বিজ্ঞাপন

১৩৯ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন ১৮৫

November 27, 2017 | 2:40 pm

সারাবাংলা প্রতিবেদক

বিজ্ঞাপন

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন আদালত। আর এ মামলায় খালাস পেয়েছেন ৪৫ জন।

দুই দিনব্যাপী দীর্ঘ রায়ে গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিশেষ বেঞ্চ এ ঘোষণা দেন। বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

পিলখানার ঘটনাটিকে কলঙ্কজনক উল্লেখ করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে আদালত সাত দফা সুপারিশ দিয়েছেন। আদালত রায়ে নিম্ন আদালতের মৃত্যুদ-ের আদেশ পাওয়া ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসি বহাল রাখেন। বাকি ৮ জনকে যাবজ্জীবন, ৪ জনকে খালাস এবং বিচার চলাকালীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়।

বিজ্ঞাপন

নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। ১২ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে এবং আসামিদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়া ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছিলেন নিম্ন আদালত। তাদের মধ্যে ১৮২ জনকে ১০ বছরের কারাদ-, আট জনকে সাত বছরের কারাদ-, চারজনকে তিন বছরের কারাদ- দিয়েছেন হাইকোর্ট। আর এর মধ্যে খালাস দেওয়া হয়েছে ২৯ জনকে।

এ মামলায় নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া যে ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছিল, তাদের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে হাইকোর্ট। এর মধ্যে চারজনকে সাত বছর করে কারাদ- এবং ৩৪ জনের খালাসের রায় বহাল রেখেন হাইকোর্ট।

আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচারপ্রক্রিয়ার দুটি ধাপ শেষ হলো। এরপরের ধাপ হিসেবে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

বিজ্ঞাপন

রায়ের পরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘২০০৯ সালের ২৫ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পিলখানায় যে নৃশংস হত্যাকা- হয়েছিল। তার বিচার হয়েছিল ঢাকার সেশন জজ আদালতে।

আদালত মোট ১৫২ জনকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছিলেন। এই দণ্ড প্রদানের পরে সেশন কোর্ট থেকে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে আসে। এ মামলাটি শুনানির জন্য তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়। ৩৭০ কার্য দিবস এ মামলার শুনানি হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে আজকে এ রায় দেওয়া শেষ হয়। রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদ- বহাল রাখেন হাইকোর্ট।

এছাড়া ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন আদালত। আর এ মামলায় খালাস পেয়েছেন ৪৫ জন।

এ রায়ের পর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত কোনো আসামি যদি আপিল করে তাহলে আপিলটি শুনানি করতে হবে। তবে হাইকোর্টের রায়ের পর ফাঁসির আদেশ সংক্রান্ত ডেথ ওয়ারেন্ট জেলখানায় যাবে। এরমধ্যেই আসামিরা যদি আপিল ফাইল করে তাহলে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি সেখানেই বন্ধ হয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এমন রায় হবে এটা আমরা প্রত্যাশা করিনি। আজকের রায়ে ন্যায়বিচার হয়েছে বলে মানতে পারছি না।
তিনি বলেন, এ মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি সাক্ষী অথবা কোনো সাক্ষী ছাড়া যে রায় নিম্ন আদালত দিয়েছিল হাইকোর্টে তা-ই বহাল রাখা হয়েছে।

আপিল করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পরে আমি আমার ক্লায়েন্টদের উপদেশ দেব তারা যেন আপিল দায়ের করেন। নিশ্চয় তারা সেখানে ন্যায়বিচার পাবেন।’

এ রায়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে স্বামী খালাস পাওয়ায় খুশি হয়েছেন নায়েক সুবেদার মো. আলীর স্ত্রী। তিনি বলেন, এত দিন ধরে সামাজিকভাবেও আমরা অনেক কষ্টে ছিলাম। অনেক কষ্ট করেছি। এ সময় তিনি আনন্দে কেদেঁ ফেলেন। পাশাপাশি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের আব্দুস সালামও খালাস পেয়েছেন। এজন্য তার পরিববারও বেজায় খুশি। এদিকে রায়ে দণ্ড প্রদানের আগে পর্যবেক্ষণে সাতটি সুপারিশ করেছেন আদালত। সুপারিশে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় তথ্য দিতে গোয়েন্দারা কেন ব্যর্থ হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আদালত।

সাত দফা সুপারিশে বলা হয়, এক. অপারেশ ডাল ভাত কর্মসূচিতে বিডিআরের মত এ ধরনের ফোর্সকে যুক্ত করা উচিত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ জাতীয় কর্মসূচিতে যেন নেওয়া না হয়।
দুই. বিজিবি আইন অনুযায়ী বাহিনীতে সৈনিক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব বজায় রাখা উচিত। এ জন্য সময় সময় অভ্যন্তরীণ মতবিনিয়ের আয়োজন করা যেতে পারে।
তিন. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি দাওয়া পাঠানো হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা নিরসন করা হয়নি। তাই ভবিষ্যতে দাবি দাওয়া থাকলে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
চার. বাহিনীর সদস্যদের কোন সমস্যা থাকলে তা বিজিবির ডিজি সমাধান করবে।
পাচঁ. যদি তাদের কোন পাওনা থাকে সেটিও দ্রুত সমাধান করতে হবে।
ছয়. যে কোন সমস্যার দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে।
সাত. বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার আগাম তথ্য দিতে গোয়েন্দারা কেন ব্যর্থ হয়েছে সেটিও খুঁজে বের করা উচিত বলেও আদালত মতামত দিয়েছেন।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ঘটে যায় এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। পরে এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়। মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা হয় ৮৪৬ বিডিআর জওয়ানকে। মামলার অন্য চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যান। আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা।

পরে এ মামলার দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বর এ মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুঁিলয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয় ১৬ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরও ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন আসামি। সাজা হয় মোট ৫৬৮ জনের।

পরে এ মামলার ডেথ রেফারেন্স হিসেবে এবং আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে। হাইকোর্টের দীর্ঘ শুনানি শেষে চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল সকল আসামির ডেথ রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপিলের ওপর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়েছিল। এ মামলার আপিল শুনানির জন্য সুপ্রিমকোর্টেও বিশেষ ব্যবস্থায় সর্বমোট ৩৭ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। এজন্য মোট ১২লাখ ৯৫ হাজার পৃষ্ঠার ৩৫ কপি ও অতিরিক্ত দুই কপি পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। মামলাটি শুনানি করতে প্রধান বিচারপতি তিন বিচারপতির সমন্বয় একটি বিশেষ বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন।

রায় ঘোষণাকালে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কেএম জাহিদ সরওয়ার কাজলসহ আসামিপক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

এজেডকে/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন