বিজ্ঞাপন

কুসিক নির্বাচনের ‘চাঁদ রাতে’র আগেও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

June 14, 2022 | 11:19 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

কুমিল্লা থেকে: ইদুল ফিতরের আগের রাতে চাঁদ দেখার জন্য পরিবার ও বন্ধুরা একসঙ্গে জড়ো হয়ে থাকেন। রমজানের শেষ দিন শেষে নতুন চাঁদ দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে সেই অপেক্ষা সবার। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) নির্বাচনের আগেও শোনা গেলো সেই ‘চাঁদ রাতে’র কথা। সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনের সময় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানাও গেল এই ‘চাঁদ রাতে’র মাহাত্ম্য। তারা বলছেন, নতুন চাঁদ দেখার উপলক্ষ নয়, বরং এই ‘চাঁদ রাত’ হচ্ছে ভোটের আগের রাত, যে রাতে বিভিন্ন প্রার্থীদের পক্ষে কর্মী-সমর্থকরা ভোটারদের মাঝে টাকা বিলিয়ে থাকেন! সেইসঙ্গে শেষবারের মতো ভোটারদের কাছে ভোটও চাওয়া হয় এই রাতে। ভোট নিশ্চিত করার জন্য দেওয়া হয় টাকা, করানো হয় নানা রকমের শপথ।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচনি আইন বা প্রচলিত কোনো বিধানেই ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও ‘চাঁদ রাত’ নিয়ে ভোটারদের বক্তব্য যে ফেলনা নয়, তার প্রমাণ মিলল প্রার্থীদের কাছেও। মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরাও একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছেন টাকার ছড়াছড়ি নিয়ে। প্রার্থীরা সবাই নিজেদের জয়ের বিষয়ে আশাবাদী হলেও বলছেন, ‘চাঁদ রাতে’ টাকা-পয়সার বিনিময় আটকানো না গেলে ‘বিপদ’ হতে পারে।

নির্বাচনের প্রচারণা শেষ হলেও মঙ্গলবার (১৪ জুন) আলাদা আলাদাভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন মেয়র প্রার্থীরা। এসময় ভোটের মাঠে নানাভাবে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ করেন তারা। শুধু ভোটারদের মাঝেই নয়, প্রশাসনের মাঝেও টাকা ছড়ানোর অভিযোগ প্রার্থীদের!

আরও পড়ুন- সাক্কুর হ্যাটট্রিকে রিফাত-বাধা, চমকে দিতে পারেন কায়সারও

বিজ্ঞাপন

এদিন আরফানুল হক রিফাত অভিযোগ করে বলেন, ভোটের মাঠে সমানে কালো টাকা ছড়াচ্ছেন সাক্কু। তার দাবি, মেয়র থাকার সময় দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ আয়ের টাকাই এখন ছড়ানো হচ্ছে ভোটারদের মাঝে।

রিফাত বলেন, ভোটের দিন কুমিল্লার ভোটকেন্দ্রগুলোর পরিবেশ শান্ত থাকবে। কিন্তু সেদিন যদি কেউ ভোটকেন্দ্রে বা এর আশপাশে কালো টাকার ছড়াছড়ি করতে যায়, জনতা তাদের প্রতিহত করবে। এর দায়দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। আমার প্রতিপক্ষ প্রার্থী সারা শহরেই কালো টাকা ছড়াচ্ছে। এমনকি আমি এমনও অভিযোগ পেয়েছি, আমার দলের কর্মীদের টাকা অফার করা হচ্ছে।

প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের নিজ দল বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সুবিধা পাবে বলে মনে করছেন রিফাত। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো কেন্দ্র দখল করবে না। বরং বিএনপির দুই প্রার্থীর দ্বন্দ্বে নৌকা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। আমরা নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। তবে নির্বাচনে অন্য কেউ বিজয়ী হলে আমি ফুলের মালা দিয়ে তাকে বরণ করে নেব।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- প্রথম নির্বাচনেই চ্যালেঞ্জের মুখে নতুন ইসি!

স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের নির্বাচনি এলাকায় অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রিফাত বলেন, নিজেদের ইমেজ রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন একজন এমপিকে, মেয়র প্রার্থীকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন তাদের ক্লিন ইমেজ তৈরি করার জন্য কুমিল্লায় আমাকে জবাই করতে চাচ্ছে। তাদের বলব, আপনারা সরকার পক্ষের কেউ না, বিরোধী পক্ষেরও কেউ না। সারাবিশ্বে আপনারা আপনাদের পরিচয় দিন যে একদম নিরপেক্ষ কাজ করছেন। কুমিল্লায় উনাদের প্রথম নির্বাচন, প্রথম পরীক্ষা এটা। এজন্য কি আমাকে জবাই দিয়ে উনারা প্রমাণ করবেন তারা নিরপেক্ষ?

তবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মনিরুল হক সাক্কু। তিনি বলেন, কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন। যারা অভিযোগ করছেন তারাই বরং কালো টাকার ব্যবহার করছেন। মানুষ আমাকে এমনিতেই ভালোবাসেন, আমাকে তাদের টাকা দিতে হয় না। আমার প্রতিপক্ষ টাকা নিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন— এমন খবর আমার কাছে আছে।

তিনি আরও বলেন, আমি জানি আমার বাসার সামনে লোকজন আছে। আমিও তো বলতে পারি, উনি টাকা ছড়াচ্ছেন। কিন্তু এ ধরনের কথা বলা ঠিক না। ইলেকশনে টাকা ছড়াছড়ি হলে হাতে-নাতে ধরে প্রমাণ করুক। তিনি (রিফাত) শুরু থেকেই আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে আসছেন। একবার বলছেন আমি দুর্নীতি করেছি। এখন বলছেন টাকা ছিটাচ্ছি। তার কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে? প্রমাণ ছাড়া কথা বলে লাভ নাই, আমি টাকা ছড়াই নাই। আমি মিথ্যা কথার মানুষ না, মিথ্যা বলি না। আমি দুর্নীতি করে থাকলে একটা কাগজ উনি দেখাক। ইলেকশনের পরে শ্বেতপত্র কেন প্রকাশ করবেন? আজ প্রমাণ দিন, আমি নির্বাচন ছেড়ে চলে যাব।

বিজ্ঞাপন

মনিরুল হক সাক্কু বলেন, নির্বাচনে কাকে ভোট দেবে, জনগণ সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন নির্বাচনি পরিবেশের ব্যাপার। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলে জনগণ কেন্দ্রে যাবে, ভোট দেবে। এর আগের নির্বাচনে দেখেছি কেন্দ্রের সামনে তিন থেকে চারশ লোক দাঁড়িয়ে থাকে। এতে ভোটের পরিবেশ নষ্ট হয়, ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে ভয় পায়। এখন নির্বাচন কমিশন অনেক আশ্বাস দিচ্ছে। যদি তা প্রয়োগ না হয়, তাহলে আমি কীভাবে বলব যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে?

আরও পড়ুন- রাত পোহালেই কুমিল্লা সিটির ভোট

নির্বাচনে যেকোনো ফলাফল মেনে নেবেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে সাক্কু বলেন, ভোটারদের উপস্থিতি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে অবশ্যই মেনে নেব। কিন্তু ভোটাররা যদি কেন্দ্রে যেতে না পারে, ভোট দিতে না পারে, ভোটারবিহীন নির্বাচন যদি হয়, আমি মেনে নেব না।

নিজ দলের নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সারের প্রার্থিতা কোনো সমস্যা তৈরি করবে কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে সাক্কু বলেন, তারা (কায়সারের সমর্থকরা) কখনোই আমাকে ভোট দিত না। এবার কায়সারের ভোট নৌকায় যাবে না, উনার ভোট উনার কাছে যাবে— এটি বরং আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট।

এদিকে, টাকা ছড়ানো নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার। নগরীর ধর্মসাগর পাড়ের নির্বাচনি কার্যালয়ে স্বতন্ত্র এই মেয়র প্রার্থী বলেন, আমার কোনো কালো টাকা নেই। তাই ব্যবহার করার প্রশ্ন আসে না। প্রতিপক্ষ দুই প্রার্থীর কালো টাকা আছে, তারা টাকা বিলি করছেন— এমন খবর মাঠ থেকে বিভিন্নভাবে আসছে।

ভোটের আগের দিন নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করে কায়সার বলেন, নির্বাচন কমিশন কথা রাখছে না। এ পর্যন্ত একজন এমপিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি কমিশন। ইসির এই অসহায়ত্বে ভোটারদের মনে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ভোটের দিন অফিস-আদালত খোলা রাখা হয়েছে, যেন ভোটার উপস্থিতি কম হয়। অফিস-আদালতে কর্মরত ভোটাররা যেন ভোট দিতে না পারে, তাই সব খোলা রাখার সিদ্ধান্ত রাখা হয়েছে।

ইভিএম বিষয়ে কায়সার বলেন, আমি গতকাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছিলাম যেন ভোটের চূড়ান্ত ফল প্রিন্ট আকারে দেওয়া হয়। কিন্তু ইতিবাচক সাড়া এখন অবধি পাইনি। এটা কমিশনের পাঁয়তারা করে ভোট চুরির একটি চক্রান্ত। হাতে লিখে ফলাফল বিবরণী দিলে তাতে কারচুপির আশঙ্কা রয়েছে বলেই প্রিন্ট আকারে ফলাফল ঘোষণার দাবি তোলেন তিনি।

প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কায়সার বলেন, সাবেক মেয়র সাক্কু সাহেব ও রিফাত সাহেব দু’জন একই সুতোয় বাঁধা। প্রশাসন নিরপেক্ষ থেকে অংশগ্রহণমূলক ভোটগ্রহণ হলে আমি ওই দুই প্রার্থী যা ভোট পাবে, তার চেয়ে দ্বিগুণ ভোট বেশি পাব ইনশাআল্লাহ।

এ দিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে কুমিল্লা পুলিশ ও জেলা প্রশাসন। কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ বলেন, সিটি নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন হাজার ৬০৮ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। ৭৫টি চেকপোস্ট, ১০৫টি মোবাইল টিম, ১২ প্লাটুন বিজিবি, ৩০টি র‍্যাবের টিম, অর্ধশতাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৯ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভোটের মাঠে থাকছেন।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, কীভাবে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করা যায় তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেভাবেই আমরা কাজ করে পরিকল্পনা সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি।

কুসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরীও সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের বিষয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রেই পর্যাপ্ত পুলিশ, আনসার, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। জেলা প্রশাসক, পুলিশের কর্মকর্তারা সবাই সজাগ থাকবেন। এছাড়া নগরীর প্রবেশপথসহ বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, যেন যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। আমি আশাবাদী, একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পারবে।

কুসিকের তৃতীয় এই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পাঁচ জন প্রার্থী। এছাড়াও কাউন্সিলর পদে ১০৮ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৩৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এবার এই সিটিতে ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হবে। এই সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০। এর মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ১৭ হাজার ৯২, পুরুষ ভোটার এক লাখ ১২ হাজার ৮২৬।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এটি তৃতীয় নির্বাচন। এর আগে দুই নির্বাচনেই মেয়র পদে ভোটে নির্বাচিত হন মনিরুল হক সাক্কু। প্রথমবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং দ্বিতীয়বার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন