বিজ্ঞাপন

প্রফেসর ইউনূসের দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত?

August 2, 2024 | 5:50 pm

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতায় অনেক প্রাণ হারিয়েছে, হাজার হাজার আহত হয়েছে এবং অগণিত সরকারি সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। হতাহতদের মধ্যে ছাত্র, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মী, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মী এবং বিভিন্ন বয়সের সাধারণ মানুষ ছিল। শুধু সরকারকে বিপদে ফেলতে নয়, দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দেশবিরোধীরা ভয়ঙ্কর ভাংচুর ঘটিয়েছে এবং অগণিত জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা করে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করে। যখন সরকার উত্তপ্ত পরিস্থিতি প্রশমিত করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তখন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ একটি মহল দেশের চলমান সহিংসতা, গণতন্ত্র, নির্বাচন এবং আইনের শাসন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় মিথ্যা ও মনগড়া বক্তব্য ছড়াচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে নির্বিচারে হামলার নিন্দা না করে তিনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষা কারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসব ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন তা দেশবাসীকে আহতকরেছে। শুক্রবার (২৬ জুলাই) ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক দ্য হিন্দুর প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস সশস্ত্র বাহিনীর হাতে কিছ বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ায় সহিংসতা বন্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সংকট মোকাবেলায় ‘স্বল্পসময়ে’ বাংলাদেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রস্তাবও করেন তিনি। বিশিষ্ট ভারতীয় সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দারের সাথে সাক্ষাত্কারে এই অর্থনীতিবিদ অভিযোগ করেন যে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বিদেশী বাহিনীর মতো গুলি করে নাগরিকদের হত্যা করছে।

একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এইসব অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট, ভিত্তিহীন এবং বাংলাদেশের জন্য মানহানিকর। প্রথমত, তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ দেখামাত্র গুলি করেছে। কিন্তু বাস্তবে বিভিন্ন ভিডিও চিত্র এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণকরে দেখা যায়, বাস্তবে এধরনের ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পকে ড. ইউনূসের দাবি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। সহিংসতার কারণে সরকার ২০ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে এবং সেনা মোতায়েন করে। সেনাবাহিনী দেশব্যাপী জন জীবনের সার্বিক নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। সন্দেহ নেই, অন্যান্য বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দ্রুত আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার এবং বিদ্যমান আইনের আওতায় জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তখন অধ্যাপক ইউনূসসহ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বিদেশে এই বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক তথ্য ছড়াচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, ড. ইউনূস বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী নির্বাচনের আহ্বান জানান, যা অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য। ৭ জানুয়ারি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা নতুন নির্বাচনের অযৌক্তিক আহ্বানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনেক আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, উৎসব মুখর পরিবেশে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মোট ১৫৩৪ জন প্রার্থী এবং ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রাথীর্ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। অনেক গ্রামীণ নির্বাচনী এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৭০ শতাংশের মতো। শহর এলাকায় তুলনামূলকভাবে কম ভোটার হওয়ার কারণে জাতীয় গড় ভোটের হার ছিল প্রায় ৪২শতাংশ। নির্বাচনের আগে কিছু রাজনৈতিক দল দ্বারা সহিংসতার কারণে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভোটের দিন কিছু ভোট কেন্দ্রে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। তাই নতুন করে নির্বাচনের দাবি অগ্রহণযোগ্য এবং অবাস্তব।

বিজ্ঞাপন

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে সহিংসতা বন্ধে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি অধ্যাপক ইউনূসের আহবানে বাংলাদেশি নাগরিকরা বিস্মিত। অধ্যাপক ইউনূসের মতো একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে এমন আহ্বান অপ্রত্যাশিত ও দুর্ভাগ্যজনক। কোনো দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেনা এবং এটি কোনো আন্তর্জাতিক আইনে ও স্বীকৃত নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইউনূসের মন্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে দেশের প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার কোনো আস্থা নেই এবং তিনি প্রকাশ্যে পশ্চিমাদেশ ও জাতিসংঘকে বাংলাদেশে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানাচ্ছেন, যা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ড. ইউনূস হঠাৎ করে কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানালেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, আত্মসাতের অভিযোগ চাপা দিতেই তিনি এসব কিছু করছেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘন, মানিলন্ডারিং এবং দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা চলমান। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে এই সমস্ত অভিযোগের এমন অকাট্য প্রমাণ আছে যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সম্ভবনা একদম কম। এটা বুঝতে পেরেই অধ্যাপক ইউনূস এই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। বিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য দ্বিমুখী কৌশল গ্রহণ করেছেন। প্রথমত, বাংলাদেশে আইনের শাসন নেই, গণতন্ত্র নেই এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ নাগরিকদের নিপীড়ন করছে এমন একটি প্রপাগান্ডা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে বিশ্বনেতাদের প্রভাবিত করা। দ্বিতীয়ত, ড. ইউনূস অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছেন এবং গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের মতো ইস্যু তুলে বিরোধীদলগুলোর সমর্থণ আদায়ের চেষ্টা করছেন।

অধ্যাপক ইউনূস এমনই একজন ব্যক্তি যিনি দেশে যখনই কোনো সংকট দেখা দেয় তখনই বিদেশ চলে যান। দেশের চলমান সংকটের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন স্পেন সফর স্থগিত করলেও অলিম্পিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্যারিসে গেলেন অধ্যাপক ইউনূস। লক্ষণীয় যে বন্যা, দুর্যোগ, করোনা মহামারী বা অন্য কোনো সংকটের সময় তাকে দেশবাসী কোথাও খুঁজে পায়না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ড. ইউনূস অত্যন্ত সক্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে একটি অনির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোই এই কার্যক্রমের প্রাথমিক উদ্দেশ্য বলে মনে করা হচ্ছে। দ্য হিন্দু, ডয়চে ভেলে এবং মানবজমিনের মতো বেশ কয়েকটি মিডিয়া আউটলেটে সাক্ষাৎকারের সময় দেওয়া তার রাজনৈতিক বক্তব্য থেকেও এটি স্পষ্ট।

বিজ্ঞাপন

ড. ইউনূসের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা কারোই অজানা নয়। দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ একটি গোষ্ঠীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, তিনি ২০০৬ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থনের জন্য জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। দীর্ঘদিন পর প্রফেসর ইউনূস আবার তার গোপন এজেন্ডা নিয়ে রাজনৈতিক মাঠে ফিরেছেন। তিনি এখন প্রকাশ্যে গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার এবং সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি একটি অনির্বাচিত সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সারাদেশে যে দাঙ্গা ও ভাঙচুর শুরু হয়েছিল, তাতে উসকানি দেওয়ার চেষ্টায় তিনি বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করেন।

আমরা আশা করি, কোটা আন্দোলনের ছদ্মবেশে দেশের উপর যে আঘাত এসেছে শিগগিরই সেরে যাবে। সংঘটিত বিশৃঙ্খলার মুখে সরকারের দৃঢ পদক্ষেপ কেবল নাগরিকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনবেনা বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা দেবে যে শেখ হাসিনা এখনও একজন যোগ্য এবং জনপ্রিয় নেতা যিনি বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম।

লেখক: কলামিস্ট এবং পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (সিএসএএস); সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন