বিজ্ঞাপন

ভারত থেকে উড়ে আসা বেলুন নিয়ে চাঞ্চল্য, কী যন্ত্রপাতি আছে তাতে?

November 24, 2019 | 10:43 pm

তরিকুর রহমান সজীব ও রিফাত রহমান

ঢাকা: ভারত থেকে বিশালাকৃতির এক বেলুন উড়ে এসে পড়েছে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার দেউলী গ্রামের একটি ক্ষেতে। স্থানীয়রা খবর দিলে দামুড়হুদা মডেল থানা পুলিশ যন্ত্রপাতিতে ঠাসা বেলুনটি উদ্ধার করেছে। পুলিশ বলছে, আবহাওয়ার গতিবিধি পরিমাপের যন্ত্রপাতি রয়েছে বেলুনটিতে। সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহাকাশ গবেষণার অংশ হিসেবে কিছু শিক্ষার্থীদের তৈরি কয়েকটি যন্ত্র পাঠানো হয়েছিল বেলুনটিতে। বাতাসের গতিবিধির কারণে এটি বাংলাদেশে এসে পড়েছে।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২৪ নভেম্বর) বিকেলে দামুড়হুদা গ্রাম থেকে যন্ত্রপাতিসহ ওই বেলুন উদ্ধার করা হয়। দামুড়হুদা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গার কোনো একটি স্থানে বেলুনটি পড়েছে জেনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বেলুনটি নিয়ে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করতে শুরু করেছে।

গমের ক্ষেতে উড়ে আসে বেলুন

বিজ্ঞাপন

রোববার চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার দেউলী গ্রামে নিজের গমের ক্ষেতে সার দিচ্ছিলেন নূর মোহাম্মদের ছেলে আবুল কালাম। বিকেলে আচমকা এক বিশালাকৃতির বেলুন এসে পড়ে তার ক্ষেতে। আবুল কালাম তার জীবনে এরকম বিশাল আকারের কোনো বেলুন দেখেননি। বেলুনটি দেখে হতচকিত হয়ে পড়েন তিনি। কাছে যাবেন কি যাবেন না, দোটানায় পড়ে যান। খবর দেন আশপাশের মানুষদের।

শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে বেলুনটির কাছে গিয়ে দেখতে পান, এর সঙ্গে রয়েছে বেশ বড় আকারের একটি কর্কশিটের বাক্স। তার মধ্যে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি বাক্স। তার মধ্য থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ক্যামেরার মতো কিছু যন্ত্র। কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ে সবার মধ্যে, কিছুটা ভীতিও। অজানা আশঙ্কা কাজ করে, কী যন্ত্রপাতি আছে এসব বাক্সে!

একটু সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে দেখা যায়, বাক্সের গায়ে বাংলায় দেওয়া বেশকিছু নির্দেশনা। তাতে বেশ কয়েকটি ফোন নম্বর দেওয়া, সবগুলোই ভারতীয়। পাশে লেখা আছে, বাক্সের গায়ে দেওয়া কয়েকটি ফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে, অথবা যোগাযোগ করতে হবে নিকটস্থ থানায়। শেষ পর্যন্ত গ্রামবাসী থানায় যোগাযোগ করলে দামুড়হুদা মডেল থানা পুলিশ এসে যন্ত্রপাতিগুলো উদ্ধার করে।

বিজ্ঞাপন

কী আছে ভারতীয় সেই বেলুনে আসা বাক্সে?

পুলিশ এসে বেলুনটি উদ্ধার করার পর কর্কশিটের বড় বাক্সটি খোলা হয়। সেই বাক্সের মধ্যে পাওয়া যায় ছোট ছোট তিনটি বাক্স। এর মধ্যে একটিতে পাওয়া যায় চারটি সোলার প্যানেল। অন্য একটি বাক্সে ছিল একটি বিশেষ ধরনের সেন্সর। সঙ্গে থাকা আরেকটি বাক্সে ছিল দুইটি ভিডিও ক্যামেরা।

বাক্সের বাইরে ভারতীয় একটি পতাকা সংযুক্ত ছিল। এর সঙ্গে বাংলা ভাষায় লেখা বেশকিছু নির্দেশনাও ছিল। এতে বলা হয়েছে, বেলুনটি ফোলা অবস্থায় থাকলে এর আশপাশে ধূমপান করবেন না। বাক্সটিকে জলে ডোবাবেন না, লাঠি দিয়ে আঘাত করবেন না বা আগুনে পোড়াবেন না। বাক্সটি কোনোভাবেই বিপদজনক নয়। বাক্সটির ক্ষতি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ উল্লেখ করে পুলিশ বা সংস্থার কর্তৃপক্ষ না আসা পর্যন্ত বাক্সটিতে হাত না দেওয়ার নির্দেশনাও লেখা আছে।

বিজ্ঞাপন

কারা পাঠিয়েছে এই বেলুন?

প্রাথমিকভাবে পুলিশ বেলুনটি উদ্ধার করার পর জানায়, বেলুনটি এসেছে ভারত থেকে। বেলুনটি যারা পাঠিয়েছে, তারা এরই মধ্যে এটি উদ্ধারের জন্য যোগাযোগ শুরু করেছে।

ওই বাক্সের গায়ে যতগুলো ফোন নম্বর দেওয়া আছে, সবগুলোই ভারতীয়। ওই বেলুন সম্পর্কে জানতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ওই নম্বরগুলোর প্রথমটিতেই।

ফোন রিসিভ করেন সন্দীপ চক্রবর্তী, তিনি কলকাতায় ভারতের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের পরিচালক। সন্দীপ সারাবাংলাকে বলেন, তারাই এই বেলুনটি আকাশে পাঠিয়েছিলেন। ১০০ ফুট ব্যসের বেলুনটি হাইড্রোজেন গ্যাস ভরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৪২ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে এই বেলুন। এর সঙ্গে দেওয়া বাক্সের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে তারা মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন।

বাক্সে থাকা যন্ত্রপাতিগুলো প্রকৃতপক্ষে কী?

চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় বেলুনটি উড়ে আসামাত্রই চাঞ্চল্য তৈরি হয়। আশঙ্কা-গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। নজরদারি করার কোনো উপকরণ এতে আছে কি না, এমন শঙ্কাও করতে থাকেন কেউ কেউ। তবে বেলুন উদ্ধারের পর প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানায়, আবহাওয়ার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য যন্ত্রপাতি রয়েছে এই বেলুনে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য তারা এ বিষয়ে দিতে পারেনি। সেই তথ্য পাওয়া যায় কলকাতার সেই মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক সন্দীপ চক্রবর্তীর কাছে।

তিনি সারাবাংলাকে জানান, বেলুনের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ধরনের ‘সফিসটিকেটেড’ যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। তবে চুয়াডাঙ্গায় যে বেলুনটি এসে পড়েছে, তাতে খুব বেশি ‘সফিসটিকেটেড’ যন্ত্রপাতি ছিল না। মহাকাশ গবেষণায় তরুণরা যেন আগ্রহী হয়ে ওঠে, সেজন্য চার জন কলেজ শিক্ষার্থীর তৈরি কিছু যন্ত্র তারা এই বেলুনে পাঠিয়েছেন।

সন্দীপ বলেন, এই বেলুনে যে যন্ত্রপাতিগুলো পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে দুইটি ভিডিও ক্যামেরা রয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে উঠতে উঠতে এটি পৃথিবীর চিত্র ধারণ করতে থাকে। এই চিত্র থেকে পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে যেমন শিক্ষার্থীরা ধারণা পাবে, তেমনি অন্য কিছু সূচক ব্যবহার করে এর মাধ্যমে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয়, সেইসঙ্গে আরও কিছু তথ্য হিসাব করে বের করা যায়।

সন্দীপ জানান, যে চারটি সোলার প্যানেল রয়েছে, তার সঙ্গের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রার তারতম্য, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিমাপসহ কিছু তথ্য ধারণ করতে পারে। বাক্সের মধ্যে আরেকটি যন্ত্র রয়েছে, যেটি এক ধরনের সেন্সর। এটি সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। বেলুনটি বাতাসের প্রভাবে ঘুরে গেলেও এই সেন্সরটি নিজেই দিক পরিবর্তন করে সূর্যের মুখোমুখি চলে আসে। এই যন্ত্রটির সঙ্গে ‘সফিসটিকেটেড’ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সূর্যের বিকিরণ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পরিমাপ করা সম্ভব। একইসঙ্গে একটি জিপিএস ট্র্যাকারও রয়েছে এই বেলুনে। এই ট্র্যাকার থেকে তারা জানতে পারেন, বেলুনটি কোন পথে উড়ছে, কখন কোথায় অবস্থান করছে।

বাতাসের তারতম্যে কলকাতা থেকে চুয়াডাঙ্গায় বেলুন

সন্দীপ চক্রবর্তী জানান, নিয়মিতই তারা এরকম বেলুন পাঠিয়ে থাকেন তথ্য সংগ্রহের কাজে। ১০০ ফুট ব্যাসের বেলুনগুলো ৪২ কিলোমিটার উড্ডয়নের পর চুপসে যেতে থাকে। এরপর তা ফের ভূমিতে নেমে আসে। তখন বেলুনে থাকা জিপিএস ট্র্যাকারের মাধ্যমে বেলুনের অবস্থানের জায়গাগুলোতে যোগাযোগ করে তা নিজেদের কাছে নিয়ে যান।

তবে এবারে হিসাবে একটু ‘গোলমাল’ ছিল— সেটা নিজেই স্বীকার করলেন সন্দীপ চক্রবর্তী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বায়ুমণ্ডলের একেকটি স্তরে বাতাসের গতিবিধি একেকরকম থাকে। আমরা সেভাবে হিসাব করে থাকি, যেন এটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠার পর আমাদের হিসাবে কাঙ্ক্ষিত কোনো জায়গায় ফিরে আসে। সাধারণত এ হিসাবের হেরফের হয় না। তবে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের সময় বাতাস স্বাভাবিক আচরণ না করলে আমাদের হিসাব একটু এদিক-সেদিক হয়ে যায়। এবারে আমাদের হিসাবে বাতাসের গতিবিধির দুয়েকটি সূচকেও মিস রিডিং ছিল। সে কারণেই বেলুনটি বাংলাদেশে চলে গিয়েছে। আমরা জিপিএস ট্র্যাকারে দেখতে পাচ্ছিলাম, এটি ভারতের সীমানা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

ভারত থেকে উড়ে আসা বেলুন এই প্রথম নয়

চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় বেলুনের ‘অবতরণ’ চাঞ্চল্য তৈরি করলেও সন্দীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। তিনি জানান, প্রায় ১০ বছর আগে, ২০১০ সালের প্রথম দিনটিতেই তাদের আরও একটি বেলুন উড়ে এসেছিল বাংলাদেশে। ওই বেলুনটিও চুয়াডাঙ্গা জেলারই কোনো একটি স্থানে এসে হাজির হয়। পরে তারা যোগাযোগ করেন বাংলাদেশে। ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার বেনাপোল সীমান্তে গিয়ে সেই বেলুনটি হস্তান্তর করেছিলেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে।

বেলুনে আবহাওয়া মহাকাশের তথ্য সংগ্রহ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া

ভারতীয় ‘স্পেস ফিজিক্স’ সেন্টারের দাবি, মহাকাশ গবেষণা সম্পর্কিত তথ্য তার এই বেলুনের মাধ্যমে সংগ্রহ করে থাকেন। এই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে জানতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) সঙ্গে। সংস্থাটির সদস্য (গবেষণা) যুগ্মসচিব মোহাম্মদ আজম বলেন, আমরা সাধারণত স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে থাকি। বাংলাদেশের এখন নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে। সেখান থেকে তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বিভিন্ন দেশের এমন স্যাটেলাইট রয়েছে, যেগুলো থেকে বিনামূল্যে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। আমরা সেসব স্যাটেলাইটের তথ্য নিয়েই গবেষণা করি। বেলুনের মাধ্যমে আমরা কোনো তথ্য সংগ্রহ করি না। ভারতীয় এমন বেলুন সম্পর্কে তার জানা নেই বলেও জানান।

তবে আবহাওয়া অধিদফতরে যোগাযোগ করে জানা গেল, তারা নিয়মিতই বেলুনের মাধ্যমে আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। আর একই পদ্ধতিতে চাইলে মহাকাশ গবেষণা বা সংশ্লিষ্ট তথ্যও সংগ্রহ করা যেতে পারে।

আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, কোন বেলুন এসেছে বা তাতে কী ধরনের যন্ত্রপাতি রয়েছে, তা না দেখে মন্তব্য করা যাবে না। তবে আমরা নিয়মিত বেলুনের সাহায্যে আবহাওয়ার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে থাকি। বিভিন্ন গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে এসব বেলুন উড়িয়ে দেওয়া হয়। বেলুনের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সেন্সর থাকে। এর মাধ্যমে তাপমাত্রা, বিভিন্ন উচ্চতায় তাপমাত্রার পার্থক্য, বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, আর্দ্রতাসহ নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বেলুনের সঙ্গে দেওয়া সেন্সরের মাধ্যমে আমাদের গ্রাউন্ড স্টেশনে এসে সেসব তথ্য পৌঁছে যায়। সেগুলো সফটওয়্যারে ইনপুট দিলে আবহাওয়া পরিস্থিতির চিত্র পাওয়া যায়। এর সঙ্গে অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়েই আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়।

আব্দুল মান্নান বলেন, একই পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেও সূর্য রশ্মির বিভিন্ন তথ্যসহ আরও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটিও হয়তো তেমন তথ্য সংগ্রহের জন্যই বেলুনটি ব্যবহার করেছে। সামনাসামনি না দেখে এর চেয়ে বেশিকিছু বলা যাবে না।

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন