বিজ্ঞাপন

ক্রমেই বিবর্ণ বিপিএল

January 5, 2023 | 2:51 pm

মাহমুদুল হাসান শামীম

জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে ২০১২ সালে শুরু হয়েছিল দেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ-বিপিএল। উদ্যোক্তা ছিলেন সে সময়ের বিসিবি প্রেসিডেন্ট আহম মুস্তফা কামাল। শুরুতে এটিকে আইপিএল এর পরেই ভাবা হতো। আট পেরিয়ে এবার নবম আসরে এসে বিপিএলকে বিগব্যাশ, পিসিএল তো নয়ই নতুন দুই আসর দুবাই ও দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের সঙ্গেও তুলনা করা হচ্ছে না। আর জাতীয় দলের অধিনায়ক সকিব আল হাসান তো বিপিএলকে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে তুলনা করতেও নারাজ। অনেক স্বপ্ন ও সম্ভাবনার আলো ছড়িয়ে শুরু হওয়া বিপিএল এর এই দুরাবস্থা কেন? উত্তর একটিই- বিসিবি কর্তাদের নীতি ও পরিকল্পনাগত ব্যর্থতা। সেই সঙ্গে সদিচ্ছার অভাব।

বিজ্ঞাপন

নীতি ও পরিকল্পনাগত ব্যর্থতা
বিসিবির স্পনসর অবান্ধব নীতির করণে বিনিয়োগকারীরা এ লিগ নিয়ে বেশী আগ্রহী না। বিসিবি বিপিএল এর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব হাতছাড়া করতে রাজী নয়। দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে যেখানে বিসিবির ভূমিকা হওয়ার কথা ছিল দেখভালের সেখানে তারাই এর মালিক, সর্বময় কর্তা। আয় সব তাদেরই। বিপিএল এর বিকাশে এখানেই বিপত্তি। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মালিকানা দেয়া হয় এক বছর বা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। আসলে দেওয়া হয় স্পনসরশিপ। কারণ মালিক হিসেবে বিনিয়োগকারীরা আয়ের ভাগ পায় না। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য টাকা বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হন স্পনসররা। ফলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মালিকানার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকে না। এ কারণেই প্রতিবছর বদল হয় মালিকানা। কিন্ত নীতিগত পরিবর্তন হলে, পাঁচ বছর বা বেশি সময়ের জন্য মালিকানা দেওয়া হলে এবং আয় ভাগাভাগি করলে জমজমাট হয়ে উঠবে বিপিএল। দীর্ঘ মেয়াদে মালিকানা ও আয়ের ভাগ পেলে বিভিন্ন বিজনেস গ্রুপ ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা কিনবে। তারা এটিকে বিজনেস ব্র্যান্ড হিসেবে বিবেচনা করবে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করবে। অবকাঠামো তৈরী করবে। ভাল দল গড়তে দেশি বিদেশী তারকা ক্রিকেটারদের দলে ভেড়াতে চেষ্টা করবে। পর্যাপ্ত অর্থ খরচ করবে। ফ্যান বেইজ তৈরী করবে। ১৬ কোটি মানুষের ক্রিকেট পাগল দেশে তারা নিজেদের ফ্র্যাঞ্চা্জির ব্র্যান্ড ভেল্যু বাজারজাত করে বিজনেস প্রফিট করবে। কিন্তু এখনকার মতো নিজেদের আয় এবং একচ্ছত্র কর্তৃত্ব থাকবে না বলে বিসিবি এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়।

দায়সারা আয়োজন
আয়োজন করতে হয় বলেই বোধহয় প্রতি বছর বিপিএল আয়োজন করে বিসিবি। ভালো, মানসম্মত আয়োজনের কোন পরিকল্পনা তারা করে বলে মনে হয়না। এ জন্যই “ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে” এর মতো হুটহাট করে মালিকানা ঠিক হয়, তড়িঘড়ি করে দল গড়তে হয়, পর্যাপ্ত প্র্যাকটিস না করেই দলগুলোকে মাঠে নেমে পড়তে হয়। কোন বিদেশি খেলবেন? কটা ম্যাচ খেলবেন সেটিও কোচরা আগেভাগে জানতে পারেন না। দল নিয়ে ঠিকঠাক পরিকল্পনা তৈরীর পর্যাপ্ত সময়ও পান না তারা। এ প্রসঙ্গে সাকিব বলেছেন – “একটা যা-তা অবস্থা। এর থেকে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল) আরও ভালোভাবে হয়। কারণ, আগে থেকেই দল গোছাতে পারে। আরও আগে থেকে জানে যে দলটা কী হচ্ছে এবং তারা সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে।’

ডিআরএস ছাড়া বিপিএল
দায়সারা আয়োজনের আরেক উদাহরণ ডিআরএস ছাড়া বিপিএল। আজকাল বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া লিগেও ডিআরএস ব্যবহার করা হয়। অথচ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস লিগে ডিআরএস পাওয়া যাচ্ছে না এলিমিনেটর ম্যাচের আগে। এর আগের ম্যাচগুলোতে ব্যবহার করা হবে এডিশনাল ডিআরএস। এটা অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত ব্যাপার।

বিজ্ঞাপন

ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম বা ডিআরএস হচ্ছে আম্পায়রের সিদ্ধান্তের নির্ভুলতা যাচাইয়ের সর্বাধুনিক পদ্ধতি। ডিআরএস এ তিনটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। হক আই- এটি বলের মুভমেন্টি ট্র্যাকিং টেকনোলজি। হটস্পট_- এটি ইনফ্রারেড ইমেজিং সিস্টেম। এর মাধ্যমে সংঘর্ষে উৎপন্ন হিট থেকে বুঝা যায় বল ব্যাট না প্যাডে আঘাত করেছে। আল্ট্রা এজ/ রিয়েল টাই স্নিকোমিটার_-ব্যাট বলের স্পর্শের সাউন্ডের গ্রাফিক্স দেখে ডিসিশন নেয়া হয়। ডিআরএস- এ দ্রুত নির্ভুল সিদ্ধান্ত দেয়া যায়। ডিআরএস আনতে হয় অস্ট্রেলিয়ার ও নিউজিল্যান্ডে থেকে। এ জন্য আগে থেকে জানাতে হয়। বুক করতে হয়। সরঞ্জামাদির সঙ্গে ওরা অপারেটর এবং এক্সপার্টদের পাঠায়। বছর জুড়েই ওদের ব্যস্ততা থাকে। বিসিবি বলছে আন্তর্জাতিক ব্যস্ততার কারণে ডিআরএস পাওয়া যাচ্ছে না। যদি তাই হয় তবে বলতে হবে বিসিবি সময়মতো যোগাযোগ করেনি। তবে অন্য আরেকটি কারণ আছে। হয়ত বিসিবি সেটি লুকাচ্ছে। এই সিস্টেম ব্যবহার ব্যয়বহুল। প্রতিটি ম্যাচে প্রায় ১৮ হাজার ডলার খরচ। বিসিবি হয়তো এ খরচ করতে চায়নি। এজন্যই শুরু থেকে নয়, এলিমিনেটর ম্যাচ থেকে ডিআরএস ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সাকিবও এসবের পেছনে সদিচ্ছার অভাব দেখছেন, ‘বাজেট-সংকট বোধ হয় বিসিবির! সদিচ্ছা থাকলে আমি তো কোনো কিছু থেমে থাকার কারণ দেখি না।”

বিসিবি কর্তারা এডিশনাল ডিআরএস এর যে কথা বলছেন সেটি পুরনো পদ্ধতি। এতে আম্পায়ারের যে সিদ্ধান্তে আপত্তি সে ঘটনাটি থার্ড আম্পায়ার বার বার রিপ্লে করে বুঝার চেষ্টা করেন। কখনও স্ক্রিন স্পিল্ট করে জুম করে বিষয়টি দেখে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।এতে অনেক সময় লাগে। এই সিদ্ধান্ত ডিআরএস এর মত নির্ভুল হয় না। সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। ডিআরএস ব্যবহার না করায় বিপিএল এর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যাতাও কমে যায়।

আগ্রহ হারাচ্ছেন বিদেশী তারকারা
শুরু দিকে বিপিএলে দল পেতে খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক তারকাদের আগ্রহ ছিল। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে ততই আগ্রহ হারাচ্ছেন বিদেশী তারকা ক্রিকেটাররা। এবারের লিগে বিদেশীদের মধ্যে পাকিস্তান ও লংকান তারকাদেরই বেশি দেখা যাবে। নিজ দেশের আন্তর্জাতিক ব্যস্ততা এবং প্রায় একই সময়ে আরো দুটি ফ্য্যাঞ্চাইজি লিগ থাকায় হয়তো এবার ভিন দেশী তারকাদের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বিপিএল এর প্রতি ভিন দেশীদের আগ্রহ যে কম তা বুঝা যাচ্ছে টি-টোয়েন্টির সাবেক এক নম্বর ব্যাটসম্যান ও ইংল্যান্ড দলের টপ অর্ডার ব্যাটার ডেভিড মালানকে দিয়েই। মালান বিপিএলে খেলবেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সে। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচ মাত্র খেলবেন। এরপর আর তাকে পাওয়া যাবেনা । তিনি চলে যাবেন দুবাই ফ্য্যাঞ্চাইজিতে খেলতে। অর্থ্যাৎ বিপিএল তার কাছে ফাস্ট চয়েস নয়।

বিজ্ঞাপন

নিম্ন মানের উইকেট
বিপিএল এর একটি নেতিবাচক দিক হল নিম্নমানের উইকেট। পৃথিবীর অন্যকোন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ এত নিম্নমানের উইকেটে বোধহয় হয় না। এ জন্য বিসিবি কর্তারা মাঠের স্বল্পতাকে দায়ী করেন। কিন্তু মাঠ বাড়ানোর উদ্যোগ তারা নেন নি। এবার খেলা হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকায়। ঢাকার সব ম্যাচ হবে মিরপুরে। মিরপুরে উইকেট নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবেই নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। টি-টোয়েন্টি ধুমধারাক্কার ক্রিকেট। রান উঠবে , উইকেট পড়বে। কিন্তু মিরপুরের উইকেট টি-টোয়েন্টির উপযুক্ত নয়। অথচ এই উইকেটেই ম্যাচ হবে ২৮টি। তাহলে কি মানের হতে পারে খেলা ?

মাঠের স্বপ্লতার সমস্যা কাটাতে উদ্যোগী হতে পারতেন বিসিবি কর্তারা। ঢাকার কাছেই নারায়ণগঞ্জে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ভেন্যু রয়েছে – ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম। হ্যা এটির মালিকানা বা কর্তৃত্ব বিসিবির নয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। কিন্তু এটি আইসিসি স্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু। জলাব্ধতার কারণে বছরের পর বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বিসিবি এই ভেন্যু ব্যবহারে আন্তরিক হলে এনএসসিকে দিয়ে ঠিক করিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু রুটিন কাজের বাইরে উদ্যোগী হয়ে কিছু করতে চান না বিসিবি কর্তারা এটি তার একটি নজীর।

দেশের ক্রিকেটে আবদান রাখতে পারছে না
বিপিএল দেশের ক্রিকেটে অবদান রাখতে পারছে না। বের করতে পারছে না নতুন প্রতিভা। জাতীয় দলের অধিনায়ক সাকিব বিপিএলের প্রাপ্তি নিয়ে গত বছরই প্রশ্ন তুলেছিলেন । হতাশ সাকিব বলেছিলেন, ‘বিপিএলের প্রতিটি আসর থেকে অন্তত দুইজন করে ক্রিকেটার বের হওয়া উচিত। কিন্তু আমার দেখামতে, সাইফউদ্দিন ও শেখ মেহেদি ছাড়া বিপিএলের আট আসর থেকে আর কাউকে বের হতে দেখিনি। এটা একটা বড় হতাশার জায়গা।’

তবে বিপিএলের দুই আবিষ্কার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারেন নি। বিপিএলে নৈপুণ্যের ঝলক দেখিয়ে আরও একজন জাতীয় দলে ঢুকেছিলেন।তিনি সাকিবেরই দল ফরচুন বরিশালের সতীর্থ মুনিম শাহরিয়ার। বিপিএলে মারমার কাটকাট ব্যাটিং করা এ ওপেনার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেন নি। পাঁচটি টি ২০-তে সুযোগ দেওয়ার পর বাদ দেয়া হয়েছে জাতীয় দল থেকে।

বিজ্ঞাপন

বিপিএলের আরেক আবিষ্কার শেখ মেহেদিও জাতীয় দলে স্থায়ী জায়গা নেয়ার মতো কিছু করতে পারেননি। এর মানে বিপিএলে আসলে মানসম্পন্ন ক্রিকেট হয় না। অথচ আইপিএল থেকে জাসপ্রিত বুমরা, সূর্যকুমার যাদবের মতো সুপারস্টার বেরিয়ে এসেছেন। পিএসএল থেকে নজর বেরিয়েছেন শাদাব খান, হারিস রউফ, ইফতেখার আহমেদ, খুশদিল শাহর মতো টি২০ স্পেশালিস্ট। এমনকি উইন্ডিজের সিপিএল থেকে রোভম্যান পাওয়েল, কাইল মায়ার্স, ব্রেন্ডন কিং, ওডেন স্মিথের মতো ক্রিকেটার বেরিয়ে এসেছেন।

সমাধান কিসে
বিপিএল এর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে, দেশে জনপ্রিয়তা বাড়াতে, আয় বাড়াতে এবং ক্রিকেটের মান বাড়াতে সবার আগে প্রয়োজন ক্রিকেট বোর্ড কর্তাদের সদিচ্ছা। সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত আয়োজন। । নীতি ও পরিকল্পনায় বাস্তবসম্পন্ন পরিবর্তন। বছর বছর নতুন নতুন মালিক। নতুন নতুন নামে ফ্র্যাঞ্চাইজি এলে এবং অপরিকল্পিতভাবে হুটহাট আয়োজন করলে বিপিএল এর মান কখনও বাড়বে না। সম্প্রতি এক প্রশ্নের জবাবে সাকিব বলেছেন-“ সদিচ্ছা থাকলে আমি তো কোনো কিছু থেমে থাকার কারণ দেখি না। ৩ মাস আগে ড্রাফট হবে না, অকশন হবে না, ডিআরএস থাকবে না, ২ মাস আগে থেকে দল গঠন হবে না—আমি এসবের কোনো কারণ দেখি না। এক খেলোয়াড় এক দিন আসবে, দুই দিন পর চলে যাবে। কে কখন আসবে যাবে কেউ জানে না।’। সাকিব আরো বলেছেন-‘আমাকে যদি সিইওর দায়িত্ব দেওয়া হয়, আমার বেশি দিন লাগবে না। সব ঠিক করতে সর্বোচ্চ এক থেকে দুই মাস লাগবে।”

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন