বিজ্ঞাপন

নিখোঁজ রাষ্ট্রদূতের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার খোঁজ!

December 6, 2017 | 9:37 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান নিখোঁজের দুই দিন পার হলেও এখনো তার খোঁজ মেলেনি। তবে খুঁজে বের করার পাশাপাশি এই সাবেক কূটনীতিকের জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা নিয়ে খোঁজ-খবরও চলছে।

সারাবাংলার কাছে দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্য, গোয়েন্দারা বরং মারুফ জামানের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়েই বেশি জোর দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে।

এদিকে, পুলিশ মারুফ জামানের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে জেনেছে তার ফোনটি সবশেষ সক্রিয় ছিল রাজধানীর দক্ষিণ খানের কাওলা এলাকায়।

বিজ্ঞাপন

মারুফ জামানের বাড়ির একজন নিরাপত্তাকর্মী জানিয়েছেন, সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাসায় ফোন করেছিলেন মারুফ জামান। এদিকে বিদেশ ফেরত মেয়েকে বিমানবন্দর থেকে আনতে যাওয়ার পথে মারুফ জামান নিখোঁজ হয়েছেন, এমন তথ্য পরিবারের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে জানানো হলেও পরে পরিবারের সদস্যরা আর মুখ খুলছেন না।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই গণমাধ্যম কর্মীরা ধানমণ্ডির ৯/এ রোডের ৮৯ নম্বর বাসায় গেলে পরিবারের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। দুপুরের দিকে তারা ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর মাধ্যমে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি সাংবাদিকদের কাছে পাঠান।

এদিকে দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মারুফ নিখোঁজ হওয়ার পেছনে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলছে।

বিজ্ঞাপন

ওই সূত্রটি জানায়, এই সাবেক কূটনীতিক আগে থেকেই সরকারবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন এমন তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমেও তার সংশ্লিষ্টতা জানা গেছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গেও জড়িত থাকার তথ্য মিলছে।

বুধবার সকাল ১১টায় মারুফ জামানের বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের কারো সঙ্গে কথা বলা সম্ভব না হলেও কথা হয় বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে নিরাপত্তাকর্মী নুরুজ্জামান বলেন, ‘ভেতরে যাওয়া নিষেধ আছে। এ ব্যাপারে কেউ কথা বলবেন না। দুপুরের পর এসে কাগজ নিয়ে যেতে বলেছেন।’

মারুফ জামান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার বাসা থেকে তেমন একটা বের হতেন না। বিকেল বেলা বের হয়ে সামনের রাস্তাতেই হাঁটতেন। শুক্রবার পাশের মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। আর সারাদিনই বাসায় শুয়ে-বসে কাটাতেন। মাঝে মধ্যে গাড়ি নিয়ে বের হলে নিজেই ড্রাইভ করতেন।’

পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে জানতে চাইলে নুরুজ্জামান বলেন, ‘তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে বিয়ের পর থেকে বেলজিয়ামে থাকেন। আর ছোট মেয়ে সামিহা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে বাসাতেই থাকেন। সামিহা জামান গত নভেম্বরের শুরুর দিকে বেলজিয়ামে বড়বোনের বাসায় বেড়াতে যান। গত সোমবার দেশে ফেরেন। তাকেই আনতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যাচ্ছিলেন মারুফ সাহেব।’

বিজ্ঞাপন

এরপর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মারুফ জামানের ধানমণ্ডির বাসায় ফের গেলে বাড়ির অপর নিরাপত্তাকর্মী মফিজুল ইসলামের সাক্ষাৎ মেলে।

সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মফিজুল বলেন, ‘স্যার বের হয়ে গেছেন সোয়া ৫টার দিকে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি বাসার টিএনটি নম্বরে কল করে বলেন, তিনজন লোক যাবে, তাদের বাসায় থাকা ল্যাপটপটা দিয়ে দিতে হবে। পরে রাত ১০টার দিকে জানতে পারি স্যার নিখোঁজ হয়েছেন।’

কীভাবে জানলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওনার মেয়ে বাসায় ফিরে কান্নাকাটি করে নিখোঁজের বিষয়টি জানান।’

ফোনে কার সঙ্গে কথা হয়েছে জানতে চাইলে মফিজুল বলেন, ‘বাসায় দুজন কাজের বুয়া থাকেন। তাদের একজন লাকি। যিনি ১৪ বছর থেকে স্যারের বাসায় কাজ করেন।’

কী কথা বলেছেন, জানতে চাইলে কাজের বুয়া লাকির বরাত দিয়ে নিরাপত্তাকর্মী মফিজুল বলেন, প্রথমে একটি নম্বর থেকে কল আসে। ওই কলটির কথা ঠিকমতো শোনা যাচ্ছিল না। তাই ৫ সেকেন্ড পরে কেটে দিয়ে আরেক নম্বর থেকে কল করেন। সেই কলটিতে তিনজন লোক যাবে তাদের হাতে ল্যাপটপ দিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। লাকি বলেছেন, পুরো ঘর তল্লাশি করে ওই তিনজন লোক। এরপর একটি কম্পিউটার, একটি ল্যাপটপ, একটি ক্যামেরা ও একটি স্মার্ট ফোন নিয়ে যান।’

মফিজুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাত ৮টার দিকে দাঁড় করাতে গেলে তারা বলেন, মারুফ স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। কম্পিউটার নষ্ট হয়েছে। ঠিক করতে এসেছি। এরপর ইন্টারকমে বাসার বুয়ার সাথে কথা বলে ক্লিয়ার হওয়ার পর তাদের ওপরে যেতে দিই।’

ওই তিনজন লোক সম্পর্কে জানতে চাইলে মফিজুল বলেন, ‘তাদের তিনজনের মাথায় ক্যাপ পরা ছিল। একজনের মুখে মাস্ক পরা ছিল। তিনজনের পরনেই চাপা সোয়েটার ও প্যান্ট পরা ছিল। পায়ে কালো জুতা পরা ছিল। ৮টা ৫ মিনিটে বাসায় প্রবেশ করে আর ঠিক ৮টা ১৪ মিনিটে বের হয়ে যান। বের হয়ে যাওয়ার সময় সবাই মুখ ঢেকে বের হন।’

মারুফ জামানের বাসায় কারা যাতায়াত করতেন জানতে চাইলে মফিজুল বলেন, ‘মাঝে মধ্যেই কিছু লোক যাতায়াত করত। স্যার তাদের উপরে যেতে বলতেন তাই অনুমতি দিতাম। কিন্তু তারা কী করতেন তা জানি না।’

মফিজুল ২ বছর থেকে কাজ করেন ওই বাসায়। এ সময়ের মধ্যে মারুফ জামান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারিনি।

মারুফ জামান নিখোঁজের পর মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর ২০১৭) দুপুরে ছোটমেয়ে সামিহা জামান ধানমণ্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর-২১৩) করেন। রাত ৮টার দিকে খিলখেত থানা পুলিশ ৩০০ ফিট রাস্তা থেকে পরিত্যাক্ত অবস্থায় মারুফ জামানের গাড়িটি উদ্ধার করেন। এ সময় গাড়িটিতে ৪ পিস স্যান্ডুইস পাওয়া যায়। তবে গাড়িটি অক্ষত অবস্থায় ছিল। গাড়িটি (নং ঢাকা মেট্রো গ ২১১৩৯৯) বর্তমানে ধানমণ্ডি থানায় আছে।

মারুফ জামান ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীতে (ষষ্ঠ শর্ট কোর্স) ক্যাপ্টেন পদে যোগদান করেন। ১৯৮২ সালে সেনাবাহিনী থেকে আত্তীকরণ হয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেন। এরপর যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ফাস্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি কাতারের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বার পর্যন্ত তিনি ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকেন। এরপর দেশে ফিরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইএসএস) মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ ২০১৩ সালে অতিরিক্ত সচিব পদে উন্নীত হন। এরপর অবসর গ্রহণ করেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, তিনি চাকরিতে থাকাকালে সরকারের কারও সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারেননি। তার প্রথম নিয়োগ জিয়ার আমলে। এরপর সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে তিনি রাষ্ট্রদূতের নিয়োগ পান।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণত কেউ নিখোঁজ হলে পরিবার অভিযোগ করেন। আবার দাবিও করে থাকেন যে, অমুক পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে। কিংবা অপহরণ হলে নির্দিধায় বলেন, অমুক অপহরণ হয়েছে। ফোনে কল করে মুক্তিপণ দাবি করেছেন। মারুফ জামানের বেলায় কিন্তু এর কোনোটাই ঘটেনি। ফোন করে টাকাও চাননি। এরপরেও কেন পরিবারের সদস্যরা মুখ খুলছে না। তার একটা রহস্য থেকেই যায়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ধানমণ্ডি জোনের সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহিল কাফি বলেন, জিডির পর ওই বাসায় থাকা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী তদন্ত চলছে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও মাঠে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন এন্টি টেররিজম ইউনিটের ডিআইজি মনিরুল ইসলাম ডিএমপিতে এক সংবাদ সম্মেলন শেষে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাবেক রাস্ট্রদূত নিখোঁজের ঘটনা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশসহ কাউন্টার টেররিজম ইউনিটও মাঠে কাজ করছে। আর তিনজন ভোমরা- চোমরা লোক এসে ল্যাপটপ নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

সারাবাংলা/ইউজে/আইজেকে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন