বিজ্ঞাপন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি গুজব নাকি মুক্ত বেতার!

August 9, 2024 | 7:25 pm

সুমন বৈদ্য

বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মুহুর্তের খবর যেনো হাতের মুঠোয়। বলা চলে সিটিজেন জার্নালিজম। বাইরের দেশের সাথে সহজেই যোগাযোগ করার অন্যতম মাধ্যম বলা হয়ে থাকে সামাজিক মাধ্যমকে।

বিজ্ঞাপন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি ফেইসবুক, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার ইত্যাদি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যোগাযোগের এখন নানা ধরনের পরিবর্তন এনেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। ব্লগিং, ডকুমেন্টরী ভিডিও, শর্ট রিলস, বিভিন্ন বিষয়ের উপর টিউটোরিয়াল ভিডিও, সবকিছুতেই নানা ধরনের পরিবর্তন‌। এখানেই শেষ নয় চিকিৎসা থেকে শুরু করে শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছুতেই এখন সামাজিক মাধ্যম এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নতুন থেকে পুরাতন সব প্রজন্মের জন্য মুক্ত বেতার ও বলা চলে।

কিন্তু সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যদি হয় গলার কাঁটা তাহলে সেই প্রশ্নের উত্তর কি আশা করা যায়!

বর্তমান সময়ে সামাজিক মাধ্যম যেমন আমাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে যেমন সাহায্য করছে ঠিক তেমনি মুদ্রার এপিঠ ও দেখিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার অনেকটায় গুজবের কাছে শিকল বন্ধী। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে কিছু অসুদপায় অবলম্বনকারী চক্র বিভ্রান্তীমূলক পোষ্ট শেয়ার করে। বিশেষ করে তাদের আর্কষনের মূল কেন্দ্রবিন্দু থাকে সাধারণ জনতা।

বিজ্ঞাপন

এই বিভ্রান্তিমূলক পোষ্ট শেয়ারের মাধ্যমে অনেক ব্যবহারকারীগণ পোষ্টের মূল বিষয়বস্তু যাচাই-বাছাই না করেই রিপোস্ট এবং শেয়ার করতে থাকেন। ফলে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয় পুরো জাতিকে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজবের কারণে বিভিন্নভাবে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং ধর্মের বিভিন্ন রকম ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেহেতু গুজব চক্রের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সাধারণ মানুষ, তাই তারা বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ভাঙ্গিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে হেয়- প্রতিপন্নের শিকার করা হয়‌।

যদিও বর্তমান প্রেক্ষিতে সেটি রুপ নিয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলার পোষ্ট শেয়ারে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে গুজব ছড়িয়ে থাকেন। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

বিজ্ঞাপন

কোনো একটা ‘ধর্ম অবমাননার’ ঘটনা ‘বানিয়ে’ বা ‘সাজিয়ে’ ফেইসবুকে ছেড়ে দেওয়া। তারপর সেই পোস্ট হতে থাকে হাজার হাজার লাখ লাখ শেয়ার। সেই শেয়ার থেকেই শত শত হাজার হাজার মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে নেমে পড়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে। এর আগেও সামাজিক মাধ্যমকে একাধিকবার কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলার দেখা দিয়েছে। তার বেশিরভাগই প্রভাব পড়েছে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা।

বিজয় উল্লাসটা মন্দির, প্রতিমা ভেঙেই শুরু করলেন? এটাই তাহলে বিজয়?’ এমন ক্যাপশনে দেবী দুর্গার মস্তকহীন একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় হট্টগোল লেগে যায় সাধারণ জনতার মাঝে। পরবর্তীতে তা সত্যতা যাচাই বাছাই করে বেরিয়ে আসে ছবিটি ২০২২ সালের ৩০শে জানুয়ারি দ্যা ডেইলি স্টার পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবি।

উদাহরণ হিসেবে একটু পুরনো দিনে চোখ বুলানো যাক।২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার উৎস ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেইসবুক’। ওই ঘটনায় দেখা যায়, রামুতে উত্তম বড়ুয়ার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে পবিত্র কোরআন অবমাননার একটি ছবি কেউ ট্যাগ করে দেয়। ঘটনার ফলপ্রসূতে দেখা যায়, উত্তম বড়ুয়ার স্বেচ্ছায় কোনো পোষ্ট দেয়নি, বরং তাকে ট্যাগ করাকে কেন্দ্র করেই গুজবের সৃষ্টি। আর এই পোস্টকে কেন্দ্র করে রামুতে বৌদ্ধমন্দির জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলার নতুন অভিনব পন্থা চালু হয়। এর ঠিক ৫ বছর পর, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজ নামের এক কৈর্বত সন্তানের ধর্ম অবমাননার একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ভাঙচুর, তাণ্ডব চালানো হয় হিন্দু পল্লীতে।

এর ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে কুমিল্লায় একটি ‘পূজামণ্ডপে কোরআন শরীফ রাখা’র ঘটনা ‘ঘটিয়ে’ ও ফেইসবুকে তা ‘রটিয়ে’ অবিশ্বাস্য সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ। যার প্রভাব চাঁদপুরসহ দেশের একাধিক স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলায় শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একাধিক মানুষ।

বিজ্ঞাপন

গুজবের কর্মকাণ্ড এখানেই থেমে নেই। বর্তমান কোটা আন্দোলনকে ঘিরেও হয়েছে গুজবচক্রের তান্ডবলীলা। কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বিমানবন্দর বন্ধের ঘোষণা। সেখানে দেখা যায়, আগামী ৭২ ঘণ্টার জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।সেই সাথে সূত্র হিসেবে সময় টেলিভিশনের নাম অবাধে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে সময় টেলিভিশন এবং শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষও এমন কোনো ঘোষণা দেননি বলে বিবৃতি দেন। ফলসূতিতে তা গুজব হিসেবে প্রমাণিত হয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সোমবার (১৫ জুলাই) ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের সময় এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন বলে খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ওই শিক্ষার্থীর ছবিও দেয়া হয়। ছবির ওই শিক্ষার্থীর নাম ইব্রাহীম নীরব। কিন্তু বরাবরের মতোন এই খবরটিও গুজব বলে প্রমাণিত হয়।

এছাড়াও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় অবস্থান করে মিছিল ও স্লোগান দেয় শিক্ষার্থীরা। তারা রাত আনুমানিক ৯টার দিকে শাহবাগ ত্যাগ করে। এরপরেই গুজবের খবর চাউর হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফুটে আসে, শিক্ষার্থীরা শাহবাগ ও টিএসসিতে অবস্থান করছেন। সরকারের পদত্যাগের পর তারা ঘরে ফিরবে’। এমন পোস্ট দেখার পর রাত ৩টার দিকে শাহবাগ ও টিএসসিতে গিয়ে কোনো জমায়েত দেখা যায়নি।

কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আরো একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে ও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতার ফেসবুক আইডিতে কয়েকটি এক হাজার টাকার বান্ডিলের ছবি পোস্ট করা হয়। সেখানে লেখা হয় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করা সার্জিসের বাসা থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করেছে র‍্যাব-১০। তবে যাচাই করে দেখা যায়, যে ছবিটি পোস্ট দেওয়া হয়েছে সেটি কয়েকদিন আগে এক তরুণী একটি গ্রুপে পোস্ট দেন। পোস্টে লেখা ছিল, ‘আব্বুর পেনশনের টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নিলাম।’এছাড়াও র‍্যাবও এমন কোনো অভিযানের কথা নিশ্চিত করেনি।

এখানেই শেষ নয় , গত ২২ দিনে অর্থাৎ ১৬ই জুলাই থেকে এ পর্যন্ত খবর উঠে এসেছে দেশে হিন্দি ভাষায় কথা বলা পুলিশ, বিজিবি, মিলিটারি নেমেছে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো সেই ঘটনার সত্যতার চিহ্ন কোনোদিকে প্রকাশ পায়নি।

গুজবের আড্ডাখানা এতোই বেড়েই গিয়েছে যে সংসদ ভবন এবং গণভবনে গণকবরের খবর প্রচার হয়।যা পরবর্তীতে লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে খবর পাওয়া যায়।

এরপর ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে যখন শোনা যায় ঢাকায় আক্রমণ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বিভাগ ‘র’। মূহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে যায় সাধারণ জণগণের মধ্যে, এতে উত্তাল হয়ে যায় সাধারণ জণগণ। অথচ ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ঢাকার বাড্ডা থানায় কিছু বিক্ষোভকারী আক্রমণ করে। নিজেদের বাঁচাতে অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যরা গুলিবর্ষণ করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শুধু যোগাযোগ থেকে শুরু করে বিনোদনের উপভোগ্য নয়, জ্ঞান আহরণের জায়গাও। সেইসাথে স্বাধীনভাবে মুক্ত বাক্য প্রকাশ করার জায়গাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

কিন্তু সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় গুজব এবং অপরাধের আড্ডাখানা। তাই এই গুজব ও অপরাধকান্ড ঠেকাতে হলে আমাদের শিক্ষিত তরুণ–তরুণীরা এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।সেই সাথে পোষ্টের যথাযথ সত্যতা যাচাই বাছাই বের করা এবং গুজবের পোস্ট দেখলেই সেটা নিয়ে স্ট্যাটাস না লিখে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করে দেয়া। এতে করে যখন অনেক মানুষ একসঙ্গে রিপোর্ট করবে তখন অটোমেটিকেলি ফেসবুক একটা ব্যবস্থা নেবে।পাশাপাশি প্রি ভাইরাল অ্যাওয়ারনেস এবং আইনগত ব্যবস্থা তৈরি করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন