বিজ্ঞাপন

শিক্ষামন্ত্রীর বাসায় হামলা, এমপির অফিসে আগুন

August 3, 2024 | 7:54 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের মিছিল থেকে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাসভবনে হামলা চালানো হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মো. মহিউদ্দিন বাচ্চুর কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। নগরীতে কয়েকটি পুলিশ বক্স এবং ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরাও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় নগরীর নিউমার্কেটে বিক্ষোভ শেষ করে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় পথে পথে এসব হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শনিবার বিকেলে নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টার দিকে বিক্ষোভ শেষে মিছিল নিয়ে তারা টাইগারপাস, লালখান বাজার হয়ে জিইসি মোড়ের দিকে যাচ্ছিলেন। লালখান বাজার আমিন সেন্টার অতিক্রম করে ওয়াসার মোড় যাওয়ার পথে সড়কের বামে পেট্রোল পাম্পের পাশে চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর কার্যালয়ে হামলা শুরু করেন মিছিলকারীরা। এ সময় তারা ওই কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে সারাবাংলার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ইমরান চৌধুরী জানান, কার্যালয়ের দফতর সেলে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অফিসের চেয়ার-টেবিলসহ আরও বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। আইটি রুমের কম্পিউটার, টেলিফোন সেট ভাঙা অবস্থায় দেখা গেছে। কার্যালয়ের প্রধান ফটক ও ভেতরের কক্ষগুলোতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার চিহ্ন দেখা গেছে। এ ছাড়া কার্যালয়ে থাকা সব সিলিং ফ্যানেও আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন মিছিলকারীরা।

বিজ্ঞাপন

আবদুর রহিম নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে ঢুকে চেয়ার ও টেবিল ভাঙচুর করে। আমরা কয়েকজন ভেতরেই ছিলাম। পরে আমি বের হয়ে আসি। তারাই ভেতরে আগুন দিয়েছে।’

ঘটনার প্রায় একঘণ্টা পর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুকে নিয়ে সেখানে যান। এ সময় তারা ক্ষতিগ্রস্ত কার্যালয় ঘুরে দেখেন।

বিজ্ঞাপন

এ সময় নগর আ জ ম নাছির উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে জামায়াত-শিবির যে আছে সেটা এ হামলার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে। কারণ আজ (শনিবার) আমাদের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বিশাল বিশাল জমায়েত ছিল। প্রধানমন্ত্রী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে ছাত্রদের ওপর কোনোভাবে হামলা করা না হয়। তারা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে তারা তাদের কর্মসূচি পালন করে যেতে পারে সেজন্য আমরা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু ছাত্রদের মিছিল থেকে আমাদের দলের এমপি কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলনকারীরা শিক্ষামন্ত্রীর বাসায়ও হামলা করেছে। এ হামলার আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই। সরকারকে অনুরোধ করব রাজপথে অবস্থান করে এ যে একের পর এক রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর হামলা করছে অতি দ্রুত এটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আন্দোলনে জামায়াত-বিএনপি অনুপ্রবেশ করেছে। এ আন্দোলন স্বাধীনতা পক্ষের শক্তিকে উৎখাত করার একটি আন্দোলন।’

সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘কোমলমতি ছাত্রদের আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসীরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতি করেছে, গাড়ি ভাঙচুর করেছে। কয়েকদিনের ধারাবাহিক আচরণ তাদের। নগরীর ১৪টি পয়েন্টে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছিল জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। প্রশাসন থেকে আমাদের বলা হয়েছে তারা বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা সরকার দলীয় সংগঠন যেহেতু তাই আমরা প্রশাসনের বক্তব্যকে সম্মান জানিয়েছি। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, আমাদের নেতাকর্মীদের বাসায় হামলা করবে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করবে। আমরা আর চুপ করে থাকব না। দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরেছিলাম। আমরা রাজপথে নামলে কাউকে ছাড় দেবো না। আওয়ামী লীগের সে ইতিহাস আছে।’

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর অফিসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। নিউমার্কেট থেকে বহদ্দারহাট মিছিল যাওয়ার পথে কয়েকটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়েছে। নিউমার্কেট এলাকায় আমাদের সিসি ক্যামেরাগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে, সন্ধ্যা ৭টার দিকে নগরীর খুলশী থানার ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকা অতিক্রম করছিল আন্দোলনকারীদের মিছিল। সেখান থেকে শতাধিক লোক চশমাহিলে মেয়র গলিতে ঢুকে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাসভবনে হামলা করেন। তবে মূল ফটক বন্ধ থাকায় তারা ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। এ সময় বাসায় থাকা মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

শিক্ষামন্ত্রীর মা বেগম হাসিনা মহিউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বাসায় আক্রমণ হয়েছে। ইট, পাথর মেরে আমাদের বাসার দরজা-জানালা ভাঙচুর করেছে। দুইটা গাড়ি বাসার সামনে রাখা ছিল। সেগুলো ভাঙচুর করেছে।’

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. মোখলেছুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের বাসা লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়েছে। খবর পেয়ে আমাদের টিম ঘটনাস্থলে গেছে।’

নিউমার্কেট অবরুদ্ধ করে ৩ ঘণ্টা বিক্ষোভ

শনিবার বিকেল তিনটার দিকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় কয়েক হাজার আন্দোলনকারী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় নগরীর জিপিও মোড়, সদরঘাট মোড়, স্টেশন রোড এবং আমতল মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলনকারীরা নিউমার্কেট মোড় অবরুদ্ধ করে ফেলে। ফলে নিউমার্কেট মোড় ঘিরে ব্যস্ততম চারমুখী সড়কে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

আন্দোলনকারীরা এ সময় নিউমার্কেটে অবস্থিত বিপনী বিতানের দেয়ালসহ বিভিন্ন দোকানের শাটারে স্প্রে রঙ দিয়ে ‘দফা এক দাবি এক, হাসিনার পদত্যাগ, স্টেপডাউন হাসিনা, বুলেট ডরাই না’- দেয়ালে বিভিন্ন বাক্য লিখে দেন। বিক্ষোভের সময় সংবাদ চ্যানেল ডিবিসি নিউজের রিপোর্টার মুজিবুর রহমানকে দুই দফায় লাঞ্ছিত করে আন্দোলনকারীরা।

মুজিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এক আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীর বক্তব্য নিচ্ছিলাম। এ সময় কয়েকজন এসে আমার মাইক্রোফোন ধরে টান দেয়। তারা আমাকে কয়েকবার ধাক্কাও দেয়। পরে আমি তাদের বুঝানোর চেষ্টা করলে তারা আমার মাইক্রোফোনে থাকা ডিবিসির লোগো ছিঁড়ে ফেলে। এর পর আমি ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসি।’

এদিকে, সমবেতদের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের সহ সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, ‘এটা কোনো বক্তৃতার মঞ্চ নয়, আমরা বক্তৃতা দিতে আসিনি। গল্প বলতে চাই না, আপনারা সবই জানেন। গতকাল (শুক্রবার) বলেছিলাম একটিও বুলেট চালাবেন না, ফলাফল ভালো হবে না। কিন্তু আপনারা আমাদের কথা শোনেননি। আপনারা ঢাকা, সিলেট, রংপুরে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গুলি করে আমার ভাইদেরকে হত্যা করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, কোনো খুনির জায়গা এ বাংলার মাটিতে হবে না। আপনারা জানেন, এখন আমাদের ছাত্র নাগরিকদের গণঅভ্যুত্থান ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের ছাত্র নাগরিকদের গণঅভ্যুত্থান ততদিন পর্যন্ত চলবে যতদিন পর্যন্ত হাসিনার পদত্যাগ না হয়। ভবিষ্যতে আমরা যদি ঘোষণা দিতে না পারি, আপনারা সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।’

তিনি বলেন, ‘রক্ত দিয়েছি, খুনিদের সঙ্গে কোনো আপোস নয়। খুনিদের সঙ্গে কোনো বৈঠক নয়, আলাপ নয়। আমাদের আলাপ পরিষ্কার। দফা এক, দাবি এক- শেখ হাসিনার পদত্যাগ।’

রাফি বলেন, “এটা সাধারণ জনগণের আন্দোলন। জনগণ যা বলবে তাই হবে। জনগণ কি চায়? আপনারা যা চান আমরাও তা চাই। আজ চট্টগ্রামের ভাষায় বলতে চাই- ‘বউত দিন হাইয়্যু আর ন হাইয়্যু’ অর্থাৎ অনেকদিন খেয়েছো আর খেয়ো না। আগামীকাল (রোববার) দুপুর দুইটায় আবার নিউ মার্কেট মোড়ে আপনারা সবাই চলে আসনে। আমরা জানি আমরা, সত্যের জয় সুনিশ্চিত।”

বিকেল ৫টার দিকে আন্দোলনকারীরা দুই ভাগ হয়ে এক অংশ সিনেমা প্যালেস হয়ে চকবাজার মিছিল নিয়ে যায়। আরেক অংশ মিছিল নিয়ে টাইগারপাস এলাকায় গিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এ সময় আন্দোলনকারীরা টাইগারপাসে অবস্থিত ট্রাফিক পুলিশের বক্স ভাঙচুর করেন। সাড়ে ৬টার দিকে বিক্ষোভ কর্মসূচি সমাপ্তির ঘোষণা দেন সমন্বকারীরা।

এরপর আন্দোলনকারীদের একটি অংশ টাইগারপাস থেকে আগ্রাবাদ ও আরেকটি অংশ মিছিল নিয়ে বহদ্দারহাটের উদ্দেশে রওনা দেন। এ সময় মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে আন্দোলনকারীরা নগরীর ওয়াসায় চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর কার্যালয়, দুই নম্বর গেইটে প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এরপর তারা যার যার মতো চলে যান।

এদিকে, হামলার দায়ভার ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নেবে না বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাসেল আহমেদ। রাসেল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমরা বিকেল ৩টায় নিউমার্কেট মোড়ে অবস্থান নিই। দুই ঘণ্টা অবস্থান নিয়ে আমরা টাইগারপাসে মিছিল করে যাই। সেখান থেকেই আমি কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করি। কর্মসূচির পর যদি কোথাও হামলা বা ভাঙচুর হয়ে থাকে তাহলে সেটার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বহদ্দারহাট ও ওয়াসায় ঝামেলা হয়েছে বলে শুনেছি। এর সঙ্গে সাধারণ ছাত্ররা জড়িত নন।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম দিন থেকেই কিছু দুষ্কৃতিকারী আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে বানচাল করার পাঁয়তারা করছে। যদি কোথাও কোনো হামলা হয়ে থাকে আমরা এর দায়ভার নেব না।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন