বিজ্ঞাপন

আগুন, বিস্ফোরণ: চুড়িহাট্টায় উড়ছে কত কথা

February 24, 2019 | 8:58 am

।।সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: চকবাজারের চুড়িহাট্টা চৌরাস্তায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে কয়লা হওয়া ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রায় তিন কোটি টাকার পারফিউম গ্যাস ছিল। দেশের বাহিরে থেকে আমদানি করে আনা পারফিউম গ্যাস এখানে বিভিন্ন মাপের বোতল, ক্যানে রিফিল করা হতো। অগ্নিকাণ্ডের মাত্র দুদিন আগেই আনা হয়েছিল ওই বিপুল পরিমাণের পারফিউম গ্যাস। স্থানীয় অন্য ব্যবসায়ী, বাড়িওয়ালা, দোকান কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

আরও পড়ুন:‘সব বডি পুড়ে কয়লা, ভাইয়ের লাশটাই খুঁজে পাচ্ছি না’

তবে যে বিকট বিস্ফোরণ থেকে ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শুরু তা ঠিক কোথা থেকে হয়েছে সে বিষয়ে তারা এখন প্রায় সকলেই সন্দিহান। সূত্রপাতের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে না পারলেও তাদের সকলের দাবি, আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়েছিল মূলত ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকেই।

বিজ্ঞাপন

কথা বললেও নাম প্রকাশ করতে চাইছেন না এখন কেউই। কাছাকাছি থাকেন এমন এক বাড়িওয়ালা ওই গোডাউনের একজন কর্মচারীর বরাত দিয়ে বলেন, ঘটনার দুই দিন আগে তিনি সেই কর্মচারীর কাছ থেকে জেনেছেন, চীন থেকে পারফিউমের গ্যাস আনা হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকার। ওই রাতেই ভবনের দ্বিতীয় তলায় গ্যাসগুলো ঢোকানো হয়। আর গ্যাস রিফিল করার জন্য এক সপ্তাহ আগেই প্রায় ৫০ হাজার পারফিউমের ক্যান আনা হয়েছিল বলেও জানিয়েছিলেন ওই কর্মচারী।

আরও পড়ুন: সব পুড়ে ছাই, শুধু পড়ে ছিল ৪টি খুলি

বিজ্ঞাপন

তারই বরাতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি সারাবাংলাকে আরও বলেন, এই পারফিউম বিক্রি করে আট থেকে দশ কোটি টাকা মুনাফার প্রত্যাশা ছিলো তাদের। এই গোডাউনে মোট চারজন কাজ করতেন এমনটা জানিয়ে ওই বাড়িওয়ালা বলেন, ‌‌‌’তবে আগুনের ঘটনার পর ওই ছেলেটাকে আর দেখিনা। কি জানি সে রাতে আগুনে পুড়ে মারা গেছে কিনা আল্লায় ভালো জানে। ছেলেটা খুব হাসিখুশি আর মিশুক ছিল।’

কার এ গোডাউন? কিংবা কে তার মালিক? সে প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনও উত্তর মেলেনি। তবে সোহেল নামের একজনের কথা বলেছেন অনেকেই। ‘শুনছি ওই বাড়ির বড় ছেলে সোহেলই এই ব্যবসা চালাতেন। সত্য-মিথ্যা কতটুকু তা জানিনা। তবে তারা খুব প্রভাবশালী। দুই তিনবার সোহেল জেল-জরিমানাও খাটছে লৌহজং কোম্পানি নামের একটা কোম্পানির নাম ব্যবহার করে এসব নকল ব্যবসা করার জন্য,’ বলেন স্থানীয়দের একজন।

‘গিয়ে দেখেন তাদের বাসার নিচের গ্যারেজে কত কোটি কোটি টাকার কেমিক্যাল। শুনছি ৭০ কোটি টাকার মত কেমিক্যাল ওই গ্যারেজে,’ যোগ করেন তিনি।

সেই দোকান কর্মচারীর বরাতে অপরজন বললেন, ‘এসব কেমিক্যাল ভবনের নিচে এমনভাবে রাখা হয়েছে যে এর দরজা ভেদ করে আগুন পানি কিছুই ভিতরে যেতে পারবে না। এখন তো তাই হলো, নিচের গোডাউনে কিন্তু আগুন যায়নি, বলেন দুজনই।

বিজ্ঞাপন

চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের একজন নিয়মিত মুসল্লি আবদুল্লাহ সাঈদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, কিছুদিন আগে প্রায়শই মসজিদে আসার সময় বাজে একটা গন্ধ পেতাম। দিন কয়েক আগে পাশের একটা টুপির দোকানে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করছিলাম।

তিনি বলছিলেন, গোডাউনে মেয়াদউত্তীর্ণ পারফিউমের গ্যাস স্ট্যান্ড ফ্যান চালিয়ে বাইরে বের করে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য এমন গন্ধ। আমার মনে হয় একারণে আগুনের ভয়াবহ চিত্র, বলেন ও ব্যক্তি। তিনি বলেন, সেটা না হলে আগুন এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ার অন্যকোনো কারণতো দেখিনা ভাই। তবে গোডাউনে মালিক কে তা তিনি জানেন না বলেই সারাবাংলাকে জানান।

‘শহরে কে কি করে তার খবর কে রাখে? সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। তাছাড়া কখনও গোডাউনের মালিক তো দূরের কথা বাড়িওয়ালাদেরও তেমন দেখা যায় না মহল্লায়। ওরা এই আসে এই যায়,’ বলেন তিনি।

গত বুধবার রাত সাড়ে দশটার দিকে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই চুড়িহাট্টা এলাকায় লাখ লাখ পারফিউম ও এয়ারফ্রেশনারসহ বিভিন্ন কেমিক্যালের ক্যান (বোতল) পড়ে থাকতে দেখা যায়। টানা ১১ ঘণ্টা ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে শুধু পারফিউম ও বিভিন্ন কেমিক্যালের বোতল বিষ্ফোরণের শব্দ শুনা যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সদস্যরাও বলেছিলেন পারফিউমেরসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল বোতলের বিষ্ফোরণের কারণে অনেকটা কঠিন ছিল আগুন নিয়ন্ত্রণ।

তবে এসব তথ্যের সত্যতা কতটুকু তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম অর রশীদ তালুকদার। তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডে হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলেকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন তাদেরকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আমরাও আপনাদের মত মানুষের কাছে নানান তথ্য শুনছি। তবে প্রধান আসামি গ্রেফতার না হলে সঠিক তথ্য নিশ্চিত হওয়া যাবে না।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, স্থানীয়রা যা কিছু বলছেন তা কতটা সঠিক তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। তবে ওইদিন পারমিউম ও বিভিন্ন কেমিক্যালের ছোট বড় অসংখ্য ক্যান (বোতল) বিস্ফোরিত হয়েছিল। যে কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে অনেক বেগ পেতে হয়।

‘এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে আমাদের স্পেশালিস্টরা তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষে আশা করছি জানা সম্ভব হবে আগুনের মূল কারণ,’ বলেন ফায়ারের ডিজি।

এদিকে, চুড়িহাট্টা এলাকায় ওয়াহেদ ম্যানসনের হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলেকে নিয়ে এলাকায় চলছে নানান জল্পনা কল্পনা। কারণ হিসেবে এলাকাবাসী বলছেন, ঘটনার দুদিন আগেই ওয়াহেদের বড় ছেলে সোহেল ওরফে শহিদ স্ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে গেছেন। আর আগুনের ঘটনার সময় ছোট ছেলে মো. হাসান বাড়িতে ছিলেন না। আগুন লাগার পর হাসানের স্ত্রী আর ছেলে চারতলা থেকে বের হয়ে পালিয়েছেন বলে দাবি এলাকাবাসীর। আবার গোডাউনটির প্রকৃত মালিককে সে তথ্য এখনও পর্যন্ত কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছেন না। এসব দ্বিধাদ্বন্দ্বে এলাকাবাসীর মনে নানান প্রশ্নের জন্ম নিচ্ছে।

আবার আগুনের ঘটনায় বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। কেউ বলছেন, গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে অগ্নিকাণ্ড। আবার কেউ বলছেন ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত। তবে ওই এলাকার রাজমনি হোটেলের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, ১০টা ৩২ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের সময় হঠাৎ হোটেলের পশ্চিম পাশে উপর থেকে কয়েকটি কার্টন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় আগুনের শিখাও ওপর থেকে পড়তে দেখা যায়। একই রকমের দৃশ্য দেখা গেছে শাহী জামে মসজিদের উত্তর পাশের একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজে। সেটিতেও দেখা যায়, হঠাৎ বিষ্ফোরণ ঘটে এবং সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের সামনে বেশ কিছু পারফিউমের বোতল সড়কের ওপর আঁচড়ে পড়ে।

একাধিক তদন্ত কমিটি এ নিয়ে কাজ করছেন। তার একটি কমিটির একজন সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, সিসিটিভি ফুটেজের দৃশ্য দেখে প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে আগুনের সূত্রপাত ওয়াহেদ ভবন থেকে। কারণ, অগ্নিকাণ্ডের সময় দেখা যায়, ওপর থেকে আগুন ছিটকে রাস্তায় থাকা প্রাইভেটকারের ওপরে এসে পড়েছে।

প্রাথমিকভাবে কেউ কেউ বলছেন একটি প্রাইভেটকারের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কথা বললেও তদন্ত কমিটি এখন নিশ্চিত হয়েছে তেমনটা নয়। কারণ রাস্তার ওপর পুড়ে পড়ে থাকা ওই প্রাইভেটকারটির সিলিন্ডার এখনও অক্ষত। তদন্ত চলছে… বিস্তারিত কথা তদন্ত শেষে বলা যাবে, বলেন তিনি।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া সারাবাংলাকে বলেন, কিছু কিছু কেমিক্যাল আছে যা আগুনের সংস্পর্শ বা গ্যাসের সংস্পর্শে আসলেই রিঅ্যাক্ট করে। এতে বিস্ফোরণও ঘটতে পারে। তবে চুড়িহাট্টাতে মূলত কি ঘটেছে সঠিন না জেনে বলা সম্ভব নয়।

সারাবাংলা/এসএইচ/এমএম

আরও পড়ুন

চকবাজারে আগুন: গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংকটে বেড়েছে দুর্ভোগ

চকবাজারে আগুন: ৪৭ জনের লাশ হস্তান্তর

চকবাজারে আগুন: জাতিসংঘ মহাসচিবের শোক, সহায়তার আশ্বাস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন