Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এইচএসসির ফলে পিছিয়ে চট্টগ্রাম, কোভিড ট্রমাকে দুষছে শিক্ষা বোর্ড

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৬ নভেম্বর ২০২৩ ২১:২৯

এইচএসসির ফল প্রকাশের পর সরকারি হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজের শিক্ষার্থীদের উল্লাস। ছবি: শ্যামল নন্দী/সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: কোভিড মহামারির তিন বছর পার করে পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষা। এতে পাসের হার গত বছরের চেয়ে প্রায় ছয় শতাংশ কমেছে। জিপিএ-৫ কমে নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিডের মধ্যে তিন বছর ধরে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার কারণে নিয়মিত পড়ালেখার অনভ্যস্ততাজনিত ‘মনোদৈহিক চাপ’ বা ট্রমার কারণে পরীক্ষার্থীরা ফলাফল কিছুটা খারাপ করেছে। এ ছাড়া প্রস্তুতির পরও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়া এবং জলাবদ্ধতার কারণে বিলম্বে পরীক্ষা শুরু হওয়াও অন্যতম কারণ বলে তারা মনে করছেন।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান জানান, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এবার পাসের হার ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত বছর পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং আগের বছর অর্থাৎ কোভিড শুরুর প্রথম বছর শতভাগ পরীক্ষার্থীকে কৃতকার্য ঘোষণা করা হয়েছিল।

চট্টগ্রামে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ছয় হাজার ৩৩৯ জন। গতবছর পেয়েছিল ১২ হাজার ৬৭০ জন। ২০২১ সালে ১৩ হাজার ৭২০ জন ও ২০২০ সালে ১২ হাজার ১৪৩ জন পেয়েছিল জিপিএ-৫।

সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম বোর্ডেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার পরিমাণ বেশি। ছবি: শ্যামল নন্দী/সারাবাংলা

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা, তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশে এবার ১৭ আগস্ট থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হলেও চট্টগ্রামে হয়েছে ১০ দিন পর। টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে ২৭ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামে পরীক্ষা শুরু হয়। তবে জলাবদ্ধতার কারণে প্রথম দিনের পরীক্ষাও এক ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয়।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষা বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার মোট পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৪৮ জন। এর মধ্যে অংশ নিয়েছে এক লাখ এক হাজার ৯৪৯ জন। পরীক্ষায় বসা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পাস করেছে ৭৫ হাজার ৯০৩ জন।

গত বছর ৯৩ হাজার ৯৯৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৭৪ হাজার ৩২ জন, ২০২১ সালে এক লাখ এক হাজার ২৫১ জনের মধ্যে ৮৯ হাজার ৬২ জন পাস করেছিল। ২০২০ সালে ৯৭ হাজার ৯৬৭ জন পরীক্ষার্থীর সবাইকে পাস ঘোষণা করা হয়েছিল।

এবারও ছাত্রদের তুলনায় পাস ও জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রীরা এগিয়ে আছে। মোট ৫৪ হাজার ৬৩৯ জন ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৭৭ দশমিক ২৩ শতাংশ পাস করেছে। অন্যদিকে ৪৭ হাজার ৩১০ জন ছাত্র অংশ নিয়ে পাস করেছে ৭১ দশমিক ২৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিন হাজার ৪৫৪ জন ছাত্রী, দুই হাজার ৮৮৫ জন ছাত্র।

আরও পড়ুন-

জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে এগিয়ে আছে চট্টগ্রামের ১০টি কলেজ। এর মধ্যে ৯টি মহানগরীর। কলেজগুলোর মধ্যে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে ৮৬৮ জন, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ৭৪০ জন, সরকারি সিটি কলেজ থেকে ৬৭৬ জন, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে ৪০৫ জন ও চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে ৩৬৬ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ৩৫৫ জন, বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২৪৮ জন, হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৮১ জন, পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে ১৬১ জন এবং ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৫৯ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন।

চলতি বছর চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাসের হার ৮৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। মহানগর বাদে জেলায় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলায় পাসের হার ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ৬২ দশমিক ২৭ শতাংশ ও বান্দরবানে ৬৮ দশমিক ৮১ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এবারের ফলাফলে আমরা দেখছি যে শহরে পাসের হারে তেমন হেরফের হয়নি। প্রত্যন্ত গ্রাম ও দুর্গম এলাকার পরীক্ষার্থীরা পিছিয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে আমরা যেটা মনে করছি, কোভিড মহামারির ট্রমাটা আমাদের অনেক শিক্ষার্থী সেভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কোভিডের কারণে ২০২০ সালে পরীক্ষা হয়নি। ২০২১ ও ২০২২ সালে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে। তিন বছর পর এবার পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে অর্থাৎ ১০০ নম্বরে তিন ঘণ্টার পরীক্ষা হয়েছে।’

আগের বছরের তুলনায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থী কমেছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে। ছবি: শ্যামল নন্দী/সারাবাংলা

‘কিন্তু তিন বছর ধরে পড়ালেখার মধ্যে যে একটা অস্বাভাবিকতা— নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ক্লাস হওয়া, পরীক্ষা আদৌ হবে কি হবে না এ চিন্তা— সব মিলিয়ে পরীক্ষার্থীরা একটা ট্রমার মধ্যে ছিল। সেই ট্রমা তারা এবারের পরীক্ষার আগেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলে আমাদের মনে হয়েছে। সরকার, মন্ত্রণালয় নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু দুর্গম এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখার ভীতি বা অস্বাভাবিকতাটা সেভাবে কাটিয়ে তোলা যায়নি বলে মনে হচ্ছে,’— বলেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক বিপ্লব গাঙ্গুলি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোভিডের প্রভাবের কারণে পরীক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করেছিল। এ ছাড়া পরীক্ষার আগে টানা বৃষ্টি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পরীক্ষা পেছাতে হয়েছে। যেকোনো পরীক্ষা পেছালে স্বাভাবিক প্রস্তুতিটা ব্যাহত হয়। এমনকি জলাবদ্ধতার কারণে আমাদের পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়ে শুরুও করা যায়নি। সবকিছুরই একটা প্রভাব পড়েছে বলে আমরা মনে করি।’

এবার শতভাগ পাস করেছে— চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এমন কলেজের সংখ্যা ১২টি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরীতে একটি এবং পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে দুটিসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো পরীক্ষার্থী এবার পাস করতে পারেনি।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান, চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁওয়ের ন্যাশনাল পাবলিক কলেজ থেকে ২১ জন, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা মিউনিসিপ্যাল মডেল কলেজ থেকে সাত জন ও মহালছড়ির বৌদ্ধ শিশুতোষ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে সাত জন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তারা কেউই পাস করতে পারেনি।

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে না পারাটা দুঃখজনক। প্রস্তুতি আশানুরূপ ছিল না। প্রতিষ্ঠানগুলোও দায় এড়াতে পারবে না। তাদের মনিটরিংয়ের অভাব ছিল। তবে পার্বত্য জেলার দুর্গম এলাকার পরীক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয়। তারপরও এটা আমরা খতিয়ে দেখব।’

পাসের দিক থেকে এবারও এগিয়ে বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থীরা। বিজ্ঞানে ৮৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৭৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং মানবিকে পাসের হার ৬৫ দশমিক ২২ শতাংশ। তবে বিষয়ভিত্তিক ফলাফলের ক্ষেত্রে এবার প্রায় সব বিষয়েই ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশের ওপরে পরীক্ষার্থী পাস করেছেন বলে জানান সচিব।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার ১১৩টি কেন্দ্রে ২৭৯টি কলেজের পরীক্ষার্থীরা এইচএসসিতে অংশ নিয়েছে। তবে কলেজভিত্তিক ফলাফল এবার মূল্যায়ন করেনি শিক্ষা বোর্ড। এজন্য পাসের ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০ কলেজের নাম ঘোষণা করা হয়নি। পাসের হারের বদলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যার ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

এইচএসসি পরীক্ষা এইচএসসি’র ফল চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড জিপিএ-৫ পাসের হার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর