বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় দিনেও গোছানো হয়নি বইমেলা, বেড়েছে ধুলো

February 2, 2019 | 10:48 pm

।। হাসনাত শাহীন, বইমেলা থেকে ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় শনিবার (২ ফেব্রুয়ারি) ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১১টা ছুঁতেই খুলে যায় বইমেলার প্রবেশদ্বার। প্রাণের মেলায় প্রিয় মানুষের হাত ধরে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে তরুণ-তরুণীরা যেমন এসেছেন, তেমনই বাবা-মার হাত ধরেও এসেছে অনেক শিশু-কিশোর। আজ ছিলো শিশুপ্রহরের প্রথম দিন।

মেলার প্রথমদিনে যেসব প্রকাশনা সংস্থা তাদের স্টল খোলেনি তারা আজ স্টলে স্টলে নতুন আর পুরোনো বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসছেন। দ্বিতীয় দিনে কোনো স্টল বন্ধ না থাকলেও মেলার সার্বিক পরিস্থিতি গুছিয়ে উঠতে পারেনি মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। মেলার মাঠে এখনও অনেক জায়গায় পড়ে আছে বালু-মাটির স্তুপসহ নির্মাণ সামগ্রীর পরিত্যক্ত অংশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো স্টল নির্মাণে ব্যবহৃত বালি-বাঁশ-কাঠসহ নানাকিছু।

মেলার মাঠে স্বচ্ছন্দে বিচরণের জন্য ইট পেতে নির্মিত রাস্তায় স্থানে স্থানে এখনও আছে ফাঁকা জায়গা। যে জায়গা বালি দিয়ে পূরণ করার কথা ছিল। কোনো কোনো জায়গায় মেলার রাস্তার ইট খুলে অন্যকোনো স্থানে যত্রতত্রভাবে পড়ে আছে। যা মেলায় আসা বইপ্রেমিদের চলাচলে কেবল বিঘ্নই ঘটাচ্ছে না, কারো কারো পায়ে লেগে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সেই সঙ্গে মেলার মূল প্রাঙ্গণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে এবং বাংলা একাডেমির দুই অংশেই ছিলো অসহনীয় ধূলোবালি। পানি ছিটানোর কথা থাকলেও ছেটানো হয়নি পানি। এসব নানা কারণে মেলার শিশুপ্রহরের প্রথম দিনে শিশুদের সঙ্গে ভোগান্তিতে পড়েছিলেন বয়স্করাও।

এছাড়াও এখনও পূরণ হয়নি মেলার সৌন্দর্য্যবর্ধনের জন্য মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ বাংলা একাডেমির দেওয়া নানা প্রতিশ্রুতিও।

বিজ্ঞাপন

তবে মেলার স্টলে-স্টলে বেড়েছে নতুন বই, সেই সঙ্গে বেড়েছে প্রাণের সঞ্চারও। নতুন বইয়ের সঙ্গে মেলার এ দ্বিতীয় দিনে বইপ্রেমীদের সরব উপস্থিতি মেলার দুই প্রাঙ্গণ জুড়েই ছিলো প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। মেলার প্রথম শিশুপ্রহর উপলক্ষে যথারীতি নিয়মে বেলা ১১টায় মেলার প্রবেশ খুলে দিলে মেলায় আগত শিশুদের মাঝে আনন্দের হিল্লোল। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মেলার প্রবেশ করেই শিশুরা তাদের স্বভাব সুলভ উচ্ছসিত-চঞ্চল বিচরণে খুঁজতে শুরু করে তাদের পছন্দমত বইয়ের স্টল আর বই। বেলা ১টার সময় শিশুপ্রহর শেষে হলে মেলায় কিছুক্ষণের জন্য বিরতি থাকে। এরপর বিকেল ৩টার সময় যখন মেলার প্রবেশ দ্বার খুলে দেওয়া হয় তখন মেলায় প্রবেশের জন্য দীর্ঘ সারি দেখা না গেলেও যত সময় গড়িয়ে যায় ততই বাড়তে থাকে মেলা প্রাঙ্গণে বইপ্রেমীর সংখ্যা।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এসময়ে বড়দের সঙ্গে শিশুদের প্রবেশও ছিল লক্ষণীয়। আর, মেলার মাঝামাঝি সময়েই মেলার দু’প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে প্রাণের তাগিদে বইয়ের চিরন্তন আগ্রহে একক, দ্বৈত ও দলবদ্ধ হয়ে মেলায় ছুটে আসা সবার পদচারণায়।

মেলায় ‘বেহুলাবাংলা’ প্রকাশনা সংস্থার সামনে দেখা হলো তরুণ কবি মাহফুজা অনন্যার সঙ্গে। এবারের মেলা নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, “খুব ভালো লাগছে। এবারের মেলায় প্রথমবারের মতো আমার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বেহুলাবাংলা থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কামার্ত নগরের কামিজ’ এবং একাত্তর প্রকাশনী থেকে ‘সোনালি অসুখ’ শিরোনামে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। মেলায় ধূলো-বালির কথা বাদ দিলে বাকি পরিবেশ, স্টল বিন্যাস দারুণ এবং গোছালো।’

এমন দিনের মেলায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রকাশনা স্টলের বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে কথা জানা যায়, মেলার দ্বিতীয় দিনে বেচা-বিক্রি কখনোই তেমন হয় না। কেননা, প্রতিবছরই মেলার শুরুর কয়েকদিন মেলায় যারা আসেন, তারা প্রায় সবাই ক্যাটালগ সংগ্রহ করেন। সেই ক্যাটালগ দেখে, পরে তারা বই কেনেন।

বিজ্ঞাপন

তারা আরও বলেন, ‘তবে এবারের মেলার সার্বিক বিন্যাস ভালো হওয়াই বিগত বছরগুলো চেয়ে এবারের মেলা নিয়ে আমরা অনেক বেশি আশাবাদী। অপর দিকে শিশু কর্নারের শিশুতোষ বইয়ের প্রকাশকরা জানাচ্ছেন মেলার প্রথম দিন শুক্রবার ও আজ আমাদের বিক্রি ভালো হয়েছে। এবার আমরা আশাবাদী এই জন্য যে, অন্যাবারে তুলনায় বিক্রির দিক থেকে এবার অনেক ভালো একটা মেলা শেষ করতে পারবো।’

মেলার নতুন বই
অমর একুশে গ্রন্থমেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মেলার দ্বিতীয় দিনে নতুন বই এসেছে ৮১টি। সেই সঙ্গে বেশ কিছু নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও হয়েছে। শনিবার মেলায় আসা গ্রন্থগুলোর মধ্যে গল্পের গ্রন্থ ১০টি, উপন্যাস ২০টি, প্রবন্ধ ৪টি, কবিতা ১৪টি, গবেষণা ১টি, ছড়া ১টি, জীবনী-৩টি, রচনাবলি-৪টি, মুক্তিযুদ্ধ ৪টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান ৩, ভ্রমণ ২টি, ইতিহাস ৫টি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ২টি এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর বই এসেছে আরও ৭টি বই।

এদিকে, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের জন্মদিন উপলক্ষে আজ শনিবার প্রকাশ করেছে দু’টি বই। এ বিষয়ে প্রকাশনা সংস্থাটির অন্যতম সত্বাধিকারী জহিরুল আবেদিন জুয়েল সারাবাংলাকে জানান, শনিবার ছিলো বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ৮০তম জন্মদিন। এই দিনটি স্মরণ করেই আমরা আজ প্রকাশ করেছি দু’টি বই। এর মধ্যে একটি হলো হাসান আজিজুল হক স্যারের আত্মজীবনী ‘স্মৃতিকহন’; ৬০৮পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য ৮০০টাকা এবং অন্যটি হলো তার কিশোর উপযোগী ‘গল্প ও উপন্যাস সমগ্র’; বইটির মূল্য ২৫০ টাকা।

মেলার মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান
মেলার দ্বিতীয় দিনের গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বিজয়: ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক-গবেষক আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন লেখক-সাংবাদিক হারুন হাবীব, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমরান কবির চৌধুরী এবং গবেষক মোফাকখারুল ইকবাল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক।

প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার মানুষকে মুক্তি ও স্বাধীনতার দিশা দিয়েছে। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির লড়াই ক্রমশ পরিণত হয়েছে স্বায়ত্ত্বশাসন এবং স্বাধীনতামুখী অনিবার্য সংগ্রামে। এ অঞ্চলের চিন্তানায়ক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘ সংগ্রামের পরম্পরায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালিরা যে পথে নেমেছিল সে পথ ছিল বীরত্ব, ত্যাগ, সংগ্রাম ও বিজয়ের পথ। সে পথে শেষ গন্তব্যে পৌঁছেছি আমরা নয়মাসের দীর্ঘ সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও বিপুল বীরত্বের বিনিময়ে। তখন ১৬ ডিসেম্বরের শীতবিকেলের সূর্য পশ্চিম দিগন্তে লালিমা ছড়াচ্ছিল, সে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল রমনার সবুজ চত্বর-আর সেই লাল-সবুজের অপরূপ আলোয় আমাদের বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ যেন বাংলার ও বঙ্গবন্ধুর জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল।’

আলোচকরা বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মোহনায় পৌঁছুতে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত ভাষা-আন্দোলনবাহিত চেতনাই আমাদের ধারাবাহিকভাবে উপনীত করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের দুয়ারে। ভাষার সংগ্রাম আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে জাতিসত্তার আত্মপরিচয় অন্বেষণে। তবে এ পথের যাত্রা কুসমাস্তীর্ণ ছিল না মোটেও। নানামুখী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বায়ান্নকে সফল করে তুলেছে একাত্তরে।’

সভাপতির বক্তব্যে আহমদ রফিক বলেন, ‘ভাষার সংগ্রাম মূলত স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলন চেতনার যে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেছিল তারই বিচ্ছুরিত শিখায় আমরা আমাদের জাতিসত্ত্বার স্বরূপ আবিষ্কার করেছি এবং আঁধার রাতের পরিধি ভেঙে সম্ভব করেছি স্বাধীনতার সুবর্ণ সকাল।’

আলোচনা অনুষ্ঠানের পরেই মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন- আসাদ মান্নান এবং হালিম আজাদ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ইস্তেকবাল হোসেন এবং লায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী। সংগীত পরিবেশন করেন তিমির নন্দী, শিবু রায়, রুমানা ইসলাম, আলম আরা মিনু, শ্যামা সরকার। শিল্পীদের সঙ্গে যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন- বিশ্বজিৎ সরকার (তবলা), রিচার্ড কিশোর (গিটার), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কি-বোর্ড) এবং মোহাম্মদ ফারুক (প্যাড)।

আগামীকাল মেলার মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান
আগামীকাল রোববার (৩ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে গ্রন্থমেলা ৩য় দিন। এদিনে বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে- ‘উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সুবর্ণজয়ন্তী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন লেখক-গবেষক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।

আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন- রামেন্দু মজুমদার, মাহফুজা খানম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং আতিউর রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সারাবাংলা/এমও

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন