বিজ্ঞাপন

পাপন না তামিম; কে সত্যি বলছেন?

February 28, 2023 | 7:19 pm

মাহমুদুল হাসান শামীম

ইংল্যান্ডের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অন্দরমহলের গোপন খবর বাইরে জানিয়ে বোমা ফাটিয়েছেন বিসিবির প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন। দেশের দুই সুপারস্টারের মধ্যে নাকি বেশ খারাপ দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের রেশে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ড্রেসিং রুমে ভীষণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। গ্রুপিংয়ে দলে খারাপ পরিস্থিতি। অবস্থা এমন যে আগের কোচ ডমিঙ্গো এর সুরাহা করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। জানালেন নতুন কোচ হাথুরুসিংহে এটি বরদাস্ত করবেন না। তিনি তার পরিকল্পনামতো কাজ করতে না পারলে চলে যাবেন। ভয়াবহ খবর। সামনেই বিশ্বকাপ। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ ভাল দল। আসন্ন বিশ্বকাপে টাইগাররা ভাল করবে এমন ধারণা দেশ-বিদেশের সবারই। অন্যদিকে ২০১৬ সালের পর থেকে দেশে ১৩ সিরিজের কোনোটি হারেনি। সব দলকেই টাইগাররা হারিয়েছে। বাকী শুধু ইংলিশরা। ৭ বছর পর তারা এসেছে। তাদের এবার হারানোর ইচ্ছে খেলোয়াড়, সমর্থক সবারই। দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নতুন কোচও। ইংলিশদের বিরুদ্ধে কি হবে এ নিয়ে যখন সবার ভাবনা। খেলোয়াড়রা যখন মাঠের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতিতে নিমগ্ন তখন বাংলাংদেশের ক্রিকেটের অভিভাবক জানালেন চরম অনাকাংখিত এক খবর। অপ্রত্যাশিত খবরটি শুনে সবার আলোচনার বিষয় এখন সাকিব-তামিম দ্বন্দ্ব।

বিজ্ঞাপন

সাকিব দেশে ছিলেন না। এ লেখা পর্যন্ত তার মন্তব্য জানা যায়নি। তবে পাপনের বক্তব্যের একদিন পরই তামিম তার কথা বলেছেন। সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন ১৬ বছর আগে যখন সাকিব-তামিম জাতীয় দলে ঢুকেছেন তখনও দলে কোন গ্রুপিং ছিল না। ১০ বছর আগেও তা দেখেননি। ৬ মাস আগে যখন ইনজুরিতে পড়েন তখনও সেটি ছিল না। এখন তিনদিন একসঙ্গে প্র্যাকটিস করছেন খেলোয়াড়রা। দলে কোন গ্রুপিং নেই। সুখি এক পরিবারের মতো সবাই হাসি-খুশি, আনন্দে আছেন। ইংলিশ বধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কোন গ্রুপিং বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ড্রেসিং রুমে নেই।

তাহলে বোর্ড প্রেসিডেন্ট পাপন কি বললেন- গ্রুপিংই বাংলাদেশ দলের বড় সমস্যা। অন্য কোন সমস্যা নেই। নিশ্চয়ই কেউ সত্যিটা বলছেন না। কে বলছেন না? পাপন না তামিম? কে মিথ্যে বলছেন? কেন বলছেন?

সাকিবের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই তামিম তা কিন্তু অস্বীকার করেন নি। জানিয়েছেন তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটি মাঠের খেলায় কোন প্রভাব ফেলে না। টেস্ট অধিনায়ক সাকিব যখন পরামর্শ চান তামিম সানন্দে তা দেন। আবার ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম যখন পরামর্শ চান সাকিবও তা সানন্দে দেন। দলের জন্য দুজনই সামর্থ্য নিংড়ে খেলেন। পরিসংখ্যানও তাই বলে। ক্যারিয়ারে সাকিব-তামিম জুটির গড় রান ৪৮। খারাপ সম্পর্কের যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময়ও তাদের জুটির গড় ৪০ এর বেশি। এমন কখনও তো দেখা যায়নি যে ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম সাকিবকে যখন বল করতে বলেছেন সাকিব তা করেন নি। কিংবা টেস্ট অধিনায়ক সাকিব তামিমকে যেখানে ফিল্ডিং করতে বলেছেন তামিম তা মানেন নি। কিংবা সাকিবের বলে তামিম ক্যাচ ধরার বা রান বাঁচানোর চেষ্টা করেন নি। কিংবা ব্যাটিংয়ের সময় একজনের কলে আরেকজন সাড়া না দিয়ে অন্যজনকে রান আউট করেছেন। দুজনের আগের মধুর সম্পর্ক হয়তো নেই। মাঠের বাইরে কথাও হয়তো বলেন না। কিন্তু দলের জন্য নিজেদের পারফরমেন্সে তো ঘাটতি তারা রাখেন না।

বিজ্ঞাপন

এমন সম্পর্কের রেশারেশি তো অনেক দলেই থাকে। শচিন টেন্ডুকার- কপিল দেব, অস্ট্রেলিয়ার দুই ভাই মার্ক ওয়াহ- স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহ- শেন ওয়ার্ন, ইমরান খান -জাভেদ মিয়ানদাদ, ওয়াসিম আকরাম – ওয়াকার ইউনুস এমনকি হাল আমলে বিরাট কোহলি- রোহিত শর্মার বিরুপ সম্পর্কের কথা তো সবাই জানেন। কিন্তু মাঠের পরফরমেন্সে তো তার প্রভাব পড়েনি। জুটি বেঁধে তারা দলের জন্য বহু সাফল্য এনে দিয়েছেন। সাকিব-তামিমের ক্ষেত্রেও তো একই ব্যাপার। পাপন সাহেব কেন এই ব্যাপারটিকে বড় করে এই সময়ে সামনে আনলেন?

বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপ হবে। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড এখন ঢাকায়। দলে পরিবর্তনের সময় চলছে। নতুনরা জায়গা নেয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। নতুন কোচ এসেছেন। দল নিয়ে নতুন ভাবনা চিন্তা তার। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বোর্ড প্রেসিডেন্ট সাকিব-তামিম দ্বন্দ্বের বোমা ফাটিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কি ভালোটা করলেন? দুদিন পরই দল যখন ইংল্যান্ডের মোকাবেলায় নামবে তার আগে আগে বোর্ড প্রেসিডেন্টের কেন দলের ভেতরের খবর বাইরে আনার তৎপরতা? নতুন কোন নাটকের প্লট নয়তো এটি। বা নতুন কোন অপারেশন শুরুর পটভূমি তৈরির চেষ্টা নয়তো এটি?

এতদিন ফিসফাস ছিল যে দলে সিনিয়র-জুনিয়রের একটা সুক্ষ্ম দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু তামিম গ্রুপ বনাম সাকিব গ্রুপের কোন দ্বন্দ্ব আছে বলে কোন কিছু তো এতদিন শোনা যায়নি। আর সাকিব-তামিমের অম্ল সম্পর্কের কথা তো অনেক পুরনো ব্যাপার। কয়েক বছরের আগেই এর শুরু। পাপন সাহেবও তো এটি জানেন অনেক আগে থেকেই। হঠাৎ করেই তিনি এটি অবগত হন নি। কিন্তু বড় প্রশ্ন হঠাৎ করেই এই ব্যাপারটিকে কেন তিনি সামনে আনলেন? কেন অনেক বড় ব্যাপার হিসেবে তুলে ধরলেন?

বিজ্ঞাপন

অনেকেরই ধারণা নেপথ্যে অন্য কিছু আছে। অপেশাদারি আচরণে চুক্তি ভেঙ্গে, বোর্ড কর্তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে, অসম্মান করে চলে যাওয়া কোচ হাথুরুসিংহেকে আবার এনেছেন বোর্ড সভাপতি নিজের উদ্যোগে। হেডমাস্টার কোচ হাথুরু সিনিয়রদের টাইট দেবেন, লাইনে রাখবেন- এই ভেবে তাতে সায় ছিল বোর্ডের কোন কোন কর্মকর্তার। হাথুরুসিংহেকে নিয়েই সবার দুঃশ্চিন্তা। কি হবে সিনিয়রদের? দলের ড্রেসিংরুমে কি ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হবে? তার কারণ তার অতীত। যেখানেই গেছেন দলের সিনিয়রদের অবজ্ঞা উপেক্ষা করেছেন। ড্রেসিংরুমের পরিবেশ অস্থির করছেন। বাংলাদেশে প্রথম দফায় তার সঙ্গে সাকিব, মাশরাফি, মাহমুদুল্লাহ, মুমিনুল, মুশফিক, তামিম সবারই মনোমালিন্য ছিল। কারো কারো ক্যারিয়ারেও তিনি সংকট তৈরি করেছেন। এবারও আশংকা তেমনই। মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ বিশ্বকাপ দলে থাকবেন না এটি অনেকেরই ধারণা। এর সঙ্গে কি সাকিব তামিমের আবস্থানও কি সংকটে পড়তে যাচ্ছে? এর আগে সাকিবের উপর এক নিষেধাজ্ঞায় হাথুরুর হাত ছিল বলেই অনেকের বিশ্বাস।

পাপন সাহেব কি সিনিয়রদের বিদায়ের আরেকটি ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছেন? সাম্প্রতিক সময়ে তার দুটি বক্তব্য এমন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। তিনি বলেছেন সাকিব-তামিমের দ্বন্দ্ব মিটাতে না পেরে ডমিঙ্গো হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু হাথুরু তা করবেন না। নিজের পরিকল্পনা মতো কাজ করতে না পারলে তিনি চলে যাবেন। আরেকবার বলেছেন মাহমুদুল্লাহকে তিনি বলেছেন খেলা ছাড়ার ব্যাপারে পরিকল্পনার কথা জানাতে। তার মানে বোর্ড সভাপতিও ধারণা করছেন বিশ্বকাপের আগেই কয়েকজন সিনিয়রের বিদায় ঘটবে।

এই উপমহাদেশের মানুষের নেতিবাচক মানসিকতা হাথুরুর ক্ষেত্রে একটু বোধহয় বেশিই। এখানে কেউ দায়িত্ব পেলে প্রথমেই ভাবেন পুরনো অভিজ্ঞরা তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই প্রথম কাজ হয় পুরনো অভিজ্ঞদের বিদায় করা। নিজের সামর্থ্যের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং হীনমন্যতা থেকেই এটা করা হয়। আমাদের বিভিন্ন প্র্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে খবর নিলেই তা স্পষ্ট হবে। শ্রীলংকা দলে ঢুকেই হাথুরু এটি করেছেন। বাংলাদেশে প্রথম দফাল কাজ করার সময়ে সে চেষ্টাই করেছেন। এবারও তাই করবেন কিনা সময়েই তার উত্তর মিলবে। তবে এই সময়ে বোমা ফাটিয়ে বোর্ড সভাপতি সিনিয়রদের টাইট দেয়ার ক্ষেত্রটাই তৈরি করে দিলেন কি?

অন্যদেশের বোর্ড প্রেসিডেন্টদের দল নিয়ে এত কথা কেন, কোন কথাই বলতে শোনা যায় না। আমাদের বোর্ড সভাপতি অহরহ কথা বলেন। বলতে বলতে দলের জন্য, দেশের ক্রিকেটের জন্য ক্ষতিকর কথাও বলেন। এই যেমন তাইজুলের ব্যাপারটি। নির্বাচকরা স্পিনার হিসেবে চেয়েছিলেন নাসুমকে নিতে। কিন্তু অধিনায়ক তামিম চেয়েছেন তাইজুলকে নিতে। শেষ পর্যন্ত তাইজুলই দলে ঢুকেছেন। এটি নির্বাচক, কোচ, অধিনায়কের আলোচনা ও সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এটি পক্ষ-বিপক্ষ বা পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নয়। তারা খেলোয়াড়দের পারফরমেন্স, কন্ডিশন এসব নিয়ে তুলনা আলোচনা করে যুক্তিতর্ক শেষে সিদ্ধান্ত নেন। সেটি গোপন থাকারই কথা। কিন্তু বোর্ড প্রেসিডেন্ট মিডিয়ায় জানিয়ে দিলেন তাইজুল হচ্ছেন ক্যাপ্টেনস কল। এটি অধিনায়ক তামিমকে বিব্রত করছে। তাকে মিডিয়ার সামনে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। অথচ কেন তামিম নাসুমের চয়ে তাইজুলকে চেয়েছেন তা এই দুই জনের ওয়ানডে পারফরমেন্স দেখলেই বুঝা যায়। ঘরের ভেতরের খবর এভাবে বাইরে এনে বোর্ড প্রেসিডেন্ট ভাল করেন না দলের জন্য। এবারও কাজটি ভাল হয়নি। তামিম -সাকিব অনেক বুদ্ধিমান এবং অভিজ্ঞ। তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাপন সাহেবকে বেকায়দাতেই ফেলে দিবেন। তামিম সেটি এরই মধ্যে করেছেন প্রেস কনফারেন্সে সরাসরি নিজের সোজাসাপ্টা বক্তব্য দিয়ে। এখন সাকিব মাঠে ও মাঠের বাইরে তামিমের সঙ্গে মিলে দেখাবেন তাদের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা বাড়িয়েই রটানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন