বিজ্ঞাপন

হারিয়ে যাচ্ছে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা

February 2, 2020 | 7:51 am

হৃদয় দেবনাথ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

মৌলভীবাজার: বৃহত্তর সিলেট বিভাগে ক্ষুদ্র নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাসিয়া, গারো, ত্রিপুরা, মুন্ডা, সাঁওতাল, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, মৈতৈ মণিপুরীসহ প্রায় ১৩টি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। এছাড়া চা বাগানগুলোতে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করেন, তাদের মধ্যে রয়েছে তেলেগু, রবিদাস, কৈরীসহ আরও বেশকিছু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন সাধারণত পাহাড় ও টিলার পাদদেশ, বন কিংবা সমতল ভূমিতে বসবাস করে আসছেন দীর্ঘ দিন ধরে। চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত এসব নৃগোষ্ঠী জাতীয় অর্থনীতিতেও ভূমিকা রেখে চলেছেন। তারপরও শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং একইসঙ্গে ভূমির অধিকারসহ মাতৃভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে আছে এসব জনগোষ্ঠী।

বিজ্ঞাপন

মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে নিজেদের মাতৃভাষার পরিচয় অনেকটাই হারাতে বসেছেন তারা। সঠিক চর্চা, প্রাথমিক শিক্ষায় সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার নির্দিষ্ট বর্ণমালা না থাকা এবং সেই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মিশ্রণে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষার স্বকীয়তা।

জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া পুঞ্জি, ডলুবাড়ী, কালেঞ্জী পুঞ্জি, মাগুরছড়া পুঞ্জি, আলেয়াছড়া পুঞ্জি, নিরালা পুঞ্জি, ডবলছড়া পুঞ্জি, মরইছড়া পুঞ্জি, মাধবকুণ্ড পুঞ্জি, নাহার পুঞ্জি ও কাইলান পুঞ্জিসহ আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করেন। এছাড়া মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের কালেঞ্জী পুঞ্জিতেও রয়েছে কিছু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যদের বসবাস। এই এলাকায় সেন্ট জোসেফ গির্জাটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে।


ঢাকা কেমব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষক ও পরিবেশবাদী মেঘনাদ হাজরা সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে যেসব নৃগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই নিজস্ব ভাষা রয়েছে, নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। কিন্তু দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের নিজস্ব বর্ণমালা বা ভাষা শেখানো হয় না। চর্চা ও সংরক্ষণের অভাবে এখন এসব নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ দেশের সব নাগরিকের নিজ নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার রয়েছে এবং রাষ্ট্রেরও কর্তব্য তাদের ভাষা ও বর্ণমালা চর্চা ও সংরক্ষণে মনোযোগী হওয়া।

বিজ্ঞাপন

মেঘনাদ হাজরা আরও বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকেই এখন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে বা পড়তে পারে না। তাই সরকারি উদ্যোগে এসব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণ করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাসিন্দা সাজু মারচিয়াং সারাবাংলাকে বলেন, তারা ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করছেন। তারা তাদের নিজস্ব ভাষা বলতে পারলেও তা সঠিকভাবে লিখতে পারেন না।

মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান জিডিসন প্রধান সুচিয়াং সারাবাংলাকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না থাকায় আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই নৃগোষ্ঠীর শিশুদের বাংলা ভাষায় পড়ানো হচ্ছে। ফলে ছোটবেলা থেকেই তারা বাংলা ভাষা রপ্ত করছে। এ কারণে আমাদের অনেকেই নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, নিজেদের ভাষার চর্চা ধরে রাখতে কিছু পুঞ্জিতে নিজেদের অর্থায়নে পরিচালিত স্কুলগুলোতে খাসিয়া ভাষা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এভাবে এসব ভাষা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।  সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের ভাষাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা জরুরি। নাইলে এগুলো একেবারে হারিয়ে যেতে সময় লাগবে না।


লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান ফিলাপত্মী সারাবাংলাকে বলেন, বৃহত্তর সিলেটের ৭০টি খাসিয়া পুঞ্জির মধ্যে হবিগঞ্জের আলীয়াছড়া ও জাফলং এলাকার নকশিয়ার পুঞ্জিতে দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো সরকারি বিদ্যালয় নেই। তবে খাসিয়াদের চাঁদায় পরিচালিত হচ্ছে কয়েকটি কমিউনিটি বিদ্যালয়। এসব কমিউনিটি বিদ্যালয়ে নিজস্ব ভাষা চর্চার চেষ্টা চলছে।

কমলগঞ্জের মহারাজ গম্বীর সিংহ মোমোরিয়াল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ফাল্গুনী সিংহ বলেন, স্কুল বা ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, মাতৃভাষা চর্চাকেন্দ্র এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে মণিপুরীসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এসব ভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক কাউছার ইকবাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের চা বাগানে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই এখন বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ফলে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষার ব্যবহার কমে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বর্ণমালার পরিচিতি সংযুক্ত করার মাধ্যমে এসব বর্ণ ও লিপি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।’

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন