বিজ্ঞাপন

জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব

July 31, 2024 | 8:42 pm

এম আর লিটন

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেন। দালাল আইনে তাদের বিচার শুরু হয়। এতে জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মী দণ্ডিত ও পলাতক হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যায়। সামরিক শাসকদের মদদে জামায়াত পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে আসে। যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও দলটির নেতারা সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃত্বে গঠিত রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী যুদ্ধাপরাধে যুক্ত ছিল।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েম ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে পুনরায় রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন। ওই সময় ক্ষমতার মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন জিয়াউর রহমান। জামায়াত ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদে প্রবেশ করে ও রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়। লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের মতে, জামায়াতের পুনরুদ্ধার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলে এবং হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের আমলে তাদের কর্মকাণ্ড তা স্পষ্টভাবে প্রদর্শিত হয়। জামায়াতের ওই পুনর্জাগরণ স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দেশে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে সহিংসতা, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে জামায়াতের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব দেয়। তৎকালীন সময়ে, ১৬-১৭ নভেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ নয়, বরং তাদের নিষিদ্ধ ও দমন করার প্রস্তাব পাস করা হয়।

ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কার্যত প্রকাশ্য নাশকতায় অবতীর্ণ জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ নয়, তাদেরকে নিষিদ্ধ ও দমন করাই এখন জরুরি কর্তব্য।’ এতে উল্লেখ করা হয়, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের রায়ের ঠিক আগে জামায়াতের সঙ্গে সংলাপের মার্কিন প্রস্তাব বিচার কাজকে বিঘ্নিত করে, ঘাতকদের রক্ষা করার একটি ঘৃণ্য প্রয়াস।’ প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে মতপার্থক্য নিরসনের পরামর্শ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারকে। সেদিন কারও বোঝার বাকি ছিল না, সেটি ছিল মার্কিন ঘনিষ্ঠ পাকিস্তানের খুনি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় এজেন্টদের রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। আজকের মার্কিনদের এই প্রস্তাবও সেদিনের ওই তৎপরতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।’

বিজ্ঞাপন

প্রস্তাবে বাহাত্তরে প্রণীত আদি সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদ অবিকৃতভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিধি প্রয়োগ করে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবে আরও ছিল, “রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার একই সঙ্গে পবিত্র ধর্মকে যেমন কলুষিত করে, তেমনি রাজনীতিকেও বিপদাপন্ন করে তোলে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান থাকতে পারে না। গণতন্ত্রে ‘ধর্ম যার যার, কিন্তু রাষ্ট্র সবার’। রাষ্ট্র ও ধর্মকে পৃথক করে তাদের নিজ নিজ মর্যাদার আসনে আলাদাভাবে অধিষ্ঠিত রাখার নীতি অনুসরণ করা অপরিহার্য।’’

পরবর্তী সময় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ব্যক্তিদের বিচার হলেও, দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও তোলা হয়েছিল। গোলাম আযমের মামলার রায়ে আদালত জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করার পর ওই দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। একই বছর, হাই কোর্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করে।

পরে গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ ও সিপিবিসহ প্রগতিশীল দলগুলো ওই দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। তবে এত প্রচেষ্টা ও দাবির পরেও জামায়াত নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। এ পরিস্থিতি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার আলোচনা আবারও শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ‘১৪ দলীয় জোট’ বৈঠকে ওই বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলো জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একমত হয়। গণজাগরণ মঞ্চসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অনেকেই ওই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

এই প্রসঙ্গে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া কেবল রাজনৈতিক স্বার্থেই নয়, বরং একটি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দেখা উচিত। দেশের গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার স্বার্থেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

তবে, গত এক যুগে কেনো ওই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা, হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়গুলো আড়াল করতে ও চলমান পরিস্থিতি থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে সরাতে জামায়াতে নিষিদ্ধ করার ইস্যু সামনে আনা হয়েছে। সমালোচকরা বলেন, ক্ষমতাসীন দল সারা বছর মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে তোষণ করে, কিন্তু যখন তারা রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটে পড়ে, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামনে এনে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে। এছাড়া সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক সুবিধা ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে মৌলবাদী শক্তি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সরকার মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও, মৌলবাদের উত্থানে তাদের ভূমিকা সমালোচনীয়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার পরেও সরকার মৌলবাদ-তোষণ নীতি বদলায়নি।

এমতাবস্থায়, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য, শুধুমাত্র তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়, বরং তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরও প্রতিরোধ করা জরুরি। শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে বেগবান করতে হবে। যাতে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এ লক্ষ্যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার অনুসারী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করা প্রয়োজন। সরকারের দায়িত্ব হল, মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সত্যিকার অর্থেই কাজ করা।

বিজ্ঞাপন

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও অনলাইন এক্টিভিস্ট

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন