাপনটি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশী। এরপরেও তারা সেটিকে মেনে না নিয়ে একের পর এক শর্ত ও আল্টিমেটাম যুক্ত দাবী জানিয়ে পরিস্থিতিকে আবারো ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। লক্ষ্যণীয়,কোটার বাইরে তাদের অন্যান্য দাবীর নেপথ্যে এখন রাজনৈতিক ইগো স্পষ্টত প্রকাশ পেয়েছে। সংঘটিত পরিস্থিতির দায় তারা এখন পুরোপুরি সরকার ও আওয়ামীলীগের ঘারে চাপিয়ে রাজনৈতিক ‘ব্লেমগেম’ খেলার চেষ্টা করছে যা খুবই দুঃখজনক। প্রজ্ঞাপন পরবর্তী গত ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তারা আলটিমেটাম সহ যে ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তাতে এরকমই সন্দেহ দানা বেঁধেছে। বিষয়টি তাদের আন্দোলনের নৈতিক ও আদর্শিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে বৈকি। কেননা, এদেশের আপামর সাধারণ শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র তাদের কোটা ইস্যুতেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নেমেছিলেন,কারোর রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য নয়। অথচ কোটা সমস্যার সমাধানে প্রত্যাশার চেয়ে বেশী প্রাপ্তি ঘটার পরেও কোটা আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেই সরল আবেগকে কারোর রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের দুরভিসন্ধিতে যদি অপব্যবহার করে, তবে তা হবে গণপ্রতারণার সামিল।

প্রসঙ্গত: জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘ স্ট্যাটিক্স অব অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ ‘ বইয়ের তথ্যানুসারে মন্ত্রণালয়, বিভাগ,অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও সরকারি অন্যান্য কার্যালয় গুলোতে ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৯১০ জন বেসামরিক জনবলের পদ সন্নিবেশিত আছে(ইতোমধ্যে সংযোজন/বিয়োজন না হলে)। ৬ষ্ঠ জাতীয় গণশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা হলো ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এই হিসাবে মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৯২৬% মানুষ সরকারি চাকুরির সুযোগ পায়। অথচ জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে স্রেফ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে তারা সমগ্র দেশকে ভয়ংকর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। ‘বাংলা ব্লকেড ‘ ও ‘কমল্পিট শাটডাউন’ এর মতো গণভোগান্তির কর্মসূচি না দিয়ে তারা তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থের আন্দোলন সমগ্র দেশের ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারতো। তৃতীয়পক্ষ অনুপ্রবেশের পূর্বাভাস জানা সত্ত্বেও তাদের গণভোগান্তির আন্দোলন তারা রাস্ট্রবিধ্বংসী ষড়যন্ত্রের কোপানলে ঠেলে দিয়েছে – ইতিহাসের নিরপেক্ষ ও নির্মোহ মুল্যায়ন ঠিক এরকমই হবে বলে সচেতন মহল মনে করেন। স্বীয়স্বার্থ চরিতার্থে তাদের এতটুকুও ধৈর্য্য ধারনের সময় হলো না!এ কোন্ শিক্ষা যে শিক্ষায় ধৈর্য্যের মহিমা নেই, নেই সহিষ্ণুতার সৌন্দর্য ও স্বদেশ প্রেমের মানবিক মুল্যবোধ?কবি গুরুর অনুভবে- ‘আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে…’ এভাবে কালের বিষন্ন স্রোতে সন্তানহারা বহু মায়ের ব্যথিত অশ্রুপাত ভাসতে..ভাসতে হয়তো একদিন শুকায়ে যাবে কিন্তু ইতিহাসের বিদগ্ধ আখরে তাদের এই আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে জ্বলবে। তবুও ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিশুদ্ধের পথে তারুণ্যের সম্ভাবনাময় ‘আগামী’ সম্প্রীতির সুচেতনায় দ্যুতিময় হয়ে উঠবে-এই শুভ প্রত্যাশায় আমরা।

বিজ্ঞাপন

লেখক: কলামিস্ট

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন