বিজ্ঞাপন

‘বার্মার লোকেরা’ চুরি করছে গোয়ালের গরু, উপড়ে নিচ্ছে গাছ

June 3, 2018 | 8:57 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার থেকে ফিরে: এক থেকে ছয় পর্যন্ত উচ্চারণটা ঠিক থাকে, পার্থক্য শুরু হয় এরপর থেকে। তারা বলেন, হাত (সাত)। সাত শব্দটা এখনও আয়ত্তে আসেনি তাদের। বিশ থেকে ভেঙে ভেঙে হিসাব করে তারা- একশো বিশকে বলেন, ছয় কুড়ি। কথা বলার ঢঙে এই পার্থক্য আর গেঞ্জির ওপর লুঙ্গি পরা দেখে কেবল নিশ্চিত হওয়া যায়- এরা কক্সবাজারের স্থানীয় নন, রোহিঙ্গা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্ধারিত ক্যাম্পগুলো ছেড়ে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো কক্সবাজারে, আর তাতে নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কক্সবাজরের টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার কারণে স্থানীয় প্রায় ৫ লাখ মানুষ কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। তারা বলছেন, গত বছরের আগস্টে যখন রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করে, তখন তাদের প্রতি সহানুভূতি-মায়া-ভালোবাসা ছিল। এখন তার বদলে ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে স্থানীয়দের মনে। ক্যাম্পগুলোর আশেপাশে স্থানীয় বনাম রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষ এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা বলছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে তাদের কৃষিজমি, কর্মসংস্থান ও আয় কমে গেছে। ধ্বংস হয়েছে বনাঞ্চল ও পাহাড়। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নিজেদের বাড়িতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এখন নিজ বাড়িতে পরবাসী দশা তাদের। এসব কিছুই রোহিঙ্গাদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণ।

তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, রোহিঙ্গাদের জন্য নির্ধারিত ৩০টি ক্যাম্পের বাইরে বের হওয়ার অনুমতি না থাকলেও প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে কক্সবাজারে। আর ভাষা, চেহারা একই রকম হওয়ায় তাদের আলাদা করার কঠিন।

 

বিজ্ঞাপন

লম্বাসিয়া ক্যাম্প-২ এর বাসিন্দা সাইফুল্লাহ। কুতুপালং রাস্তার মাথার বাজার থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি আম কেনেন। সাইফুল্লাহ জানান, এই আম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তিনি বিক্রি করবেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। সাইফুল্লাহ মিয়ানমারে কারাগারে ছিলেন, একমাস আগে তিনি এখানে এসেছেন। তবে আগস্ট মাসেই তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে।

সাইফুল্লাহ জানান, ক্যাম্পগুলোতে যেসব জিনিস পাওয়া যায় না, সেগুলো কিনে নিয়ে গিয়ে তিনি বিক্রি করেন। এতে তাদের আয় ভালোই হয়। ক্যাম্পের বাইরে কিভাবে এলেন জানতে চাইলে নিরব থাকেন সাইফুল্লাহ।

সাইফুল্লাহকে ঘিরে তখন স্থানীয়দের ভিড়। তারা অভিযোগ জানিয়ে বলেন, বার্মার লোকেরা আইয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করতেছে, আমরা কিছুই করতে পারি না। ডেইলি কাজও তারা করে। তারা বলেন, স্থানীয় বাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ হিসেবে আসা চাল, ডাল ও তেল কম দামে পাওয়া যায়। কিন্তু সবজি, মাছ-মাংসের দাম আমাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। আর এ সংকটকেই কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, তারা পণ্য মজুদ করছেন। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যতো গেছেই, গোয়াল থেকে গরু চুরি করছে, গাছ থেকে সুপারি নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যাদের আশ্রয় দিলাম, তাদের জন্য এখন আমরাই না খেয়ে মরছি।

বিজ্ঞাপন

কুতুপালং রাস্তার মাথার বাজারেই কথা হয় ৫৫ বছরের শুভধন শর্মার সঙ্গে। জানালেন, কেবল তার নয়, তার দাদার দাদার জন্ম হয়েছে এই কুতুপালং বাজারে। শুভধন শর্মা সারাবাংলাকে বলেন, বার্মার লোকেরা আইয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করতেছে, আমরা কিছু করতে পারি না। একই কথা বলেন, ৭৪ বছরের অধোলাল বড়ুয়া। তিনি বলেন, সেলুনে কাজ করে সংসার চালাতাম। কিন্তু এখন সব কাজ বন্ধ আমাদের। দোকান বন্ধ করে এখন ঘরে বসে আছি। লাখ লাখ মানুষ আসছে বার্মা থেকে, তাদের কারণে এখন আমাদের দেশে আমরা কাজ পাচ্ছি না, বলেন অধোলাল।

উখিয়া কলেজের তৃতীয় বর্ষের পায়েল বড়ুয়া বলেন, আগে তাদের বাড়ি থেকে কলেজে যেতে অটোরিকশা ভাড়া ছিল ৮ টাকা। সেই ভাড়া বেড়ে এখন হয়েছে ২০ টাকা। বাড়তি ভাড়ার কারণে সপ্তাহে দুইদিন কলেজে যান। কুতুপালংয়ের পূর্ব পাড়ার শুভাষী বড়ুয়া, বাসু বড়ুয়াসহ অন্যরা বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়রা ইতোমধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নানাভাবে নিগৃহের শিকার হচ্ছেন তারা। এমনকি সাংবাদিক, এনজিও সবাই খোঁজ নিচ্ছে রোহিঙ্গাদের- স্থানীয়রা কেমন আছেন সেদিকে কারও নজর নেই। অথচ, রোহিঙ্গারা গোয়াল থেকে গরু নিয়ে যাচ্ছে, গাছ থেকে ফল নিয়ে যাচ্ছে, শিকড়সহ গাছ উপড়ে নিচ্ছে। আর সবার সহযোগিতার কারণে তাদের হাতে টাকাও রয়েছে অনেক। স্থানীয় বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণ করছে তারা।

কক্সবাজার জেলার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য হুমকি, নানা কারণেই। কয়েকদিন পর এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কি না সেই বিষয়ে এখনই কর্মকৌশল নির্ধারণ করা উচিৎ।

রাখাইনে তাদের কী অবস্থা ছিল- মোটা দাগে দেখতে হবে বাংলাদেশে তারা খারাপ অবস্থায় আছে কি না। একইসঙ্গে তাদের প্রত্যাশা যেন বেড়ে না যায় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন শরাণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, স্থানীয়দের আয় কমে যাচ্ছে কারণ স্থানীয় বাজারে রোহিঙ্গারা অল্প মজুরিতে শ্রম বিক্রি করছে, তারা ক্রমান্বয়ে জব-মার্কেট দখল করে নিচ্ছে।

অথচ শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয়রাই সব করেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে স্থানীয়দের দুর্দশার জন্যও তারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতি দায়ী বলছেন তারা। এসব কারণে চাপা ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয়দের ভেতরে, বলেন রাহমান নাসির উদ্দিন।

সারাবাংলা/জেএ/এটি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন