বিজ্ঞাপন

হাওরে আক্রান্ত ৬৮০০ হেক্টর জমির বোরো ধান, বন্যার শঙ্কা!

April 10, 2022 | 10:41 pm

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে বাঁধ ভেঙে হাওরের ৬ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এসব জমির কিছু অংশ আংশিক এবং কিছু অংশ পুরোপুরি তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ। এই জেলায় ৫ হাজার ৫০ হেক্টর বোরো জমি তলিয়ে গেছে। এছাড়া সিলেটে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ২১০ হেক্টর জমি। কিশোরগঞ্জে আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৩৭৯ হেক্টর।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, এর মধ্যে সিলেটের হাওরাঞ্চেলে পানি কমলেও সুনামগঞ্জে এখনো পানি বাড়ছে। আগামী সপ্তাহের শেষ দিকে বন্যার শঙ্কা রয়েছে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও। ভারত ও বাংলাদেশে আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির শঙ্কাও রয়েছে। সবমিলিয়ে হাওরের বোরো ধান ঘরে তোলা নিয়ে আবারও নতুন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ (রোববার) পর্যন্ত পরিস্থিতি ভালো ছিল। কিন্তু আগামীকাল (সোমবার) থেকে পানি বাড়তে থাকবে। সামনের দিনগুলোতে পানি বাড়বে। এই সপ্তাহের শেষ দিকে বন্যার আশঙ্কা আছে।’

দেশের হাওর অঞ্চলের নদ-নদীর পরিস্থিতি পূর্বাভাস সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সমতল কমছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় বাড়তে পারে। অন্যদিকে বহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং তৎসংলঘ্ন ভারতের আসাম ও মেঘালয় প্রদেশে কিছু স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার নদ-নদীর পানি সমতল কয়েক পয়েন্টে দ্রুত বাড়তে পারে এবং বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।

আরও পড়ুন-

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে বৃষ্টি হলে ফসলের তেমন ক্ষতি হবে না। তবে উজানে বেশি বৃষ্টি হলে ক্ষতি হবে। আমরা জেনেছি, উজানে আগামী ছয় দিনে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তবে আশার কথা, সম্প্রতি যে ঢল এসেছে ওই সময় ১ হাজার মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, ভারতে ছয় দিন বৃষ্টি হতে পারে। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০ মিলিমিটার করে বৃষ্টি হলে তেমন কোনো শঙ্কা নেই। কিন্তু এর চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলে আমাদের অনেক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে বেনজীর আলম বলেন, ধান তো আসলে খুব সামান্য পেকেছে। ৮০ শতাংশ পাকলে ধান কাটা যায়। সেই অর্থে এখনো ধান পাকেনি। দুই থেকে চার দিন পর ধান কাটা শুরু হবে। এসময় হঠাৎ বন্যা হলে ক্ষতি বেড়ে যাবে।

কৃষকদের কী ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে— জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, যেখানে বাঁধ ভাঙার সম্ভাবনা আছে সেখানে পাহারা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা আছে— এমন যায়গায় ফসল পেকে থাকলে তা দ্রুত কেটে ফেলতে বলা হচ্ছে। এছাড়া আমরা প্রচুর কৃষি যন্ত্র দিয়েছে। কোনো কোনো উপজেলায় ৮৫টি পর্যন্ত হারভেস্টার (ধান কাটার যন্ত্র) দেওয়া হয়েছে। যদি পানি ধীরে ধীরে আসে, তাহলে হয়তো ধান কেটে ফেলা সম্ভব হবে।

বিজ্ঞাপন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্য বলছে, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে দেশের ছয় জেলা— সিলেট, সুনমাগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও লালমনিরহাটে বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে। এই ছয় জেলার ৮ লাখ ৫৬ হাজার ২৩ হেক্টর জমির মধ্যে ৬ হাজার ৭৯৮ হেক্টর বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ। এই জেলায় ৫ হাজার ৫০ হেক্টর বোরো জমি তলিয়ে গেছে। এছাড়া সিলেটে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ২১০ হেক্টর জমি। কিশোরগঞ্জে আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৩৭৯ হেক্টর। নেত্রকোনায় ১৩৩ হেক্টর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৮ হেক্টর ও লালমনিরহাটে ১৮ হেক্টর বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, হাওরের জেলাগুলোতে আরও সপ্তাহখানেক পর ধান কাটা শুরু হওয়ার কথা। স্থানীয় জাতের কিছু ধান কাটা শুরু হয়েছে, যেটি আমলে নেওয়ার মতো নয়।

এ বিষয়ে এর আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক সারাবাংলাকে জানান, হাওরবেষ্টিত সাত জেলায় সাড়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর বোরো জমি ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৭ সালে ২ লাখ ১০ হাজার হেক্টর বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে বছরই বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ২ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হলে খাদ্য উৎপাদন শঙ্কায় পড়বে।

জানতে চাইলে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের তেতুলিয়ার কৃষক শকিফুল সারাবাংলাকে বলেন, নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে তেমনভাবে বাঁধ ভাঙেনি। তবে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধান চিটা হয়ে গেছে। তবে ধান এরই মধ্যে পাকতে শুরু করেছে। এখন পুরোদমে ধান কাটা চলছে।

নেত্রকোনার আরেক কৃষক কাজল। তার জমি রয়েছে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। কালবৈশাখী শুরু হয়ে গেছে। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সুনামগঞ্জের হাওরে পানি কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখন আবার পানি বাড়তে শুরু করেছে। আমরা খুবই শঙ্কায় আছি।

এদিকে সুনামগঞ্জ থেকে সারাবাংলার ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট আল হাবিব জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢল ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে এরই মধ্যে জেলার বিভিন্ন হাওরের বাঁধ ভেঙে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লা ও ছাতক উপজেলার মোট ছোট-বড় ১১টি হাওরের অন্তত ৮ হাজার হেক্টর কাঁচা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় কৃষকরা।

প্রতিনিধি জানান, রোববার (১০ এপ্রিল) ভোর থেকে সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সেই বৃষ্টিতে নদীর পানি কিছুটা বেড়ে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার হরমোনিয়া হাওরে ফাটল ধরে করচার হাওরের প্রায় ৪ হাজার হেক্টর বোরো ধান হুমকির মুখে পড়েছে। ধান বাঁচাতে বাঁধে স্বেচ্ছায় শ্রম দিচ্ছেন কৃষকরা।

শুধু করচার হাওর নয়, জেলার ঝুঁকিপূর্ণ কোনো বাঁধ যেন না ভাঙে, সেজন্য বাঁধ রক্ষায় প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। বাঁধ রক্ষায় রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে উল্লেখ করে কৃষকরা জানিয়েছেন, সারারাত না ঘুমিয়ে তারা হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে পাহারা দিচ্ছেন।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, রোববার সকাল ৯টায় সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১১৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ৪ দশমিক ৮৭ মিটার ও যাদুকাটা নদীর পানি বিপদসীমার ১৪৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ৪ দশমিক ৪৭ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেক্ষেত্রে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম।

এদিকে, নেত্রকোনা থেকে সারাবাংলার ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট বিজয় দাস জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢলে গত এক সপ্তাহে জেলার দুই উপজেলায় হাওরের পানি বেড়ে প্রায় ১৩৩ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। তবে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের পাশাপাশি ধনু নদীর পানি কমতে শুরু করায় হুমকির মুখে থাকা কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। রোববার দুপুরে ধনু নদীতে বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড।

নেত্রকোনা জেলার কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, এ বছর জেলায় ১ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত দুই দিন ধনু নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে খালিয়াজুরি উপজেলার ১২৩ হেক্টর ও মদন উপজেলায় ১০ হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে আবাদ বেশি হওয়ায় পানিতে ধান তলিয়ে গেলও আগামী এক সপ্তাহ বন্যা না হলে কৃষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ফসল সুষ্ঠুভাবে ঘরে তুলতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে খালিয়াজুরী উপজেলার কীর্তনখোলা বাঁধের কয়েকটি অংশে ফাটল দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন,পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় গ্রামবাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় গ্রামবাসী দিনরাত অবস্থান করে বাঁধের সুরক্ষায় কাজ অব্যাহত রেখেছেন। কিছু কিছু হাওরে কাঁচা ধান কেটে ঘরে তুলছেন কৃষকরা।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন