বিজ্ঞাপন

প্রজন্ম-৭১ থেকে সরে আসার হুমকি ছিল সুমন জাহিদের ওপর!

June 20, 2018 | 9:28 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: বসার ঘরে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল বড় বাঁধাই করে রাখা ছবিতে। সাদাকালো হলেও বড় জীবন্ত, বড় রঙিন সে ছবি। ছবিতে কাজলটানা চোখে তাকিয়ে আছেন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। উল্টোদিকেই একটি রঙিন কিন্তু পুরনো একটি ছবি— প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদর করছেন একটি শিশুকে, মনোযোগ দিয়ে শুনছেন শিশুটির কথা।

ড্রয়িং রুমের সামনের অংশে বাঁধাই করা আরো কিছু ছবি টাঙানো। এর মধ্যে একটি ছবিতে সেলিনা পারভীন, মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. শামসুদ্দিন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জহির রায়হান, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ও জ্যেতির্ময় গুহ ঠাকুরতার হাতে আঁকা ছবি। ছবিটির ওপরের দিকে লেখা— ‘আমরা তোমাদের ভুলেব না’। এর ঠিক ওপরেই আরেকটি সাদাকালো ছবি— বধ্যভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ, তাতে লাল অক্ষরে লেখা ‘Does Bangladesh speak what you want to say?’ (তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?)। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ৭১-এর নাম ছবির নিচে।

আরেকটি ছবিতে বায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের লাশের পাশে গোলাম আযমসহ কয়েকজনের ছবি; নিচে লেখা— ‘এরাই খুন করছে, এদের ক্ষমা নাই, রক্ষা নাই’। আরেকটি ছবিতে লেখা— ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’।

বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিহত বুদ্ধিজীবী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে এসব ছবি দিয়েই সাজিয়ে তোলা ঘরটি সুমন জাহিদের, তিনি শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে।

গত ১৪ জুন মারা যান সুমন জাহিদ। খিলগাঁও বাগিচা এলাকায় রেল লাইনের পাশ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় তার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন ছিল।

বিজ্ঞাপন

মৃতদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ বলেছে, ট্রেনে কাটা পড়েছেন সুমন জাহিদ। মৃতদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকও বলেন, মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন ছিল। গালে-নাকে-পিঠে আঘাতের চিহ্ন আছে। প্রথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন তিনি।

তবে পুলিশ ও চিকিৎসকের এমন মন্তব্য মানতে নারাজ সুমন জাহিদের পরিবার ও স্বজনরা।

মঙ্গলবার (১৮ জুন) সুমন জাহিদের উত্তর শাহজাহানপুরের বাসায় কথা হয় তার পরিবারের সদস্যদের সাথে। স্ত্রী অসুস্থ, কিশোর দুই ছেলে যেন বোবা হয়ে গেছে, মেয়ে-জামাইয়ের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে কথা হারাচ্ছেন শাশুড়ি। তারা বলছেন, সুমন জাহিদ এমন অসচেতন ছিলেন না যে ট্রেনে কাটা পড়বেন; আবার হতাশা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতো মানুষও তিনি নন।

উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী ছিলেন সুমন জাহিদ। এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই পলাতক আসামি চৌধুরী মঈনুদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও হত্যার ঘটনায় চৌধুরী মঈনুদ্দিন জড়িত ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

সুমন জাহিদের স্ত্রী কাজী দ্রাকসিন্দা জেবিন সারাবাংলা’কে বলেন, ‘এই সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকেই আমরা উৎকণ্ঠা আর নিরাপত্তাহীনতা ভুগতাম। উনি (সুমন জাহিদ) নিজেও প্রচণ্ড নীরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। সব হয়তো বলতেন না, কিন্তু বুঝতে পারতাম। বাচ্চারা বাইরে থাকলেও খুব টেনশন করতেন।’

দ্রাকসিন্দা জানান, বারবার হুমকি দেওয়া হয়েছে সুমন জাহিদকে। বিশেষ করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের সংগঠন ‘প্রজন্ম ৭১’ থেকে সরে যাওয়ার জন্য প্রচুর হুমকি পেয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার পর এসব হুমকি আরো বেড়ে যায়। সে এক জীবন ছিল আমাদের। তবে তাতে দমে যাওয়ার মানুষ সুমন ছিল না। সে আত্মহত্যা বা অসেচতন ছিল, এটা আমি কিংবা আমরা যারা তাকে চিনি, কেউ বিশ্বাস করবে না।’ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া ও তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণেই সুমনকে হত্যা করা হয়েছে— বলেন দ্রাকসিন্দা।

তিনি বলেন, ‘যারা বলছেন, বিভিন্ন হতাশা থেকে সুমন আত্যহত্মা করতে পারে তাদের বলছি— মাকে চোখের সামনে থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সুমনের পুরো জীবন হতাশায় নিমজ্জিত ছিল। সুমন মামার বাসায় থেকে লেখাপড়া করেছে, একটা সিঙ্গারা খেয়ে পুরো দিন কাটিয়েছে। সেই সুমনের কাছে হতাশায় আত্মহত্যা করেছে— সুমনকে যারা চেনেন, তারা এটা কখনোই বলবেন না।’

খরচ জোগাতে সুমন একসময় সিএনজি চালিয়েছেন। নটরডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে কঠিন অসুখে আক্রান্ত হয়ে টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারেননি। চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাস করবে— অধ্যক্ষের কাছে এমন লিখিত আবেদন জমা দিয়ে তিনি এইচএসসিতে অংশ নেন। এমন নানা ধরনের ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আসা একজন মানুষের কাছে আর বড় হতাশা কী থাকতে পারে, প্রশ্ন রাখেন দ্রাকসিন্দা জেবিন।

কথা বলার চেষ্টা করি সুমন জাহিদের দুই সন্তানের সাথে। কিন্তু বাবাকে হারিয়ে তারা যেন প্রায় পাথর। পাশে থাকা তাদের নানি বললেন, মায়ের আদর্শকেই নিজেদের জীবনের আদর্শ হিসেবে নিয়েছিল জাহিদ। শুধু তাই নয়, তার দুই সন্তানকেও সে একই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বড় করে তুলেছে। বাবাও তাদের কাছে ছিল সবকিছু।

সুমন জাহিদের ঘনিষ্ঠ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিহত আরেক বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর সারাবাংলা’কে বলেন, ‘ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কিন্তু দুর্ঘটনার কথা বলেননি। তিনি মনে করছেন, এটা ট্রেনের চাকা হতে পারে। কিন্তু আমরা মনে করছি, এটা ট্রেনের চাকা নয়। কারণ ট্রেনের চাকায় কারো শরীর এত শার্পলি কাটা পড়ে না। একটা শরীর যখন ট্রেনের চাকার নিচে পড়ে, তখন শরীরে আরো অনেক ক্ষত থাকে। আমরা এই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না। এজন্য আমরা ভিসেরা রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।’

সুমন জাহিদের সঙ্গে একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন তার শ্যালক কাজী মো. ইসমাইল। তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, “সুমন জাহিদের হতাশার কোনো কারণ ছিল না যে তিনি আত্মহত্যা করবেন। আর কেবল যুদ্ধাপরাধ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া নয়, তার আগে থেকেই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত হওয়া গণআদালত ‘জনতার মঞ্চে’র একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তখন থেকেই তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। তাকে প্রজন্ম ৭১ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বারবার বলা হয়েছে। আর যুদ্ধাপরাধ মামলার আরেক সাক্ষী গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর সঙ্গেও সুমনের মৃত্যুর মিল রয়েছে।”

সুমন ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন বলে জানান মো. ইসমাইল। তিনি বলেন, ‘এরা তো তখন থেকেই টার্গেট ছিল। ঈদের আগ মুহূর্তে রাস্তা ফাঁকা ছিল—সে সুযোগটাই হয়তো তারা নিয়েছে। এই ঘটনা আত্মহত্যা বা অসচেতনতাবশত দুর্ঘটনা— এটা আমরা মানছি না।’ সুমনকে হত্যা করা হয়েছে— বলেন কাজী মো. ইসমাইল।

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন