বিজ্ঞাপন

জুঁই মনি দাশের গল্প ‘নীহারিকার বানপ্রস্থ’

April 12, 2023 | 3:15 pm

জুঁই মনি দাশ

চেনাপথের মধ্যে যে কত সুড়ঙ্গ, অন্দরমহলের গোপন কুঠুরিতে যে কত তোরঙ্গ তার হিসাব এক জীবনে মেলে না। নীহারিকা সেসবের খোঁজ কখনও করেননি। অলিগলি হেঁটে হেঁটে সময় কানাগলিতে থমকে গেলেও তিনি কখনও থামেননি। থেমে গেলেই ছোটখাটো অতৃপ্তি বা অপ্রাপ্তি বড় হয়ে ধরা দেয়। চলমান ট্রেন থেকে বাইরের পৃথিবী সুন্দর লাগে। স্টেশনে পৌঁছে অপেক্ষা করতে থাকলেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খামতি চোখে পড়ে। যত সময় যায় তত খুঁটিনাটি ভুলের পুনরাবৃত্তি মনে বাজে। নীহারিকা কচ্ছপের গতিতে হেঁটে হেঁটে এতদূর এসেছেন। তার ঠাকুরদা বলতেন, বাড়িঘরের ঠিকানা নিয়া মানুষ বন্দি হইয়া আছে। অথচ তামাম দুনিয়া তারে দেখনের লাইগ্যা অপেক্ষা কইরা আছে। মনটারে ছোটখাট দোষ-ত্রুটি আর জিনিসপত্রের মধ্যে আটকাইয়া রাইখ্যো না।

বিজ্ঞাপন

নীহারিকার জীবনের ব্যাপ্তি খুব বেশি না হলেও মনের ব্যাপ্তি অতলান্ত সমুদ্রের মতো। সারাজীবন বলার চেয়ে শুনেছেন বেশি। পাথরের মতো নির্লিপ্ত মুখে কোনো কিছুই তেমন আঁচড় ফেলে না। তাই কাছের মানুষের মধ্যে অনেকেই জান্তব আক্রোশে আঁচড়ে খামচে রক্তাক্ত করেছে। মানুষ আর মানুষের কতটা কাছে আসতে পারে। কাছে আসার আয়োজন আর আড়ম্বরের মধ্যেই সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এই আড়ম্বরটাই চোখে পড়ে। তাই নানা বাহানায় সেটা লোকে তুলে ধরে। অখিলও তার বাইরের কেউ না। চল্লিশ বছরের দাম্পত্যের স্নায়ুযুদ্ধটা তারা দুজন মিলেই সামলেছে। বাইরে থেকে কেউ কখনও তাদের অন্দরের উত্তাপ আন্দাজ করতে পারেনি।

অখিল প্রায় বিনা নোটিশে চলে যাওয়ায় নীহারিকা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। এরপর তিন বছর কেটে গেছে। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার পর খুব দ্রুতই নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছেন। লোকে বলে, একটু বেশিই মানিয়ে নিয়েছেন। গত সপ্তাহে রাগারাগি করে ছেলেও বলেছে, মা, তুমি খুব অদ্ভুত ধরনের মানুষ। ছেলের বউ মল্লিকা অবশ্য বহুদিন আগেই সেকথা বলেছে। নীহারিকা কারও অভিযোগের উত্তর কখনও দেননি। এতে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার কথা কিন্তু আরও উত্তপ্ত হয়ে যায়। সমান উদ্যম না থাকলে ঝগড়াঝাঁটি করে আরাম নেই। বিয়ের পর পর অখিল নানান ছুতোনাতা ধরে ঝগড়া শুরু করত। নীহারিকাও বয়সের দোষে উগ্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সেসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা আর সাধারণ ব্যাপার থাকত না। দুজনের ভেতরের তিক্ততা বিশ্রীভাবে বের হয়ে আসত। অখিলের পৌরুষের ধারে মাঝেমধ্যে গায়ে হাত উঠিয়ে দিত। নীহারিকা প্রথমবার মা ও শাশুড়িকে জানিয়েছিলেন। দুজনই কিছুটা বিব্রত হয়ে অন্য কথায় চলে গিয়েছিলেন। মধ্যবিত্ত সংসারের দেয়াল জেলখানার মতো উঁচু হতে হয় যাতে এইসব আওয়াজ বাইরে না যায়। তবে সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা দিয়েছিল কাজের মাসী কল্পনা। বলেছিলেন, বউ, সংসার যদি করবা মনে কইরা থাক তাইলে নিজের ঝায়ঝামেলা নিজে মিটাইয়া লইয়ো। আর যদি না করবার চাও তাইলে ঢোল বাজাইয়া দশ গেরামের লোকেরে জানাইতে পার।

নীহারিকা চুপ করে গিয়েছিলেন। চুপ মানে একদম চুপ। অখিল কিছুক্ষণ পরেই অনুতপ্ত হয়ে কাঁচুমাচু হয়ে ভাব জমাতে আসত। রাগের মাথায় আবার লাগামছাড়া আচরণ করত। নীহারিকা অনেকবার আলোচনা করেছেন। একান্ত মুহূর্তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছেন। সন্তানের সামনে নিজেদেরকে সামলে রাখার দোহাই দিয়েছেন। অখিল কিছুতেই পাল্টাননি। মানুষ নিজে না চাইলে কিছুই বদলায় না। তাই চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া নীহারিকার সামনে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। এতে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল তা না। নীহারিকা চুপ হয়ে গেলেও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত তো আর বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং দ্বিগুণ বেগে ছুটেছে। আঁচড়ে-খামচে রক্তাক্ত করেও যখন কোনো সাড়া মেলেনি অখিল তখন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে। অখিল চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। বয়সের সাথে সাথে যখন ঘরেই বেশিরভাগ সময় কাটতে লাগল তখন নতুন করে চর্চা শুরু করেছিল। ভরা বর্ষার স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলা ধরা দিনে নীহারিকার মন এখনও অখিলের গানের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। শ্যাওলা ধরা দেয়ালের নীচের ইট আর কংক্রিটের কঙ্কাল সময়কে আগলে দাঁড়িয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

বউমা উপাসনার গলায়ও সুর ঢেউ খেলে। ছুটির বিকেলে বাড়ি থাকলে মাঝেমধ্যে বেশ দরাজগলায় গায়। বেশ ভারী গলা। মেয়েদের কণ্ঠের মতো রিনরিনে আওয়াজ না বলেই কানে এসে ধাক্কা দেয়। প্রথম প্রথম নীহারিকার পছন্দ হতো না। তবে আজকাল বেশ লাগে। মেয়েটার সোজাসাপ্টা কথা এখন তার ভালো লাগে। মিথ্যে ভণিতার দিন বোধহয় মধ্যবিত্ত সংসারেও ফুরিয়ে এসেছে। উপাসনার চলাফেরায় একটা তেজ আছে। কণ্ঠস্বর রুক্ষ না হলেও ধার আছে। চোখে চোখ রেখে কথা বলে। তর্কে জেতার জন্য চট করে রেগে যায় না বরং তাচ্ছিল্যের সাথে গুগলি ছুঁড়ে দেয়। অনিরুদ্ধ ওকে বেশ সমঝে চলে। সামনাসামনি; স্বীকার না করলেও উপাসনাকে কিছুটা ভয়ই পায়। নীহারিকা ওদের ঝুট-ঝামেলায় নাক গলায় না। তবু এক বাড়িতে থাকলে কিছু না কিছু তো কানে আসেই। অনিরুদ্ধ অবশ্য মায়ের সঙ্গে ব্যাপক হম্বিতম্বি সর্বস্ব ফাঁকা আওয়াজ করে। বোধহয় মাকে শাসিয়ে বউকে বার্তা দিতে চায়। নীহারিকার একটা চাপা অস্বস্তি হয়। অনিরুদ্ধ উত্তরাধিকার সূত্রে অখিলের গুণ না পেলেও দোষগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করেছে। নীহারিকা শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। অখিল অক্ষম আক্রোশে ছেলেকে কিছুতেই মায়ের কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। যখন বুঝলেন কিচ্ছু করার নেই নীহারিকাও আর বাড়াবাড়ি করেননি। স্বভাবমতো চুপ করে গিয়েছিলেন।

শেষ দিকে বাবা ছেলেতে সারাক্ষণ খিটিমিটি লেগে থাকত। সফল বাবার ছায়ায় অনিরুদ্ধ নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে করত। বাবাকে ছাড়িয়ে না যাওয়ার গ্লানিবোধটুকু উগরে দিত দোষারোপের নোংরা ভাষায়। অনিরুদ্ধের অভিযোগের শেষ নেই। মাকে যেহেতু সে কখনও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি তাই মায়ের প্রতি তার তেমন ক্ষোভ নেই। আজীবন আগলে রাখা বাবার উপর ছিল রাজ্যের অভিযোগ। বিয়ের পর উপাসনা বাবা-ছেলের সম্পর্কটা সহজ করতে চেয়েছিল। উল্টো আরও দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অনিরুদ্ধ আসলে মিটমাট করতে চায়নি। নিজের ব্যর্থতার দায় সে আর নিতে পারছিল না। বাবার উপর দোষারোপ করে নিজেকে কিছুটা স্বস্তিতে রাখত। যাই হোক, বাবা-ছেলের সম্পর্কের অবনতি হলেও উপাসনার সঙ্গে অখিলের বেশ ভাব হয়েছিল। প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক মনে বাৎসল্যের ফল্গুধারার পরিচয় মিলেছিল। অখিল বিয়ের পর নীহারিকাকে আমূল পাল্টে দিতে চেয়েছিল। একেবারে তার ছাঁচে ফেলে নিজের মনের মতো করে তৈরি করে নিতে চেয়েছিল। এই জোর-জবরদস্তির জন্য সম্পর্কটা আর কোনোদিন সহজ হয়নি। বত্রিশ বছরের দাম্পত্যের মধ্যে কিছু অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। সমান্তরালে বয়ে যাওয়া পথের মতো দূরত্ব রেখেই সামাজিক জীবন চলেছে। তাহলে অখিল চলে যাওয়ার পর নীহারিকার বিষন্নতা কি ভান ছিল? বটবৃক্ষের ছায়া আশ্রয় দেয় এটা সত্যি। বটবৃক্ষের তলে আর কোনো বৃক্ষ মহীরুহ হয়ে উঠতে পারে না সেটাও সত্যি। নীহারিকা মাটি কামড়ে দূর্বাঘাসের মতো টিকে ছিল। বটবৃক্ষের পতনে বহুকাল পরে সরাসরি রৌদ্রস্নাত হয়ে হকচকিয়ে গিয়েছিল। আর অভ্যাসের কানাগলিতে তো আমরা সবাই আটকে থাকি।

অখিল নিজেকে বদলে ফেলেছিল, তা বলা যায় না। তবে উপাসনাকে সে বদলে দিতে চায়নি। বুদ্ধিমান মানুষ, হয়তো টের পেয়েছিল যে ওকে বদলানো সহজ কাজ না। নীহারিকা তো চুপচাপ মানুষ। তার উপর এক অনতিক্রম্য দূরত্ব তাদের একলা করে দিয়েছে। অনিরুদ্ধ সারাক্ষণ নিজের মধ্যে ডুবে থাকে। অখিল হাঁপিয়ে উঠেছিল। সেই নিস্তরঙ্গ বাড়িতে উপাসনা সতেজতা নিয়ে এসেছিল। অখিল পুরনো সম্পর্কগুলোকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেনি। নতুন সুতা দিয়ে নতুন মালা গাঁথতে চেয়েছিলেন। দুজনের ভালোবাসার জায়গা ছিল গান। দুই ধরনের হলেও গাওয়ার দরদে কারও ঘাটতি ছিল না। এই দমবন্ধ বাড়িতে জোরেশোরে গানের রেওয়াজ শুরু হলো। সন্ধ্যা নামার পরে গানের সুর এই বাড়ির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নীহারিকার ভালো লাগছিল। নিজের গলায় সুর নেই তবে সুরের সমঝদার। মেয়ে হলে গান শেখাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। সেই ভয়ে মেয়ে আর এলোই না। ছেলেকে দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। হয়নি। অধৈর্য হয়ে শিল্পচর্চা করা যায় না।

বিজ্ঞাপন

দিনগুলো মধুময় ছিল বলার সুযোগ নেই। অনিরুদ্ধ এই আনন্দমুখর সময়কে উপভোগ করতে পারেনি। সে নানা অজুহাতে ঝামেলা পাকাতে থাকে। অখিল ও উপাসনা তাকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। তাতে অনিরুদ্ধ দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ঝামেলা শুরু করেছিল। নীহারিকা বুঝতে পারে না ছেলেটার ভেতর এত অতৃপ্তি কেন! জলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো সারাক্ষণ অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়ে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। ছেলেমেয়েদের একটা বয়স থাকে যখন তাকে পাকা বা বোকা কোনো ধরনের মধ্যেই ফেলা যায় না। অনিরুদ্ধ শৈশবে মায়ের আঁচল ঘেঁষা ছিল। সাত-আট বছর বয়সেও মায়ের আঁচল বা ওড়না না জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারত না। সমবয়সী ভাই-বোন ও বন্ধু-বান্ধবরা এসব নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের টিফিন এমনকি বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেলেও টুকটাক জিনিস মায়ের জন্য নিয়ে আসত। খেলার মাঝখান থেকে মাঝে মাঝে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলত, মা, তোমাকে আমার দেখতে ইচ্ছা করছিল। তুমি কখনও বেশি দূরে যেও না। নীহারিকার দূরে যেতে হয়নি। হাইস্কুলে ভর্তি হতে হতেই অনিরুদ্ধ কেমন বড় হয়ে গেলো। দিনদিন মায়ের কোল থেকে দূরে সরে গেলো। এক বাড়িতে থেকেও প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা হয় না।

নীহারিকার এসবে আজকাল আর মন খারাপ হয় না। একাকীত্বের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে তাকে উপভোগ করতে শিখে গেছেন। ব্যালকনিতে বসে লোকজনের আনাগোনা দেখলেও ক্লান্তি লাগে না। পুরনো বই পড়লে নতুন লাগে। কৈশোর বা প্রথম যৌবনের উচ্ছ্বাস এখন কমে এসেছে। তখনকার অনেক প্রিয় বই বা গান এখন পানসে লাগে। আবার অপছন্দের কিছু বিষয় এখন খুব ভালো লাগে। অনেকটা উচ্ছে ভাজার মতো। আগে মা জোর করে খাওয়াতেন এখন নিজেই খুঁজেপেতে জোগাড় করেন- নিমপাতা, উচ্ছে, গিমাইশাক, পাটশাক, গন্ধ ভাঁদাল, তিত বেগুন বা সজনের ডাঁটা পাতা। নীহারিকা ভাবেন সত্যিই তো তখন কেন এতো বিস্বাদ লাগত! এখন তো ডুমো ডুমো করে কাটা বেগুনের সাথে গিমাইশাক, গন্ধ ভাঁদাল পাতার বড়া বা নিমপাতা মুচমুচে করে ভাজলে অমৃতের মতো লাগে। তার নাতনি উপমা যেমন চোখমুখ বুঝে জল দিয়ে গিলে। বয়স সিঁড়ির ধাপের মতো ক্রমশ উপরে তুলে দেয়। তখন পরিচিত পৃথিবী ভিন্ন ভিন্ন রঙে ধরা দেয়।

উপমা অবিকল নীহারিকার মতো দেখতে। তবে স্বভাবে কোনো মিল নেই। বেশ ডাকাবুকো। নীহারিকা যেমন জীবন চাইতেন উপমা সেটা যাপন করে। উপাসনা তার চৌদ্দ বছরের মেয়েকে নিয়ে বন্ধুর মতো চলে। উপমা ঝর্ণার মতো কলকল করে বয়ে চলে। বাধাহীনভাবে উড়ে বেরায়। অনিরুদ্ধ এসব মোটেও পছন্দ করে না। তবে জোরালো আপত্তিও জানায় না। মা, বোন বা স্ত্রীকে যতটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কন্যাকে বোধহয় ততটা যায় না। উপমা সাজগোজের ব্যাপারে খুব সৌখিন। নিজেকে উল্টেপাল্টে দেখে। সবকিছুই নিজের মতো করে যাচাই-বাছাই করে নেয়। নীহারিকার সাথে মাখো-মাখো আদুরে ভঙ্গিতে মিঠে-মিঠে প্রেমপত্র আদানপ্রদান করে। উপমার সাথে বসেই বাংলা ও হিন্দি সিনেমার বাইরের সিনেমার সাথে যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। উপমা চিত্রপরিচালক হতে চায়। সিনেমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তার ট্যাবে অসংখ্য অসমাপ্ত চিত্রনাট্যের খসড়া আছে। নীহারিকা এই বয়সে এসে বউমার সঙ্গে ঘর গেরস্থালি দখলের মল্লযুদ্ধে অংশ নেয়নি। নিজে যা করতে পারেননি উপাসনা তা আনন্দ নিয়ে করছে তা দেখে তৃপ্তি খুঁজে ফিরেন।

উপাসনা ঠিক আটপৌরে সংসারী মেয়ে না। তবু মানুষ জড়িয়ে মাড়িয়ে যেখানে বাঁচে সেখানে সংসার চলে আসে। উপাসনা একজন স্থপতি। সে কাজ করে পরিবেশবান্ধব থিম নিয়ে। এ ছাড়া পুরাকীর্তি সংরক্ষণের সাথেও জড়িত। তাই সংসারে পুরনো কিছু সহজে বাতিল হয় না। নিত্যনতুন সংস্করণে সংসার জুড়ে থাকে। নীহারিকার দাদাশ্বশুরের নাম খোদাইকৃত তামার জগ ডাইনিং টেবিলে আবার জায়গা পেয়েছে। নীহারিকার বিয়েতে পাওয়া পিতলের কলসিতে মানিপ্ল্যান্টের আস্তানা হয়েছে। উপাসনা কয়েক প্রজন্মের আগলে রাখা জিনিসপত্র নিয়ে আর কিছু নিজে যোগ করে সংসার পেতেছে। নতুন-পুরানের মিশেলে ছবির মতো আলো-আঁধারির খেলা ঘরের আনাচে-কানাচে নেচে বেড়ায়। নীহারিকাও আলো-আঁধারিতে মিশে থাকেন। উপাসনা মাঝে মাঝে বলে, মা, আপনাকে ঠিক বুঝতে পারি না।

বিজ্ঞাপন

নীহারিকা নিজেই কি নিজেকে বুঝতে পারেন! জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে হা-হুতাশ করে। চারপাশের সবাই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। মনে হতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও তার জীবনে স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে না। যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বিহ্বল হয়ে পড়তেন। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কয়েক মুহূর্ত বা দিন পরেই মনে হতো ভুল হয়ে গেছে। সেই নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হতো। রাতের পর রাত কেটেছে হাউমাউ করে কেঁদে। কাকে বলবে, শোনার তো কেউ নেই। কাঁদতে কাঁদতে একসময় অশ্রু শুকিয়েছে। মন পাথরের মতো কঠিন হয়েছে। বোকারাম মন ভয়ানক যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়ে মেনে নিয়েছে যা হবার তাই হবে। কান্নাকাটি-হল্লাহাটি করে কিছুই আটকানো যাবে না। প্রচণ্ড আতঙ্কে নীল হতে হতে একসময় সবকিছু সাদা হয়ে গেছে। নীহারিকা চুপ থাকা শিখেছেন। আত্মহত্যার চেষ্টা করেননি তবে বহুবার চিরকুট লিখেছেন। সেগুলো জমানো আছে। দিন-তারিখ ধরে সাজানো আছে। এখন পড়লে কেমন বোকাবোকা লাগে। অথচ যখন লিখেছিলেন তখন শতভাগ নিজের কথাই লিখেছিল। সময় সব গিলে খেয়েছে।

নীহারিকা এরপর নিজের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। মনের মধ্যে চাষবাসের জন্যে বীজতলা তৈরি করেছে। জীবনের ঘাটে ঘাটে কত যে নৌকা সারি সারি বাঁধা। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ ভাবতে ভাবতে সময় গড়িয়ে যায়। প্রতি পদক্ষেপে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অতি সাবধানী নীহারিকা কখনও চেনা গণ্ডি অতিক্রম করে আটপৌরে পাঁচালীর বাইরে কিছু পাঠ করতে পারেনি। তবে তার বেয়াড়া মন কোথায় কোথায় যেন ঘুরে বেড়ায়। এক অভিযাত্রিক মন সংসারের দেয়াল ঘিরেই কল্পনায় এঁকে গেল রঙিন প্রজাপতির পাখনা। সেই পাখনা উটপাখির মতই আলংকারিক বাহুল্য হয়ে থাকল। অখিলের দোষ ছিলো না। এমন আজগুবি চিন্তাভাবনার সাথে একই কক্ষপথে ঘোরা যায় না। তারা একই মহাবিশ্বের অংশ হয়েও বাস করেছে আলোকবর্ষ দূরে। তবু তো দিনগুলো কেটে গেছে। পাঁচমিশালি আবেগের ফুলঝুরি না থাকলেও দিনযাপনের খুচরো আলাপে বিলাপে কেটেছে।

অখিলের মৃত্যু নীহারিকাকে এক ধরনের মুক্তি দিয়েছে। যে বানপ্রস্থের দিকে সে যাত্রা শুরু করেছিল সেই পথ সহজ হয়েছে। এতদিন ধরে বয়ে চলা একটা ক্লান্তিকর সামাজিক সম্পর্কের সফল পরিসমাপ্তি তো উদযাপনেরই বিষয়। এই গোপন আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ নেই। অনিরুদ্ধ তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। আগের আক্রোশের সাথে এখন ঘৃণা আর অবজ্ঞা যুক্ত হয়েছে। অনিরুদ্ধ কী তার ভবিষ্যতের দুঃশ্চিন্তায় আতঙ্কিত? কে জানে। নীহারিকাকে এসব দুঃখ আর ছোঁয় না। সে হাঁসের মতো নোংরা জল শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নর্দমায় ভেসে থাকতে পারে। উপাসনা বিহ্বল চোখে তাকায়। তার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়েও নীহারিকাকে ঠিকঠাক মাপতে পারে না। নীহারিকা সেটা উপভোগ করে। তার কোনোদিন বুদ্ধির গর্ব ছিল না। সবকিছু যে বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করা যায় না সেটা সে বুঝতে পারে। তার নাতনী তাকে বোধহয় কিছুটা ঠাহর করতে পারে।

উপমা ঠাকুমাকে কোনো প্রশ্ন করে না। ওর দ্বিধাহীন আলিঙ্গনে নীহারিকা উষ্ণতা ফিরে পায়। এ রকম একটা জীবন বোধহয় নীহারিকা চেয়েছিলেন। যাপন করতে না পারলেও চোখের সামনে সারাক্ষণ দেখতে পারেন এতেও তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অখিল তাকে প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে বলতেন, যা আছে তাতেই দিলখুশ থাকতে হয়। জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করতে না পারলে অন্তরে শান্তি আসে না। অখিল দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলতেন, নিজেকে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করাটা একটা রোগ। তুমি কে হরিদাস পাল, যার জীবন নিয়ে অভিযোগের শেষ নাই। রাজা উজিরের কথাই সময় মনে রাখে না আর তো তুমি। তখন বয়স কম ছিল। এসব কথায় অভিমান হতো। এখন তো অঢেল অবসর। জাবরকাটার মতো পুরনো দিনের কথা ও ঘটনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবেন। নিজের ভাবনার জগতে তোলপাড় শুরু হলে আগের মতো ভাঙচুরের দিকে না গিয়ে জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করেন। এতে মন শান্ত হয়। চারপাশের দুনিয়ার হৈ হট্টগোলের মধ্যে থেকেও নিজের ভেতর তপোবন তৈরি করা যায়।

নীহারিকা নিজের মধ্যে সমাধিস্থ হন। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো যাবে না। সারাক্ষণ এই বীজমন্ত্র জপতে থাকেন। যা পেয়েছেন তার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা অনুভব করতে করতে নিজেকে ক্ষমা করে দিতে চেষ্টা করেন। এই জায়গায় নীহারিকা এখনও বেশ অনুদার। নিজেকে প্রতি মুহূর্তে নিক্তিতে পরিমাপ করেন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে নিজের ভুল-ত্রুটি যাচাই-বাছাই করেন। নিজেকে ক্ষমা করে দিতে পারলেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। যেদিন ক্ষমা করতে পারবেন নিজের ভেতরের শুঁয়াপোকা সেদিন রঙিন প্রজাপতি হয়ে উঠবে। নিজেকে ভালোবেসে দ্বিধাহীনভাবে আলিঙ্গন করতে পারলে অন্তর্গত বেদনা আদি অন্তহীন যাত্রা পথে মিশে যেত। নীহারিকা সেইদিনের অপেক্ষায় কান পেতে থাকেন। সেখানে সন্তানের প্রতি দখলদারত্বের বা সংসারে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা নেই। সেখানে নিজের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নাই।

বৈশাখী আয়োজনের আরও গল্প পড়তে: 

রবিউল কমলের ছোটদের গল্প ‘তুতু’

মাসুম মাহমুদের গল্প ‘পরস্পর বোঝাপড়া’

জহিরুল ইসলামের গল্প ‘একজন হোসেন আলী’

রয় অঞ্জনের গল্প ‘বিজিতের বিজয়রথ’

অর্ণব সান্যালের গল্প ‘জানালায় পরকীয়া’

রোখসানা ইয়াসমিন মণির গল্প ‘দূরত্বের জলে রঙিন ফুল’

শ্যামল নাথের গল্প ‘কাদামাটির আঙুল’

গৌতম বিশ্বাসের গল্প ‘নতুন জীবন’

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন