পর্যটক খরায় রাঙ্গামাটি, ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ

প্রান্ত রনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাঙ্গামাটি: কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রথমে ‘বাংলা ব্লকেড’ ও পরে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির জেরে দেশব্যাপী নাশকতা চালায় দুষ্কৃতকারীরা; সৃষ্টি হয় এক অরাজক পরিস্থিতি। এর বড় প্রভাব পড়েছে রাঙ্গামাটির পর্যটনখাতে। পুরো জুলাই মাস জুড়েই ভুগেছে পর্যটক খরায়।

জুলাইয়ের শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেও পাহাড়ে পর্যটকদের আনাগোনা ছিল। মাসের মধ্যবর্তী সময়ে আন্দোলন পরিস্থিতি উত্তাল ও সহিংসতার জের ধরে পাহাড়ের পর্যটনে বড় ধাক্কা লাগে। সেই ধাক্কা এখনো সামলিয়ে উঠতে পারেনি পাহাড়ের এই খাতসংশ্লিষ্টরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাহাড়ে পর্যটকদের আগমন মোটাদাগ কমে গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় পর্যটন মৌসুম। দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান না হলে পাহাড়ে পর্যটকদের ভিড় বাড়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে পর্যটনশিল্প বড় ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। আগস্ট মাসেও পর্যটক না বাড়ার শঙ্কায় রয়েছে খাতসংশ্লিষ্টদের।

রাঙ্গামাটির হোটেল-মোটেল কটেজ-রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা জানান, তিন পার্বত্য জেলার পর্যটনে অর্থনৈতিক বড় খাত হোটেল-মোটেল, কটেজ-রিসোর্ট ভাড়া। জেলার সবচেয়ে নান্দনিক পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি মেঘ পাহাড়ের উপত্যকা বাঘাইছড়ি সাজেক ভ্যালি উপত্যকা ব্যবসায়ীরা পর্যটক খরায় ভুগছেন। নিরাপত্তাহীনতা ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কারণে পর্যটক কমে গেছে খোদ রাঙ্গামাটি শহরের পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে। একই অবস্থার কথা জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি-বান্দরবানের হোটেল-মালিকরাও।

প্রায় চারদিকে কাপ্তাই হ্রদ বেষ্ঠিত পর্যটন শহর রাঙ্গামাটির কোণায় কোণায় বিভিন্ন পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র। শহরে এসব পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রে যাতায়াতে পর্যটক ও স্থানীয়রা একমাত্র অভ্যন্তরীণ যানবাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা। পর্যটক খরায় কারণে রাঙ্গামাটির নান্দনিক আসামবস্তি-কাপ্তাই সংযোগ সড়কসহ শহর এলাকায় চলাচলরত অটোরিকশার যাত্রীও কমেছে।

এদিকে, আশানুরূপ পর্যটক কমতে থাকায় কাপ্তাই হ্রদে পর্যটকদের দেখা মিলছে না। অলস সময় পার করছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। এতে করে ট্যুরিস্ট বোট খাতে নিয়েজিত মালিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। আর্থিক সংকটেও ভুগছেন তারা।

রাঙ্গামাটির পর্যটন বোটঘাটের ব্যবস্থাপক ও ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতির সহ-সভাপতি মো. রমজান আলী বলেন, ‘জুলাই মাস সময় থেকে কাপ্তাই হ্রদে চলাচলকারী ট্যুরিস্ট বোটের ওপর জীবিকানির্বাহে নির্ভরশীল শ্রমিক-কর্মচারীরা অলস সময় পার করছেন। কাপ্তাই হ্রদে চলাচলকারী আমাদের ১২০টি অধিক ট্যুরিস্ট বোট রয়েছে; মালিক-শ্রমিক মিলে আছেন ২০০ জন। বিগত দুই সপ্তাহ ধরে পর্যটক শূন্যতায় পেশার করুণ দশা হয়েছে। অনেকের ঘরে চুলা জ্বালানোর ব্যবস্থাও নেই।’

তিন পার্বত্য জেলার আকর্ষণীয় পর্যটককেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম বলা হয় সাজেক ভ্যালি উপত্যকাকে। ভৌগলিক ও প্রকৃতিগতভাবে সাজেক রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে অবস্থিত হলেও যাতায়াত ও পর্যটককেন্দ্রিক অর্থনৈতিকখাতে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত খাগড়াছড়ি জেলার উদ্যোক্তারা। সাজেকের পর্যটনে ভাটার প্রভাব পড়েছে খাগড়াছড়ির চাঁন্দের গাড়ি হিসেবে পরিচিত জিপ চালক-শ্রমিকদের মাঝেও। পর্যটক কমে অলস হয়ে পড়ছেন পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ পরিবহনখাতের সংশ্লিষ্টরা। অন্য সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ি ও জিপসহ শতাধিক যানবাহন খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বর থেকে সাজেকের উদ্দেশে ছেড়ে গেলেও এখন এই শঙ্কা গড়ে পাঁচটির কম বলে জানা গেছে।

সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রাহুল চাকমা জন বলেন, ‘বিগত তিন-চার মাস ধরে সাজেকের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দুর্দিন যাচ্ছে। কয়েকধাপে সাজেকের সড়কে বন্যার পানি বৃদ্ধির পর জুলাইয়ে দেশে চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখন সাজেক পর্যটন শূন্য বলা চলে। এত বড় সাজেক ভ্যালি পর্যটনকেন্দ্রে ২০-২৫ পর্যটক কিছুই না। সাজেক কটেজ মালিক সমিতির অধীনে সাজেকে ১১৬টি কটেজ-রিসোর্ট রয়েছে। এসব কটেজ-রিসোর্ট মালিকদের অনেকেই ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। পর্যটক না থাকলেও কটেজ ভাড়া, স্টাফের মজুরি, পানিসহ আনুষাঙ্গিক সব খরচ বহন করতে হচ্ছে। পর্যটক না থাকায় সাজেকের খাবার দোকান, যানবাহন ও পর্যটকবাহী পরিবহনের সঙ্গে জড়িতরাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’

তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন শিল্পে সিম্বল বা প্রতীক হিসেবে পরিচিতি রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্মিত বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ঝুলন্ত সেতু। জুলাই মাসজুড়ে ঝুলন্ত সেতুটি ভ্রমণে পর্যটকদের উপস্থিতি কমে গেছে বলছে কর্তৃপক্ষ। স্থানীয়রা ও পর্যটকসহ গড়ে ১০০-১৫০ টিকিটের বেশি বিক্রয় হচ্ছে না বলে জানালেন রাঙ্গামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা।

তিনি বলেন, ‘পর্যটন ঝুলন্ত সেতুতে প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০ মানুষ টিকিট কেটে ভ্রমণ করছেন। এরমধ্যে স্থানীয়রাও রয়েছে। আমাদের হোটেল-মোটেল ভাড়াও আশঙ্কাজনক ভাবে কমে গেছে। আমাদের বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৮৫টি রুম থাকলেও প্রতিদিনি গড়ে ভাড়া হরচ্ছে তিন-চারটি। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই সমস্যা আমাদেন পর্যটন মৌসুম। মৌসুমের আগের এই সময়টাতে আমরা পর্যটক খরায় আছি।’ নিবিঘ্নে যানবাহন চলাচল হলে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা সংকট কাটবে মৌসুম শুরুর আগেই সংকটের উত্তরণ হতে পারে বলছেন কর্মকর্তা।

রাঙ্গামাটি আবাসিক হোটেল মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘আমাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত হোটেল বোডিংয়ের সংখ্যা ৫৩টি। সমিতির বাহিরেও অন্যান্য রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে। দেশের চলমান অবস্থাকে কেন্দ্র রাঙ্গামাটিতে পর্যটকরা না আসায় কার্যত বেশিরভাগ হোটেলই বন্ধ রয়েছে। আমাদের হিসাবে পর্যটক থাকলেও সব মিলিয়ে দৈনিক ২০-২৫ লাখ টাকার ব্যবসা হওয়ার সুযোগ থাকলেও এখন আমরা সেই ক্ষতির মুখে পড়েছি।’

বর্তমান সময়ে পাহাড়ের পর্যটনশিল্পকে অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিকখাত হিসেবে উল্লেখ করে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাট্রিজ রাঙ্গামাটির সভাপতি মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক খাতগুলোর মধ্যে প্রধান বলা চলে পর্যটক সেক্টরকে। কিন্তু বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে পর্যটক নেই বললেই চলে। এতে করে এখানকার হোটেল-মোটেল, অভ্যন্তরীণ যানবানহন, ট্যুরিস্ট বোটসহ খাত সংশ্লিষ্টরা সকলেই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’

সারাবাংলা/এনইউ