বিজ্ঞাপন

ফের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারে’র পথে বাংলাদেশ

August 7, 2024 | 3:27 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নিজ পদে বহাল থাকলেও তিনি নির্বাহী বিভাগের প্রধান নন বলে নির্বাহী বিভাগ বর্তমানে নেতৃত্বহীন। ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এরই মধ্যে ‘অন্তর্বর্তী সরকারে’র রূপরেখা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ও জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের। সেই সরকার ঘোষণা হবে শিগগিরই।

বিজ্ঞাপন

গত সোমবার (৫ আগস্ট) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ভোরের দিকে আন্দোলনের সমন্বয়করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেন। এ দিন সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বঙ্গভবনে আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক হয় রাষ্ট্রপতির। বৈঠকে সমন্বয়করা অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে তাদের প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীরা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে বৈঠকেই ড. ইউনূসের নাম চূড়ান্ত হয়েছে। এই সরকারের সদস্য হিসেবে বাকি যাদের নাম তারা প্রস্তাব করেছেন, তাদেরও সরকারে রাখা হবে বলে নিশ্চয়তা তারা পেয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এসব নাম চূড়ান্ত করা হবে। আজ বুধবারের (৭ আগস্ট) মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা হতে পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল তথা একটি সরকার দায়িত্বভার ছেড়ে দেওয়ার পর আরেকটি সরকার নির্বাচনের জন্য ১৯৯০ সালে প্রবর্তন করা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে গঠন করা হলেও এটি অনির্বাচিত একটি সরকার, যাদের প্রধান কাজ যত দ্রুতসম্ভব নতুন একটি সরকার নির্বাচিত করার জন্য নির্বাচন পরিচালনা করা। পাশাপাশি নীতি-নির্ধারণী কার্যক্রম থেকে বিরত থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করাও এই সরকারের কাজ।

বিজ্ঞাপন

দেশের ইতিহাসে চারটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছয়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয়ের ঘটনাও ঘটেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব থাকলেও ২০০৬ সাল পরবর্তী সময়ে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দুই বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করতেও দেখা গেছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। সেই বিধান অনুযায়ী ১৯৯০ সালের পর ১৯৯৬ সাল, ২০০১ সাল ও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল। পরে ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট এক সংক্ষিপ্ত রায়ে শর্তসাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। পরে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়।

সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে শান্তিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলেও পর্যবেক্ষণ জানান। এর ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার বিষয়ে সংসদের অনুমতির শর্ত জুড়ে দেন।

বিজ্ঞাপন

বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, ওই সময় কোনো ধরনের রাজনৈতিক মতৈক্য ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিল। ঘটনাপ্রবাহ যেমনই হোক, দেশের সংবিধানে দুটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের মধ্যবর্তী সময়ে অনির্বাচিত সরকার গঠনের কোনো বিধান বর্তমানে নেই।

এবারে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদ পূর্ণ করে দায়িত্ব পালনের পর চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের সাত মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সরকার কোনো রূপরেখাও দিয়ে যেতে পারেনি। তবে যে ছাত্র আন্দোলনের জের ধরে সরকার পদত্যাগ করেছে, তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে তাদেরই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বলা হলেও এটি কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার কারণেই সম্ভবত একে অন্তর্বর্তী সরকার বলা হচ্ছে। তবে প্রকৃতিগত দিক থেকে এ দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সবার মতামতের ভিত্তিতে এ রকম একটি সরকার গঠনেরও কোনো বিকল্প নেই।

তবে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে পারেন। এরপর অন্তর্বতী সরকার নির্বাচন আয়োজন করলে সেই নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে, তারা সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ভূতাপেক্ষভাবে বৈধতা দিতে পারে। ১৯৯০ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও একইভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলাম সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের বর্তমান সংবিধানে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন ছাড়া ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কোনো বিধান নেই। কিন্তু দেশে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো সুষ্ঠু বিকল্পও নেই। ফলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে পারেন। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে এই সরকারকে বৈধতা দেবেন।

কেবল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নয়, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন ছাড়াও বিকল্প কোনো ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সংবিধানে সংযোজনের প্রয়োজনীয়তার কথাও জানান ব্যারিস্টার শফিকুল। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যতদিন পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মতো পারস্পরিক আস্থা অর্জন না করবে, অন্তত ততদিন পর্যন্ত বিকল্প কোনো ব্যবস্থা সংবিধানে থাকা প্রয়োজন। সংবিধানে তেমন সুনির্দিষ্ট পরিকাঠামো থাকলে তখন যেকোনো পরিস্থিতিতেই ক্ষমতা হস্তান্তর সহজ হবে।

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন