বিজ্ঞাপন

ওজন নিয়ন্ত্রণে ন্যাচারোপ্যাথি

October 24, 2020 | 4:20 pm

ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার

মিস বুশরা কয়েক মিনিট হাঁটাহাটি করে কাজ করলেই হয়রান হয়ে পড়েন, প্রচুর ঘামতে শুরু করেন। শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসে। সিড়ি বেয়ে ওঠানামা করতে কষ্ট হয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে কোমর, হাঁটুতে ব্যথা হতে থাকে। ফ্যান আর এসি ছাড়া কয়েক মিনিটও থাকতে পারেন না, অসহ্য গরম লাগে, দরদর করে ঘামতে থাকেন। অফিসের চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার পর বাসায় ফেরার সময় দেখা যায় পায়ের পাতা দুটো ফুলে গেছে। প্রায়ই রাত দুইটা আড়াইটার দিকে ঘুম ভেঙে যায়। ইদানিং একটু পর পর খেতে ইচ্ছা করে এবং খান। উরুতে চামড়া ফেটে যাওয়ার মতো সাদা সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে। মিস বুশরার বয়স ৩৫ বছর। একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালনা করেন। এ বছর জুন মাসে অস্বস্তিকর এসব শারীরিক সমস্যার সমাধানের জন্য পরামর্শ নিতে আসেন আমার কাছে।

বিজ্ঞাপন

বুশরার উচ্চতা পাঁচ ফুট ২ ইঞ্চি, ওজন ৮০ কেজি। তের মাস আগে ওনার ওজন ছিল ৬০ কেজি। উচ্চতা অনুযায়ী ওনার ওজন হওয়া দরকার ৫৫ কেজি। ২৫ কেজি বাড়তি ওজন ওনাকে মেদবহুল গোলগাল শরীরসহ উপরের অস্বস্তিকর সমস্যাগুলোর শিকার করেছে। বুশরার অতিরিক্ত ওজন আর মেদ বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি, প্রায় দেড় বছর আগে তার বিয়ের সম্পর্কটি ভেঙে যায়। এই ঘটনাটি ঘটার আগে উনি একটি স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতেন। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, নিয়মিত হাঁটা এবং ব্যয়াম করতেন। উনি হেলদি খাদ্যাভ্যাসেও অভ্যস্ত ছিলেন। ডিভোর্সের পর ওনার লাইফস্টাইলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। বাসস্থানের আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে ওনার রুটিনমাফিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হয়। আকস্মিক মানসিক আঘাত এবং পরিচিত মানুষদের নানা কথা এবং আচরণে তার ব্যক্তিজীবন অগোছালো হয়ে যায়। চিন্তার বিক্ষিপ্ততা এড়ানোর জন্য মিস বুশরা অফিসে অতিরিক্ত সময় কাটাতে থাকেন। দিনের বেশির ভাগ সময় চেয়ার টেবিল কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। ফাস্টফুড, কোল্ড ড্রিঙ্কস, কফি হয়ে যায় নিয়মিত খাবার। আগের মতো কাজ করার ইচ্ছা এবং শক্তি হারিয়ে যাচ্ছিল। উনি বুঝতে পারছিলেন এই অবস্থা চলতে থাকলে উনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বেন।
মিস বুশরার হিস্ট্রি জেনে এবং বর্তমান বাস্তবতা অনুযায়ী ওনাকে তিন মাসের একটি ন্যাচারোপ্যাথি গাইডলাইন দেই।

জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে উনি এই গাইডলাইন মেনে চলা শুরু করেন। বর্তমানে ওনার ওজন ৫৮ কেজি। উনি লিফট নয় সিড়ি বেয়ে অফিসে ওঠেন। হাসিমুখে হেঁটে-চলে, প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে ৯ টা থেকে ৫ টা অফিস করেন। কাজের মান ফিরে এসেছে। জীবনে স্বস্তি অনুভব করেন।
মিস বুশরা কি গাইডলাইন ফলো করে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসের মধ্যে ওনার ওজন ২২ কেজি কমালেন এবং একটা স্ট্রেসফুল লাইফ থেকে কিভাবে ব্যালেন্সড লাইফে ফিরলেন সেটা জানি চলুন।

দৈনন্দিন রুটিন (১ম মাস, জুলাই)
– সকাল ৪:৩০ ঘুম থেকে ওঠা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে এক গ্লাস হালকা গরম পানিতে এক টেবিল চামচ লেবুর রস আর এক চা চামচ খাঁটি মধু দিয়ে পান করা।
– ১০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করে সারারাত ভিজানো ৫ টা কাঠবাদাম আর একমুঠো অঙ্কুরিত মুগ খাওয়া।
– নামাজ আদায় করে এক কাপ কলমী শাকের রসে এক চা চামচ ফ্যাট বার্নার (মেদ কাটানোর হারবাল) দিয়ে পান করা।
ইয়োগা
– শরীর ওয়ার্ম আপ করে, ৫ রাউন্ড সূর্য নমস্কার ইয়োগিক এক্সারসাইজ করা।
কপালভাতি ক্রিয়া অনুশীলন করা দুইবার, প্রথমে ৩০ বার দ্বিতীয় বার ৩০ বার। ধীরে ধীরে ৬০ বার করে করা।
ভ্রামরী প্রাণায়াম করা ৬ বার।
– নাস্তায় একটা লাল আটার রুটি, রান্না করা একবাটি ছোলা, সবজি সেদ্ধ। একটা আপেল।
– বেলা ১১ টায় একবাটি টক ফল।
– দুপুরের খাবারে ছোট এক বাটি ভাত, শাক, কাঁচা রসুন দুই কোয়া, দেশি মাছ বা মুরগির গোশত, মুগ ডাল এক কাপ পরিমাণ। খাবার শেষে দুই পিস কাঁচা পেঁপে খাওয়া।
– বিকেলের নাস্তায় এক বাটি পাকা পেঁপে খাওয়া।
– বাসায় ফিরে পরিচ্ছন্ন হয়ে এক ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়া। তারপর ৩০ মিনিট ইয়োগা করা।
– হালকা গরম আদা পানি পান করা।
– রাতের খাবারে একটা রুটি আর ৪০০ গ্রাম লাউয়ের তরকারি খাওয়া (রাত ৮ টায় খাওয়া শেষ)।
– রাত ১০ টায় ঘুমাতে যাওয়া। ঘুমানোর আগে ক্ষুধা পেলে গাজর খাওয়া।

বিজ্ঞাপন

সপ্তাহের শুক্রবার রোজা রাখা
প্রতি শনিবার সুইডিশ মাসাজ আর স্টিম বাথ নিয়েছেন। আর এইদিন শুধু পাতলা খিচুড়ি খেয়েছেন।

উপরের গাইডলাইন মেনে চলার জন্য দৃঢ় সংকল্প আর কঠিন মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়, যা মিস বুশরার ছিল। যেহেতু উনি এক বছরের বেশি সময় একটা ভিন্ন জীবন এবং খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত ছিলেন এই গাইডলাইন মেনে চলা ওনার জন্য সহজ ছিলনা। উনি জানাতেন ওনার ঘন ঘন খিদে পায়। আমি বলতাম খিদে পেলেই হালকা গরম পানি খাবেন চায়ের মতো চুমুক দিয়ে দিয়ে। মাঝে মাঝে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে খাবেন। উনি তাই করতেন। ৩০ মিনিট পর পর চেয়ার ছেড়ে উঠে হাঁটাহাঁটি আর শরীর নড়াচড়া করা ছিলো বাধ্যতামূলক ওনার জন্য।

ফলাফল
মাস শেষে ওজন ৪ কেজি কমে যায়। অস্থির লাগা কমেছে। কোমর ব্যথা নেই। মাঝরাতে ঘুম ভাঙে না আর।

বিজ্ঞাপন

দৈনন্দিন রুটিন (২য় মাস আগস্ট)
– সকালের রুটিন প্রথম মাসের মতোই, তবে সূর্য নমস্কার ইয়োগা এ মাস থেকে ১০ রাউন্ড। এ মাসে কপাল ভাতি প্রাণায়াম প্রথম কয়েকদিন ৮০ বার করা তারপর থেকে ১২০ বার করে করা।
– এ মাসে ওনাকে অফিস থেকে সাত দিনের ছুটি নিতে বলি। এই সাত দিন যা যা করলেন—
১ম দিন রোজা রাখা।
২য় দিন সারাদিন দুই ঘন্টা পর পর লেবু পানি পান করে থাকা।
৩য় দিন সারাদিন দুই ঘন্টা পর পর আনারসের রস পান করে থাকা।
৪র্থ দিন সারাদিন দুই ঘন্টা পর পর আপেলের জুস পান করে থাকা।

এই চারদিনের প্রথম দিন ড্রাই ফাস্টিং আর বাকি তিনদিন ফ্রুট জুস ফাস্টিং পালনের সময় মিস বুশরা সম্পূর্ণ বিশ্রামে ছিলেন। ঘরের বাইরে বের হননি, টিভি দেখেননি, ফোন, মোবাইল, ল্যাপটপ চালাননি। নিরবতা পালন করেছেন। কোন ইয়োগাও করেননি। ফাস্টিং শেষে ৫ম দিন সারাদিন সবজি সিদ্ধ আর হালকা গরম পানি, মাঝে মাঝে লেবু পানি খেয়েছেন।

৬ষ্ঠ দিন জাউ ভাত আর সবজি।
৭ম দিন ১ম মাসের খাবারের নিয়মে ফিরে এসেছেন।
৮ম দিন থেকে রুটিনে কিছু পরিবর্তনসহ আরও কিছু নতুন নিয়মে ফিরে এসেছেন।
দ্বিতীয় মাসে ওনার আরও ৬ কেজি ৭০০ গ্রাম ওজন কমে যায়। এ মাসে ওজন হয় ৬৯ কেজি ৩০০ গ্রাম।

ফাস্টিং থেরাপি ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসার একটি অত্যন্ত কার্যকরি পদ্ধতি। এতে শুধু ওজন আর মেদই কমে না অন্যান্য রোগ নিরাময়েও উপকারি। বয়স, শারীরিক অবস্থা এবং জলবায়ু বিবেচনা করে ব্যক্তি এবং রোগভেদে ফাস্টিং থেরাপি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

৩য় মাস (সেপ্টেম্বর)
– প্রথম ১৮ দিন সকালে ২ ঘন্টা ইয়োগিক এক্সারসাইজ করেছেন।
– বিকেলে ৩০ মিনিট হেঁটেছেন।
– এই ১৮ দিন কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, ভেজিটেবল, ফ্রুট বেইজড ডায়েট গ্রহণ করেছেন।
– এ মাসের ১৯ তারিখ রাতের খাবারে লবণ ছাড়া রান্না করা আতপ চাল, মুগ ডাল, ঘি আর বাটার দিয়ে তৈরি বিশেষ খিচুড়ি খেয়েছেন। পরের দিনের বিশেষ থেরাপির জন্য।
– ২০ তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠে শঙ্খপ্রক্শালনা নামে একটি ইয়োগিক ক্রিয়া করাই ওনাকে। যা করার মধ্য দিয়ে ওনার অন্ত্রের সব পুরনো বর্জ্য সাফ হয়ে যায় এবং শরীরের জমা অতিরিক্ত পানি, মেদ আর টক্সিনও অনেকটা বের হয়ে আসে। এই ক্রিয়া করার পর সারাদিন উনি বিশেষ খাবার আর বিশ্রামে থাকেন।
– ২১ থেকে ৩০ তারিখ দশদিন উনি আকুপাংচার থেরাপি নেন।

অক্টোবর মাসের ১ তারিখ মিস বুশরার ওজন হয় ৫৮ কেজি। ওনাকে বেশ কয়েকটা জামা নতুন মাপে বানাতে হয়েছে। কারণ মোটা থাকা অবস্থার জামাগুলো এখন আর গায়ে লাগে না। ওনার শারীরিক শক্তি বেড়েছে, ক্লান্তি, দুর্বল লাগা নেই। কোমর আর হাঁটুর ব্যথা ভালো হয়ে গেছে। উনি আর এসি ব্যবহার করেন না। লিফটে চড়েন না। একটানা ৩০ সেকেন্ড অনায়াসে দম বন্ধ রেখে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যয়াম অনুশীলন করতে পারেন। মানসিক শক্তি ফিরে পেয়েছেন। কেউ ওনার ব্যক্তিজীবন নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বা মন্তব্য করলে অস্থির বা রেগে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় হেসে তা ম্যানেজ করতে পারেন। উনি এখন ঝরঝরে শরীরের সুস্থ একজন মানুষ। মিস বুশরা জীবনকে জীবনের আনন্দে উপভোগ করতে চাইতেন আর এই বোধশক্তিই ওনাকে সফল করেছে, ফিরে পেয়েছেন সুস্থ, সুন্দর কাঙ্খিত জীবন আনন্দ।

প্রতিটি মানুষের তার উচ্চতা অনুযায়ী শরীরের ওজন থাকা দরকার। আজকাল মানুষ যেসব রোগে ভুগছে তার অধিকাংশই লাইফস্টাইল ডিজঅর্ডার। আর এসব রোগ হওয়ার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত ওজন আর অস্বাভাবিক মেদ। যেমন—
– ডায়াবেটিস
– উচ্চ রক্তচাপ
– ইনসুলিন রেসিস্টেন্স
– থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা
– পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOD)
– ইউটেরাস ফাইব্রয়েড
– ইনফার্টিলিটি
– ব্রেস্ট সিস্ট
– ব্রেস্ট ক্যানসারসহ
– কোমর ব্যথা, হাঁটু ব্যথা। আরও নানা রোগব্যধির মূল কারণ মেদ বৃদ্ধি আর ওজন বেড়ে যাওয়া।

ওবেসিটি/Obesity
মিস বুশরা এখন স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে ফিরে এসেছেন। তবে বাইরের কৌটা এবং প্যাকেটজাত কোন খাবার উনি খান না। রাতের খাবার ৮ টায় শেষ করেন। নিয়মিত ইয়োগা, মেডিটেশন করেন। সপ্তাহে ১ দিন ফাস্টিং করেন।

প্রকৃতি নির্দিষ্ট নিয়মে চলে, সকালে সূর্য উঠে, রাতের আকাশে চাঁদ, তারা। ছয় ঋতুর ছয় ভাব। মানুষ প্রকৃতিরই অংশ আর তাই মানুষের শরীরও প্রাকৃতিকভাবে প্রোগ্রামড। প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালেই শরীর রোগগ্রস্ত হয়। প্রাকৃতিক নিয়মের বিজ্ঞানসম্মত অনুশীলনই হলো ন্যাচারোপ্যাথি মেডিসিন। যার মূল লক্ষ্য হল সুস্থ শরীর, সুস্থ সমাজ, সুন্দর পৃথিবী উপভোগ করা।

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন