বিজ্ঞাপন

সৌদি ফেরত গৃহকর্মী: কান্নার দমকে থমকে গেল সব

June 12, 2018 | 11:29 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘এসব নারীরা সৌদি আরবে খাবার পায় না, শারীরিক নির্যাতনের শিকার, যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। যারা বলেন, দেশ ফিরে এসব নারীরা মিথ্যা বা বানিয়ে বলছে, তারা এসব ছবি দেখুক, মেয়েদের জবাব দিক।’

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন পুরো রুমজুড়ে কান্নার শব্দ। সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা ২২ নারীর কেউ সামলাতে পারেন না নিজেকে। চেয়ারে বসেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন পাশবিক নির্যাতনের কথা। আরো বলেন দেশে ফিরেও সমাজ তো বটেই, পরিবারেও নিগৃহী-অপমানিত হওয়ার কথা। তাদের কান্নার দমকে যেন থমকে যায় সময়, কেবলই সত্য হয়ে রয় অমানবিক নির্যাতনের শিকার কিছু মানুষের বেদনা।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (১১ জুন) বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এবং লেদার-গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকর্চারস অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) যৌথ উদ্যোগে সৌদি ফেরত নারীদের সহায়তা কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানেই তৈরি হয় এই বেদনাবিধুর পরিবেশ।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ব্র্যাক ফেরত আসা নারীদের জরুরি সহযোগিতা দিচ্ছে। কিন্তু তাদের জন্য জরুরিভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।

বক্তারা বলেন, এই মানুষগুলো যখন রেমিটেন্স (বৈদেশিক মুদ্রা) পাঠায় তখন সবাই স্বাগত জানায়। কিন্তু তারাই যখন বিপদে পড়েন, দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন; তখন স্বামী, পরিবারের অন্যান্য সদস্য তো বটেই, তাদের বাবা-মা-ও তাদের সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। অথচ খাবার না পেয়ে, শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসার পর তাদের সমর্থনই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে শরিফুল হাসান বলেন, দেশে ফিরে আসার পর তাদের কারও খাওয়ার টাকা থাকে না, বাড়িতে পৌঁছানোর টাকা থাকে না। তাদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। তাদের একেকজনের বর্ণনা শুনলে বা দেখলে রাতে ঘুমানো যায় না। আমরা শুধু চাই, এ দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে আমাদের মেয়েরা মুক্তি পাক। তাদের প্রাথমিকভাবে কিছু সাহায্য করছে ব্র্যাক। কিন্তু এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমরা চাই না, আমাদের একটি মেয়েও দেশের বাইরে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হোক।

ফিলিপাইন বা ইন্দোনেশিয়া থেকে সৌদি আরবে মেয়েদের পাঠানো না হলেও আমাদের মেয়েদের পাঠানো হচ্ছে উল্লেখ করে শরিফুল হাসান বলেন, আমরা তো ১০ লাখ রোহিঙ্গার দায়িত্ব নিতে পারি। সাত লাখ মেয়ে বিদেশে না গেলে কি তাদের দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না? যেসব মেয়েরা নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসছেন, তারা আমাদেরই মেয়ে এবং তাদের দায়িত্ব এই রাষ্ট্রের। অথচ আমাদের মন্ত্রী-সচিবরা সৌদি আরবের সুরে কথা বলেন! তারা বলেন নির্যাতন হচ্ছে না, হলেও সংখ্যায় কম। অথচ বাংলাদেশের একটি মেয়ে নির্যাতিত হলেও তাদের বলার কথা— সৌদি আরব এ অত্যাচার বন্ধ করো।

তিনি আরো বলেন, ২০১৫ সালে সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানোর জন্য সমঝোতা করল। কিন্তু এর পরিণতি কী, সেটা এই নারীদের কাছে শুনতে হবে। এই মানুষগুলো অত্যন্ত দরিদ্র, তাদের জন্য কেউ নেই। কিন্তু এই মানুষগুলোকে সহায়তা করতে হবে, ব্র্যাক মাইগ্রেশন তাদের পাশে থাকবে। আমদের মেয়েরা নির্যাতিত হলে, গর্ভবতী হলে তাদের কিছু যায়-আসে না। সৌদি আরব কী করবে, সৌদি আরব রাগ করবে— সবসময় এই চিন্তু কাজ করে তাদের মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

২০১৫ সালের সেই সমঝোতা পর্যালোচনার মাধ্যমে মেয়েরা যে পেশাতেই সৌদি আরবে যাক না কেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন শরিফুল।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৫ জন নারী কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালের সমঝোতার পরই সৌদি আরবে দুই লাখেরও বেশি নারী গিয়েছেন। তবে এ পর্যন্ত চাকরি শেষ করে বা প্রতারণার শিকার হয়ে কতজন নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই।

তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের বরাত দিয়ে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গত তিন বছরে সৌদি আরব থেকে প্রায় পাঁচ হাজার নারী ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত এক হাজার নারী ফিরেছেন চলতি বছরেই। আর এ বছরের মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত সৌদি আরবের রিয়াদ ইমিগ্রেশন ক্যাম্প থেকেই দেশে ফিরেছেন ৩৬০ জন নারী কর্মী।

এসব নারী কর্মীদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম থেকে ১২৫ জনের জন্য লিখিত আবেদন করা হয় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে ৯০ জন কর্মী দেশে ফিরেছেন এবং বাকিরা অপেক্ষায় রয়েছেন দেশে ফেরার।

অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের পরিচালক ( অ্যাডভোকেসি ফর সোস্যাল চেঞ্জ, টেকনোলজি অ্যান্ড পার্টনারশিপ স্ট্রেংদেনিং ইউনিট) কে এম মোরশেদ বলেন, ‘আমরা এখন আর অতি দরিদ্র দেশ নই, মধ্য আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি। সেই দেশের মানুষকে কোনো দেশ অবজ্ঞা করবে, নির্যাতন-অত্যাচার করবে, নিগৃহ করবে— এটা হতে পারে না।  এটা সাংঘাতিক অন্যায় এবং এ অবস্থা চলতে পারে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্র্যাকের সঙ্গে বাংলাদেশ লেদার ‍গ্রুপ অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে এবং অন্যরাও আসবেন। কিন্তু সরকার, বিশেষ করে এ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়কে ফেরত আসা নারীদের বিষয়ে তার অবস্থান আরো স্পষ্ট করতে হবে।’

ঝুঁকি আছে জেনেও এখনও সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য আমাদের নারীদের লাইন ধরতে হচ্ছে কেন, সেটাও খতিয়ে দেখার দরকার বলে মন্তব্য করেন কে এম মোরশেদ। তিনি বলেন, ‘তারা নিজের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে দেখিয়েছেন, তারা ভুল করেছিলেন। সে কথা বলার পরও আরো অনেককেই সেই একই ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। এটা কেন নিতে হচ্ছে, তা ভেবে দেখা দরকার।’

অনুষ্ঠানে লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুসফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, ‘এসব নারীদের বিষয়ে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। এই কর্মীরা এখন সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে যাবে না, দেশেই তাদের জন্য সম্মানজনক কাজ দেওয়া হবে।’ বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে দেশে ফিরে আসা সব নারীদের জন্যই সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সায়ফুল ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনীতির তিন-চতুর্থাংশ পরিচালিত হয় বেসরকারি খাতে। তাই আসুন এসব নারীদের জন্য আমরা বেসরকারি খাত থেকেই কিছু করি। তখন হয়তো সরকারও মনে করবে, আমরা কিছু করতে পারলে তারাও কিছু করতে পারবে। তবে আমি শুধু সরকারকে বলব, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে আমাদের বোন-মেয়েদের পাঠাবেন না।

অনুষ্ঠানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, মানুষ পণ্য নয়। প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। নারী কর্মীদের পাঠানোর আগে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে সৌদি ফেরত নারীদের পুনরায় একত্র করতে ব্র্যাক ও এলএফএমইএবির মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন