বিজ্ঞাপন

করোনাকালে চসিকের কাণ্ড, স্কুলছাত্রদের দর্শক বানিয়ে ‘জনসমাবেশ’

July 26, 2020 | 8:11 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জড়ো করে একটি স্কুলভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। আর ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চসিকের এই ‘জনসমাবেশ’ আয়োজন নিয়ে বন্দরনগরীতে চলছে নানা সমালোচনা।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২৬ জুলাই) সকালে চট্টগ্রাম নগরীর ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে রবীন্দ্র-নজরুল কিন্ডারগার্টেন ও পাথরঘাটা সিটি করপোরেশন বালক উচ্চ বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টারের উদ্বোধন উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান হয়েছে।

আগামী ৫ আগস্ট মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, মেয়াদ শেষের আগেই তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করতে গিয়ে চসিক আইন লঙ্ঘনের এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ফলে পাথরঘাটাসহ আশপাশের এলাকায় সংক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে অভিমত জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

চসিকের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, নগরীর পাথরঘাটায় জাইকার অর্থায়নে ৯ কোটি ৫২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয়ে রবীন্দ্র-নজরুল কিন্ডারগার্টেন ও পাথরঘাটা সিটি করপোরেশন বালক উচ্চ বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টারের পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে পশ্চিম মাদারবাড়িতে ৫ কোটি ৪২ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টার এবং পূর্ব মাদারবাড়িতে ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টারের নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পাথরঘাটায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দর্শকসারির ছবিতে দেখা গেছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ দুই শতাধিক লোক উপস্থিত রয়েছেন। শ’-খানেক শিক্ষার্থী বসেছেন স্কুলের পোশাক পরিহিত অবস্থায়। সেইসঙ্গে রয়েছেন বিভিন্নবয়সী আরও নারী-পুরুষ। সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব মেনে দর্শকসারিতে চেয়ার বসানো হয়নি। ফলে জটলা তৈরি হয়েছে। তবে তাদের মুখে মাস্ক দেখা গেছে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাথরঘাটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ইসমাইল হোসেন বালি। প্রধান অতিথি ছিলেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোছাম্মৎ লুৎফুন্নেছা দোভাষ বেবী।

বিজ্ঞাপন

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বন্ধ থাকা স্কুলের ছাত্রদের অনুষ্ঠানে হাজির করা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন বালি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রদের আমি দাওয়াত করে আনিনি। ৫০-৬০ জন ছাত্র হঠাৎ করে অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়েছে। তাদের তো বের করে দিতে পারি না। যেসব ছাত্ররা এসেছে, তাদের সবার বাসা স্কুলের আশপাশে। এলাকায় তাদের স্কুলভবন উদ্বোধন হচ্ছে জানতে পেরে তারা চলে আসে।’

আকস্মিকভাবে ঢুকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পরনে স্কুলের পোশাক ছিল কেন জানতে চাইলে কাউন্সিলর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুবর্ণা ভট্টাচার্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাউন্সিলর মহোদয় আমাদের বলেছেন, ছাত্রদের অনুষ্ঠানে আনার জন্য। আমি স্বাস্থ্যবিধির কথা চিন্তা করে প্রত্যেক শ্রেণি থেকে শুধুমাত্র ১০ জন করে সুস্থ ছাত্রকে অনুষ্ঠানে আসতে বলি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তিন ফুট দূরত্বে চেয়ার বসানো হয়েছিল। কিন্তু মেয়র মহোদয় আসার পর হঠাৎ করে একসঙ্গে ছাত্ররা ঢুকে যাওয়ায় অনুষ্ঠানস্থলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি আর মানা যায়নি।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি অনুষ্ঠানে যাইনি। সেখানে স্কুলের ছাত্রদের আসতে বলা হয়েছে, এমন কোনো তথ্য আমার কাছে ছিল না। এ বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলেনি। এখন আমি যেহেতু বিষয়টি জানতে পেরেছি, আমি অবশ্যই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে কৈফিয়ত চাইবো।’

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর সরকারিভাবে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে, তাতে জনসমাবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এই ধরনের কোনো মিটিং আয়োজন করা হলে, এটা সরকারি নির্দেশনার লঙ্ঘন। তবে সেটা খতিয়ে দেখা স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ নয়। প্রশাসনের উচিত বিষয়টি খতিয়ে দেখা।’

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৪১ ধারার তৃতীয় তফসিলে সিটি করপোরেশনের মোট ২৮ ধরনের দায়িত্বের কথা উল্লেখ আছে, যার শুরু হয়েছে জনস্বাস্থ্য দিয়ে। তৃতীয় তফসিলের ১ (১) ধারায় বলা হয়েছে, করপোরেশন নগরীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য দায়ী থাকবে। একই তফসিলের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন নগরীতে সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করবে।

করোনা মোকাবেলায় গঠিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। মহামারি পরিস্থিতিতে তাদের দায়িত্ব কি সেটা বিধিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন জড়ো করে যে সমাবেশ করেছে, সেটা স্পষ্টত বিধির লঙ্ঘন। তারা স্থানীয় সরকার আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। এই সমাবেশের ফলে পাথরঘাটাসহ আশপাশের এলাকায় করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে পারে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

পাথরঘাটার পাশাপাশি পূর্ব ও পশ্চিম মাদারবাড়িতেও একইভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে সেখানে শিক্ষার্থীর সমাগম হয়নি বলে জানা গেছে। এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নীলু নাগ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাদারবাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা ছিল না। এখানে বড় কোনো জনসমাগমও ছিল না। শুধু উদ্বোধনের পর সংক্ষিপ্ত আকারে দোয়া মাহফিল হয়েছে।’

পাথরঘাটায় অনুষ্ঠানে যাওয়া চসিকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এবং শিক্ষার্থীদের জড়ো করে অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও বিরক্ত হন। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকদের কাছে মেয়র এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন