বিজ্ঞাপন

ঈদ কেনাকাটার যত উপদ্রব

April 21, 2023 | 7:02 pm

রাজনীন ফারাজানা

গত কয়েকবছর যাবত ঈদ আসলেই মনে হয়, ‘এত্ত গরম যাবোই না শপিংয়ে’। কিন্তু ঈদের শেষ সপ্তাহে হলেও চলে যাই ঠিকই। এবারেও ব্যতিক্রম নয়। রিপোর্টিংয়ে ব্যস্ত থাকায় পুরো রোজায় আসলে সময়ও মেলেনি ঈদ শপিংয়ে যাওয়ার। এই দাবদাহে রোজা থেকে একদিন একটা ইভেন্ট কাভার করলেই আর কোথাও যাওয়ার সক্ষমতা থাকে না। এছাড়া এবার রোজার মধ্যে পহেলা বৈশাখ। বৈশাখী কেনাকাটা অনলাইন ও রোজার আগের সারলেও ঈদের কেনাকাটা করতে মার্কেটে গেলাম।

বিজ্ঞাপন

পনেরো রোজার পর একদিন বসুন্ধরা সিটি গেলাম দুই ভাতিজীর জন্য জামা কিনতে। এত ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যে আর ইচ্ছা করেনি যে দ্বিতীয়বার যাই। বসুন্ধরা সিটি যাওয়ার কারণ এখানে দেশিয় ব্র্যান্ডের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি নন-ব্র্যান্ডের পোশাক, জুতাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র পাওয়া যায়। এছাড়া কসমেটিকস ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের জন্যও বসুন্ধরাতেই যাওয়া হয় একই ছাদের নীচে সবকিছু মেলায়। ফিরে আসি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথায়। ইফতারের পরপর রওনা দেওয়ায় রাস্তায় জ্যাম না পেলেও মার্কেটে ঢুকে মনে হল একসঙ্গে কয়েক লাখ মানুষ বোধহয় শুধু এখানেই এসেছে। লিফটে তো ওঠার অবস্থাই নাই, এস্কেলেটরে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে গায়ে গায়ে ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে হল। শিশুদের পোশাক খুঁজতে যেয়ে আরেক বিপত্তি। দশ বছরের উপরের শিশুদের জামা যেন সবই সাত থেকে পনেরো হাজার টাকা দাম। এত দাম কেন জিজ্ঞাসা করলে অরিজিনাল জাপানিজ, চায়নিজ, থাই, ইন্ডিয়ান ইত্যাদি নানা কথা বোঝায় তারা। যেহেতু আমি যথাক্রমে বারো ও সাত বছর বয়সী মেয়ে শিশুর জন্য পার্টি ফ্রক খুঁজছিলাম, তাই আর দেশি দশে যাইনি। প্রায় তিন ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে গলদ্ঘর্ম হয়ে যখন ভাবছি চলেই আসবো তখন একটি দোকানে সাধ্যের মধ্যে দুটো জামা পেয়ে নিয়ে আসি। এর মধ্যে ছোটজনের ইচ্ছা তার জন্মদিনে এলসার মত ড্রেস চাই। সেই এলসা ড্রেস খুঁজে খুঁজে যাও-বা পাই, সাইজ মেলে না অথবা অন্যান্য আনুষঙ্গিক মেলে না। আবার কিছু কিছু দোকানে একই জামার দাম আড়াই হাজার থেকে আঠারোশ টাকা চায়। আবার কোথাও কোথাও একদাম তিন হাজার। শেষ পর্যন্ত একটি জামা কিনি। তবে ঝামেলা হয়ে গেল বড়জনের ড্রেসের সঙ্গে একটি ব্যাগ থাকায় ছোটজনের জামার সঙ্গেও একটি ব্যাগ আলাদা করে কেনা লাগবে। যাদের বাড়িতে কাছাকাছি বয়সী সহোদর আছে তারা ভালো করেই বুঝবেন, কেন পিঠে-পিঠি ভাইবোনের জন্য একইরকম জামা-কাপড় কিনতে হয়। পারিবারিক অশান্তি যাতে না হয় তাই গেলাম ছোটজনের জন্য একটি হ্যান্ড ব্যাগ কিনতে। সেটাও দেখি একদাম সাড়ে সাতশ লিখে রেখেছে। কেন জিজ্ঞাসা করলে আবার সদুত্তর দিতে পারে না। সেদিনের মত ব্যাগ-ট্যাগ না কিনেই চলে আসি।

এরপর পঁচিশ রোজার দিন আরেকবার বসুন্ধরা সিটি যাই কিছু উপহার কিনতে। অফিসের গাড়ি যাচ্ছিল ওদিকে তাই রাত দশটার দিকে সেটাতেই উঠে পড়ি। মেয়েদের থ্রিপিস বা কুর্তি যেহেতু কিনব তাই গেলাম দেশি-দশে। ভিড়-ভাট্টা ঠেলে যাওবা একটা জামা পছন্দ করি, সেটা গায়ে দিয়ে দেখি আমার মাপে কিছুই নাই! দেশি ব্র্যান্ড কেন আমার মতো ওভারসাইজড মানুষের জন্য পোশাক বানায় না, মেজাজ খারাপ করে ভাবতে ভাবতে বের হয়ে যাই অন্যান্য দোকানে। একটা লাল জামা কিনব ভেবে কিছু দোকানে ঢুকে দেখি তারা খুব গর্ব নিয়ে বলে একদম খাঁটি পাকিস্তানী। এইটা শুনে বের হয়ে আসি। দেশে কী কম পোশাক আছে যে আমি টাকা দিয়ে পাকিস্তানী পোশাক কিনবো!

শেষমেষ ঘুরেফিরে হাতে গোনা যেসব দেশি ব্র্যান্ড থেকে কাপড় কিনি সেখান থেকেই কিনে নিলাম নিজের ও পরিবারের জন্য। কিনে নিলাম শব্দটা বলতে যত সহজ, কেনা তত সহজ না আর কি। একটা জামা ধরতে গেলেও অন্তত পাঁচজনের উপর দিয়ে দেখতে হয়। তার উপর অনেকগুলোরই প্রাইস ট্যাগ ছেঁড়া। শপ অ্যাসিসট্যান্টদের সাহায্যে দাম জানার পর আর কেনার ইচ্ছা জাগে না। মনে হয় এত টাকা দিয়ে এই জামা কেনার কোন মানেই নাই। কাপড় দেখা ও বাছাইয়ের যুদ্ধ যদিওবা এক ঘন্টায় শেষ করলেন এরপর কিন্তু শুরু হবে আসল চ্যালেঞ্জ। তিনটির বেশি পোশাক একসঙ্গে নেওয়া যাবে না ট্রায়াল রুমে। তাও আবার লাইনে দাঁড়িয়ে ঢুকতে হয়। সঙ্গে কেউ না থাকলে শপ অ্যাসিসটেন্টের হাতে বাড়তি দুই-চারটা কাপড় দিয়ে যেতে হয়। ভেতর থেকে দরজা খুলে ট্রায়াল দিয়ে ফেলা দুটো তার হাতে ধরিয়ে আরও যে দুটো নেবেন, এর মধ্যেই অপেক্ষায় থাকা অন্য ক্রেতা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী পোশাক বাছাই, ট্রায়াল যুদ্ধের পর এবার শুরু পেমেন্ট যুদ্ধ। সেখানেও লাইন। লাইন দিয়ে টেবিলের কাছাকাছি পৌঁছে কখনও শুনবেন ডাচবাংলার ডেবিট কার্ডের মেশিন নাই। তখন কাছে ক্যাশ বা বিকাশে টাকা না থাকলে বা অন্য কার্ড হাতে না থাকলে পুরো যুদ্ধটা একবার ভাবলে শপিং করার ইচ্ছাই চলে যায়। কারণ এসব কাপড় রেখে আপনাকে যেয়ে বুথ থেকে টাকা তুলে এনে আবারও লাইনে দাঁড়িয়ে পেমেন্ট দিতে হবে। তাই শপিংয়ে যাওয়ার আগে অবশ্যই অন্যান্য ব্যাংক কার্ড ও কিছু ক্যশা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভালো।

বিজ্ঞাপন

দাম, গরম, ভিড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেখি রাত বাজে সাড়ে বারোটা। মনে পড়ল ইফতারির পর আর কিছুই খাইনি। বসুন্ধরা সিটির নিচে এসে দেখি ফরমোসায় চার-পাঁচটা স্মুদি আছে যার দাম দুইশ টাকা ফিক্সড আর অন্যদিকে কয়েকটা ডোনাট ও কেক। ক্লান্ত-শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় একটা কোল্ড-কফি স্মুদি নিলাম। মুখে দিয়ে মনে হল উগরে দেব, এতটাই বিস্বাদ। এর দাম পঞ্চাশ টাকাও দেওয়া যায় না। কিন্তু মানুষের অসহায় অবস্থাকে পুঁজি করে তারা গ্লাস প্রতি দুইশ টাকা দিয়ে পানি, দুধ, চিনি ও কফি পাউডার ব্লেন্ড করে বিক্রি করছে যা খেতে মানুষ বাধ্য হয়। এসব পার করে অবশ্য রাইড শেয়ারিংয়ে নিরাপদেই ফিরে গেলাম বাসায়।

আমরা বন্ধুদের মধ্যে মজা করে বসুন্ধরা সিটিকে নিউ-মার্কেট, গাউছিয়া বলি অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য। এক বন্ধুর কিছু কেনাকাটা ছিল তাই সে অফার দিল চল যমুনা নাই। ওখানে এত ভিড় হবে না। গেলাম সঙ্গে। ভাবলাম সুযোগ পেলে জুতা কিনবো। সেই বন্ধু দেশিয় ব্র্যান্ড কে-ক্র্যাফটে ঢুকেছে পাঞ্জাবী কিনতে। গিফটের পাঞ্জাবী দ্রুতই পছন্দ করে ফেললেও বিপাকে পড়ল নিজের জন্য পছন্দ করতে যেয়ে। এদিকে এদের একেক পাঞ্জাবীর একেক সাইজ। একেকটার একেক সাইজ গায়ে লাগে। কয়েকটা পাঞ্জাবী পছন্দ করে ট্রায়াল দিতে চাওয়ায় তারা দেবে না। তারা নাকি ঈদের সময় তিনটির বেশি পাঞ্জাবী ট্রায়াল দিতে দেবে না এমন নিয়ম করেছে। তাদের জিজ্ঞাসা করা হল কেউ যদি পাঁচটা কিনতে চায় সেক্ষেত্রে কি ট্রায়াল ছাড়াই নিতে হবে। তাদের কথা হচ্ছে ট্রায়াল শুধু সাইজ দেখার জন্য তাই তিনটির বেশি নিলেও ট্রায়াল দেওয়া যাবে না। আপনি ট্রায়াল না দিলে বুঝবেন না ওই পাঞ্জাবী আপনার গায়ে ঠিকমত হচ্ছে কি-না কিন্তু কিনতে চাইলে ট্রায়াল ছাড়াই কিনতে হবে। এদিকে শপ অ্যাসিসট্যান্টদের ডেকে সাইজ দিতে বললেও পাওয়া যায় না। কেউ হয়ত চিপায় যেয়ে মোবাইলে ফিসফিস করে কথা বলছে, কেউ আবার সাইজ দেখাতে বললে বিরক্তি দেখাচ্ছে! বন্ধুটির কাছে গিফট কার্ড থাকায় বাধ্য হয়ে দুটো পাঞ্জাবী কিনে বের হয়ে আসি আমরা, নাহলে এমন ব্যবহারের পর আর কেনার ইচ্ছাই থাকে না।

এরপর ভাবলাম ইফতারের পর চা-কফি কিছু খাইনি, একটু ক্যাফেইন শরীরে না ঢুকলে আর দাঁড়াতেই পারবো না। মার্কেটের লবিতে দাঁড়িয়ে থাকা ইনস্ট্যান্ট কফি স্টল থেকে একটা কফি নিলাম। ছোট্ট এক কাপ কফির দাম পঁচিশ টাকা! এগুলো বাইরে দশ টাকা কাপ হিসেবে বিক্রি করে। জিজ্ঞাসা করলে বলল মার্কেটের মালিক এই দাম ঠিক করে দিছে, সে বিক্রেতা মাত্র। এরপর আর কি বলার থাকে! বাধ্য হলে এটাই খেতে হবে। আর সেই বাধ্য অবস্থার সুযোগ নিয়েই দশ টাকার কফির কাপ হয়ে গেছে পঁচিশ টাকা।

বিজ্ঞাপন

এখন অনেকেই বলবেন মার্কেটে গেলে তো এগুলো ফেইস করতেই হবে, অনলাইনে কেনেন। অনলাইনে শাড়ি, কসমেটিকস, গয়না ও চেনা দুয়েকটা দোকানের কুর্তি ছাড়া কিছু কিনি না। অভিজ্ঞতা ভালো না। পোশাক ও জুতা আসলে আরামের জন্য পরা। সেই আরাম শুধু ছবি দেখে আমি বুঝি না। এবারও দেখা গেল অ্যাপেক্সের ওয়েবসাইট থেকে দুটো স্যান্ডেলের ছবি নিয়ে গেলাম। শো-রুমে যেয়ে পায়ে দিয়ে দেখি একটুও আরাম লাগে না। শেষমেশ কয়েকটা জুতা ও স্যান্ডেল ট্রায়াল দিয়ে দুটো স্যান্ডেল কিনে আনলাম যা অনলাইনে দেখিইনি। ভাগ্যিস, এরা তিনটির বেশি ট্রায়াল দেওয়া যাবে না নিয়ম করে নাই। নাহলে তো আমার ঈদের জুতাই কেনা হত না!

বড় মার্কেটে, দুটো টাকা বেশি দিয়ে কেনার জন্য যেয়েই যা অভিজ্ঞতা হয়, এর চেয়ে মনে হয় ঈদের আগে নিউ মার্কেটে যেয়ে কাপড় কিনে জামা বানাই। তবে কথায় আছে মেয়েদের ঈদ নষ্ট করতে দর্জি মামাদের অবস্থান নাকি সবার উপরে! তাই হয়ত ঈদ নষ্ট করার ভয়ে এবছরের তিক্ততা ভুলে আগামী বছরও গরম, ভিড়, জ্যাম আর ধাক্কাধাক্কি ভুলে দৌড়াব ঈদ শপিংয়ে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন