বিজ্ঞাপন

মেট্রোরেল কর্মযজ্ঞে বদলে গেছে দিয়াবাড়ি

June 6, 2018 | 10:07 am

।। আসাদ জামান ও মেসবাহ শিমুল ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: উত্তরার দিয়াবাড়ির আশপাশে এখন এক কাঠা জমির দাম ছাড়িয়েছে কোটি টাকা। কিছুদিন আগেও যেখানে মানুষজনের তেমন আনাগোনা ছিল না, সেই জায়গাটিতে এখন দিনমান চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। চার থেকে পাঁচশ মানুষ পালাক্রমে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। এই কর্মযজ্ঞকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট পুঁজির বেশকিছু দোকানও। দিয়াবাড়ির এই আমূল বদলে যাওয়া দৃশ্যপটের নেপথ্যে রয়েছে রাজধানীবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রকল্প মেট্রোরেল।

উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এঁকেবেঁকে যাওয়া ১২ কিলোমিটার সড়কের ওপর নির্মাণাধীন মেট্রো রেলপথের প্রথম অংশের বিশাল কর্মযজ্ঞ সরেজমিনে দেখতে শনিবার (২ মে) বেলা ১২টায় গিয়ে হাজির দিয়াবাড়ি মূল ডিপো পয়েন্টে। জ্যৈষ্ঠের কাঠফাঁটা রোদে যেন ঝলসে যাচ্ছিল গায়ের চামড়া! লু-হাওয়ায় দিনে-দুপুরে চোখে জোনাকি পোকা দেখার উপক্রম।

কিন্তু তাতে কী, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প ‘ঢাকা র‌্যাপিড ট্রানজি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’র আওতাধীন মেট্রো রেলপথ নির্মাণে যারা যুক্ত রয়েছেন, তাদের এই চামড়া ঝলসানো রোদ বা লু হাওয়া গায়ে মাখার সময়ই নেই! মেট্রোরেল প্রকল্পের অবকাঠামো তৈরিতে তারা মহাব্যস্ত!

বিজ্ঞাপন

নতুন করে কাজে যোগ দিতে আসা কয়েকজন শ্রমিক মেট্টোরেলের মূল ডিপোর পাশে ছোট্ট সোনালু গাছের ছায়ায় বসে ছিলেন। শেরপুর থেকে আসা শ্রমজীবী এই মানুষগুলো এখনো কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাননি; অপেক্ষায় আছেন। মাসিক ১৩ হাজার টাকা বেতনে তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হবে— এমনটিই জেনেছেন তারা।

গ্রাম থেকে এসে কাজের অপেক্ষায় থাকা সাইফুল ইসলাম, মো. আলম মিয়া, মো. শাকিল হোসেন ও আব্দুস সালাম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন! তাদের চোখের সামনে ‘এইটথ জেনারেশনের’ অত্যাধুনিক মেশিন দিয়ে মেট্রোরেলের মূল ডিপোর পাইলিংয়ের কাজ করা হচ্ছে। এর আগে হয়তো এমন মেশিন তারা চোখেও দেখেননি। দু’দিন পর এই মেশিনেই কাজ করতে হবে তাদের!

বিজ্ঞাপন

কী ধরনের কাজের জন্য এসেছেন? আগে কি এ রকম কাজ করেছেন কখনো? মো. আলম মিয়ার সরল উত্তর— ‘আমরা মাঠে-ঘাটে কাজ করি। এলাকায় রাস্তা-ঘাট বানানোর সময় লেবারের কাজ করেছি। এখানে আমাদের লেবারের কাজের জন্য আনা হয়েছে।’

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এরকম প্রায় ৫শ শ্রমবীজী মানুষ উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেল ডিপো নির্মাণের কাজ করছেন। চীনের এক ঝাঁক প্রকৌশলী, বাংলাদেশ ও চীনের কয়েকশ’ দক্ষ নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে এ দেশের কয়েকশ’ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ দিন রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন নির্মাণাধীন এ মেট্রোরেল ডিপোতে। এদের যৌথ শ্রমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার মেট্রো রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হবে।

নির্মাণাধীন মেট্রোরেল ডিপোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে দায়িত্ব পালন করছিলেন গুডগার্ড সিকিউরিটি কোম্পানির ইসমাইল হোসেন। বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সাইফুলের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা মাছিও নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঢুকতে পারবে না! কেননা তার ওপরেও রয়েছে কন্ট্রোল রুমের শ্যেন দৃষ্টি।


সেখান থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বারবার আসছে কড়া নির্দেশ, “হ্যালো, ১ নম্বর গেট, হ্যালো হ্যালো। সেফটি হেলমেট, আইডি কার্ড, সেফটি বেল্ট ও পোশাক ছাড়া কেউ যেন ভেতরে না ঢোকে।’ ‘জ্বি স্যার, কেউ ঢুকবে না, এদিক দিয়ে কাউকেই ঢুকতে দেবো না।”

বিজ্ঞাপন

কঠোর-কঠিন দায়িত্ব পালনের মধ্যেও সদালাপী ইসমাইল হোসেন কথা বলেন সারাবাংলার সঙ্গে। তিনি জানান, দিয়াবাড়ি মেট্রোরেলের মূল ডিপো নির্মাণে দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলে। চার থেকে পাঁচশ’ শ্রমিক পালাক্রমে কাজ করেন। বিদেশি যন্ত্রপাতি আর প্রকৌশলীদের দিক-নির্দেশনায় চলে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ। আর এটি তত্ত্বাবধান করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

এদিকে, মেট্রো রেলপথ ও মূল ডিপো নির্মাণের আগেই ঘুরে গেছে দিয়াবাড়ি এলকায় বসবাসরত মানুষের ভাগ্যের চাকা। স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষ করে যারা পৈত্রিক সম্পত্তির মালিক, তাদের তো পোয়াবারো। তাদের হাজার টাকার জমির দাম এখন কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেট্রোরেলের মূল ডিপোরে আশপাশের জমি ২০১২ সালের আগে বিক্রি হয়েছে ১০ হাজার টাকা কাঠা। মেট্রোরেলের কাজ শুরুর পর জমির দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এখন প্রতি কাঠা জমি বিক্রি হচ্ছে ১ কোটি ১৫ হাজার টাকা করে। রেলপথের আশপাশে মার্কেট, হোটেল, আবাসিক ও করপোরেট ভবন নির্মাণের জন্য ব্যক্তি ও বড় বড় প্রতিষ্ঠান জমি কেনার জন্য পিঁপড়ার মতো লাইন দিচ্ছে।

কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মনির মিয়ার সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জন্ম থেকেই আমি এখানকার বাসিন্দা। কয়েক বছরের ব্যবধানে চোখের সামনে সব বদলে যেতে দেখলাম। মেট্রোরেলের জন্য মাটি ফেলার আগে এখানে প্রতি কাঠা জমি বিক্রি হয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকায়। এখন ১ কোটি ১৫ লাখ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে এক কাঠা জমি।’

শুধু জমির দাম নয়, সুযোগ তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থানেরও। মেট্রোরেলের বিশাল কর্মযজ্ঞকে কেন্দ্র করে ছোট পুঁজির মানুষেরা দিয়াবাড়ি মেট্রোরেল ডিপোর আশপাশে ছোট ছোট দোকান দিয়ে বসেছেন। বিক্রিও হচ্ছে বেশ। নারী-পুরুষ উভয়-ই এ কাজে যুক্ত হয়েছেন।

রাজধানীবাসীর যানজটের যন্ত্রণা দূর করার সর্বশেষ প্রচেষ্টার অংশ এই মেট্রোরেল প্রকল্প। মাস দুই আগে রাজধানী ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়। উত্তরার দিয়াবাড়িতে দু’টি পিলারকে সংযুক্ত করে এ স্প্যানটি। আগারগাঁওয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে আরেকটি পিলার। নির্দিষ্ট দূরত্বে অন্য পিলারটি তৈরি হলেই বসানো হবে দ্বিতীয় স্প্যানটি।

বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেলের প্রথম অংশের ১২ কিলোমিটারে প্রথম স্প্যানটি দিয়াবাড়ি, আর শেষ স্প্যানটি বসবে আগারগাঁওয়ে। মাঝে বসবে আরো প্রায় ৪৬০টি স্প্যান। সেই স্প্যানগুলোকে মজবুত গাঁথুনির ওপর বসাতে এখন চলছে পাইলিং ও পিলার তৈরির কাজ। আর স্প্যান তৈরির কাজ চলছে আশুয়িলার বিড়ুলিয়া-পঞ্চবটির মাঝে স্থাপিত কারখানায়।

সারাবাংলা/এজেড/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন