বিজ্ঞাপন

খোলা চিঠিতে সিজারের মা: চোখ মুছলেও তো পানি মুছে না

December 6, 2017 | 6:42 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

বাসার কাছে কোনো গাড়ি স্লো হলে মনে হয়- এখনই থামবে। হাসিমুখে, গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া নিতে তাকাবে উপরের দিকে। ও কিসে করে আসবে? উবার নাকি সিএনজি (সিএনজিচালিত অটোরিকশা)? আমি চিৎকার করে নিচে নেমে যাবো! নিমিষে ভুলে যাবো আমার অসহনীয় হাঁটুর ব্যথা। কিন্তু নাহ। আমার এ স্বপ্ন কিছুতেই সত্যি হচ্ছে না… খোলা চিঠিতে এ আকুতি জানিয়েছেন নিখোঁজ সিজারের মা।

গত ৭ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান সিজার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পাশাপাশি সিজার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
নিখোঁজ হবার দিন, সকাল ৭টায় কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন তিনি। সন্ধ্যা পৌনে ৭টা থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ছেলের নিখোঁজ হওয়ার ঠিক একমাস পর সিজারের মায়ের খোলা চিঠিটি হ্যাশট্যাগ ব্রিংব্যাক মোবাশ্বার দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন মোবাশ্বারের বোন তামান্না তাসমিন।

চিঠির শেষে মায়ের সঙ্গে সিজারের একটি ছবিও পোস্ট করেছেন তামান্না, যেখানে লেখা রয়েছে ‘আই লাভ মাম’। ছবিতে সিজারের মাথায় রয়েছে লাল-সবুজ পতাকা বাঁধা ব্যান্ডানা।

বিজ্ঞাপন

‘একজন অসহায় মা বলছি’ শিরোনামে লেখা চিঠিতে মোবাশ্বারের মা লিখেছেন, “একই কাপড়ে রয়েছে ২৮টি দিন। ওর প্যান্ট-শার্ট আয়রন করিয়ে রেখেছি। ও ঠাণ্ডা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তাই ওর কাপড়গুলা রোদে দিয়ে রেখেছি। প্রতিদিনই ওর ঘরের আসবাবপত্র, বিছানা সব ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখছি। নিম গাছ বাসায় থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ওর ব্যালকনির নিচে লাগানো নিম গাছটা বড় হয়ে ছাদ স্পর্শ করছে, কিন্তু ওই গাছের বাতাস এখন আর ওর গায়ে লাগছেনা”।

“ওর অনুপস্থিতিতে আমরা সবাই ম্রিয়মাণ। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই খোঁজ রাখছে। অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবৎসল এই আমি- এখন আর কারো ফোন ধরতে ইচ্ছা করে না। কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। একই কথা কতবার বলবো? নাহ ওর কোনো খবর নাই”।

বিজ্ঞাপন

“সিজুর আনন্দের দিন হতো যখন আরিয়ানা ঘণ্টাখানেকের জন্যে আমাদের বাসায় আসতো। ওর সঙ্গে বাড়ির ইট কাঠগুলোও যেন হেসে উঠতো। ও আমাদের পোষা কোয়েল পাখিগুলাকে খাবার ছিটিয়ে দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠতো”।

মোবাশ্বারের মা চিঠিতে আরও লেখেন, “তামান্নার পোষা বিড়ালটাকে বাগে আনতে না পেরে বিরক্ত হতো। লোশনের সঙ্গে পাউডার তৈরি করে আমাদের খেতে দিত। মিছি মিছি সেটা খেয়ে আরিয়ানকে খুশি করতে হতো। ওর অবুঝ দুষ্টুমিতে আমাদের বাসায় বয়ে যেত উৎসবের আমেজ আর সে সময় আমার সিজুকে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ”।

ছেলেকে কেউ নিয়ে গেছেন কি না- জানেন না এই মা। জানিয়েছেন, তার ছেলে কখনো কারো উপকার ছাড়া অপকারের কথা চিন্তাও করতেন না। তিনি লিখেছেন, “জানিনা কেউ ওকে নিয়ে গেছে কি না। যদি কেউ ওকে নিয়ে থাকেন তাহলে বলবো, বিশ্বাস করেন ও কখনো কারো উপকার ছাড়া অপকারের চিন্তা করতে পারতো না”। নিজের ছেলে বলেই যে তিনি এসব কথা বলছেন বিষয়টি তেমন নয়- জানিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, “আমি মা বলে বলছি না। ও নিখোঁজ হওয়ার পর এতো মানুষের আকূলতা সেটাই প্রমাণ করে। যদি কেউ আসলেই ওকে আটকে থাকেন, তাদের বলছি, আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দোয়া করি আল্লাহ আপনাদের মায়েদের অফুরান তৌফিক দান করুন, তারা যেন আপনাদেরকে বুকে টেনে নিতে পারেন।

মৃত্যু নিয়েও ভয় হয় মোবাশ্বারের মায়ের! তাইতো তিনি লিখেছেন, “ইদানিং আমার ভয় হয়। আমাদের এই গলিতে যেন মৃত্যুর মিছিল হানা দিয়েছে। ঈদুল আজহার আগের দিন না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমাদের প্রতিবেশী। প্রায় দিন দশেক আগে চির বিদায় নিলেন আমার বাম পাশের বাড়িওয়ালি। তবে এবার কি আমাদের পালা?”

বিজ্ঞাপন

তবু নিজের ছেলে হয়তো একদিন ফেরৎ আসবে- আশাবাদী মা। কিন্তু তখন ছেলে বাবা-মাকে দেখতে পারবে কি না শঙ্কা মনে। শঙ্কা নিয়েই মা লিখেছেন, ইন-শা-আল্লাহ ও হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু ও এসে কি আমাদের ২ জনকে (বাবা -মা) দেখতে পাবে?
পরের লাইনে ছেলের জন্য চোখের পানি মোছার কথা লিখেছেন। বাড়ির ছেলেকে হারিয়ে বাবার দীর্ঘশ্বাস ফেলার কথা, বোনের বিষণ্ন মুখের কথা। আর নিজের কথা জানিয়ে লিখেছেন, “আমি আমার চোখ মোছা বন্ধ করে দিয়েছি। চোখ মুছলেও তো পানি মুছে না, ঝরতেই থাকে। শুধু লোকজনের সামনে চোখ মুছে এসে কথা বলি। কথাতো একটাই – নাহ কোনো খবর নাই”।

সবশেষে সিজারের মা লিখেছেন, “ওর বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমি বৃথা অশ্রু সংবরণ করার চেষ্টা করি, মেয়েটা বিষণ্ন মুখে আশেপাশে ঘুরে। কেউ কি আছেন, যে পারেন একটা হতাশাগ্রস্ত পরিবারকে আশার আলো দেখাতে? কেউ কি পারেন ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে? ফিরিয়ে দিন না আমার ছেলেটাকে আমার কোলে। আল্লাহর অশেষ রহমত থাকবে আপনার উপর”।

ইতি মোবাশ্বারের আম্মু

জেএ/এটি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন