বিজ্ঞাপন

পিছুটান

April 25, 2023 | 5:57 pm

আহমাদ ইশতিয়াক

ষ্টেশনে পৌঁছে শূন্যমুখে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দেওয়ার পর প্রথম যে জিনিসটি নজরে এলো তা হলো রাধাচূড়া। ধূসর রাঙ্গা বাকলের উপরে মুক্তি দিচ্ছে শত বিচ্ছেদের। পুস্পস্তবকের মতো ডালি সাজিয়ে ছুটছে। চারপাশে রাশি রাশি ফুলের মাঝে সোনালুর ছিটে। প্ল্যাটফর্মের লণ্ঠনের আলো তাতে যেন অবমুক্ত হলো। কিন্তু তাতে রঙ চটে গেল রাধাচূড়ার। আশ্চর্য হলেও সত্য, প্রায় পত্রশূন্য গাছে হলদে রাঙ্গানো সোনালু এই শীতেও পাখা মেলেছে। লণ্ঠনের আলোর সঙ্গে কৃষ্ণচূড়া মানাতো। হলদে রাঙ্গাগুলো কেমন বিভ্রান্তির মতো লাগে। এই শতছিন্ন আলোতে প্ল্যাটফর্মটা বেশ পরিস্কার। হয়তো খানিক আগে ঝাড়ু দিয়ে সাফ করেছে নয়তো লোকের আনাগোনা পায়নি আজ। মাটিতে শুয়েছিল কুকুর এবং তার চোখ আধবোজা কখনো কখনোবা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখা। টিন আর বেড়ার মাঝে জানালার শার্সি এবং তার মধ্যে দিয়ে এই টিকেটঘর। টিকেটের উপর পাশে কয়লা গলানো কালি রাখা দানি।

বিজ্ঞাপন

ষ্ট্যাম্পটা একবার দানিতে তো একবার টিকেটের গায়ে। লোকটার হাত একবার উঠছে একবার নামছে। একাগ্রতায় ভীষণ মগ্ন। প্ল্যাটফর্মে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে এমন সব সময়ের লীলা দেখছিল মতিন। চোখজোড়া বড় শান্ত আর নিঃস্পৃহ। বেঞ্চি করে পাতানোর বাঁশের মাচার উপরে বসলো সে পা দুটো উঁচু করে। ডাউন আপ ট্রেনের সময়ের কোন ঠিকঠিকানা নেই। সন্ধ্যা ট্রেন মধ্যরাতে এলেও কেউ বলার নেই। চোখজুড়ে ঘুমে টলমল করছে। বেশ কিছুক্ষন ঘুমিয়ে জিরিয়ে নিলে হতো। মেইল ট্রেনটা আসে রাত বারোটায় সবে বাজে পৌনে নয়টা। এটাই শেষ ট্রেন। এরপর প্ল্যাটফর্ম কি রেললাইনে শুয়ে ঘুমালেও নিশ্চিন্ত। কারও আপত্তি নেই। অবশ্য ততোক্ষণে টিকেটের লোকটা চলে যাবে। আর স্টেশন মাস্টার তো বিকেল হলেই হাওয়া। কেবল থাকে চৌকিদার আর সবুজ পতাকা উত্তোলক।

ওরা থাকতোনা যদিনা ট্রেনটা স্টেশনে থামতো। দিন রাতে ট্রেনই থামে তিনটি। দুটো মেইল আর একটা ডেমু। উপর দিয়ে আন্তঃনগর চলে যায় গন্তব্যের পানে। টিকেট কাটবার জন্য উঠলো মতিন। চাদরটা উঁচু করে শরীরের উপর ঘুরালো সে। পৌষ শুরু হতে এখনো দুই সপ্তাহ বাকি মধ্য অগ্রহায়নেই শীত জমে গেছে। শেষরাতের দিকে কাঁপুনি বিঁধে হুল ফোটাবার মতো। তা সামলানোর শক্তি কাঁথার নেই দেড়স্তরের লেপ বের করলে তবে স্বস্তি মেলে। মাথাটা চারপাশে ঘুরিয়ে নিলো মতিন। তারপর সোজা পায়ে টিকেট ঘরের সামনে এসে পকেট থেকে আটআনা বের করে টিকেটঘরের ফাঁক দিয়ে হাত এগিয়ে দিয়ে বললো ‘বকুলডাঙ্গা একখান’। ‘ট্রেন আসতি দেরী হইবো, রাইত তিনটা বাজবার পারে। অহন টিকেট লইবেন নাকি আরও পরে লইবেন?’ ‘টিকেটখান দেন’ কথা না বাড়িয়ে বললো মতিন।

ধপ করে কয়লার দানিটার উপরে ষ্ট্যাম্প মেরে টিকেটের গায়ে ছাপ মারলো লোকটা। ‘বিটিশের কাম কারবার দেহো, যেন আজিব তেলেসমাতি’ বলেই লোকটা একআনাসহ টিকেট ফেরত দিলো। মতিন কিছু বলতে যাচ্ছিল ‘সে থাকলে আমার কি?’ কিন্তু ততোক্ষণে পিছনে বসা পেটমোটা লোকটাকে দেখে থমকে গেল সে; তবে ঐ পেটমোটা লোকটাই তার বলার উদ্দেশ্য ছিলো! টিকেটটা বুক পকেটে চালান করে দুদণ্ড প্রশান্তির শ্বাস নিলো সে। এখন শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলেও আর কোন আপত্তি নেই। কেবল ট্রেন আসলে জেগে উঠলেই হবে। কোনোমতে ঐ দরজাটুকু তারপর মেঝে সিট যেটাই হোক একটা জুটে যাবে। নম্বরবিহীন সিট ভাবতেই তার মনে পড়লো সে নিজেও তো নম্বরছাড়া মানুষ। নয়তো এক জীবনে কি পরিচয় ছিলো তার কি পরিচয় হলো!

বিজ্ঞাপন

ঐ যে ঢ্যাঙা শিমুলগাছটা, এমনই ঢ্যাঙা যে পাতা ঝরে গেছে। ল্যাংটা ভূতের মতো সেও ভূতের আকৃতি পেয়েছে। তাতে তামাম ভূতের পসার। কানাওয়ালার ঝি, বংশালি বাঁশঝাড় সঙ্গে যখন; তার নিকটে এখন ক’খানা ঘর পড়েছে। গাদাগাদি করে মুটুরেরা থাকে। ওরা কি উদ্বাস্তু? এদেশি নাকি অন্যদেশী? মতিন হাসে, আর কেউ কেন, বঙ্গমুলুকে সবই তো উদ্বাস্তু। ঐ ঢ্যাঙা শিমুল গাছটা কোন ন্যাড়া মরার সময়ে জন্মেছে, কোন অলক্ষুণে সময়ে বীজ ফেটে চারাগাছ হয়েছে কে জানে। কেবল পিটপিট করে দেখে কুকুরটা। সে কি জানে এমন কতকিছু ভাবছে মতিন। একবার শোয়, একবার বসে একবার খাড়ায় যেন মুতবে এবার এমন ভান করে। তারপর লেজ দোলায় যেভাবে যে কোন অশরীরী গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খানিকটা ঘুরে আবার শুয়ে পড়ে। পিটপিট দেখে আবার লেজ দুলিয়ে চোখ বুজে; চোখ বোজার পরও লেজ দোলায়। লণ্ঠনের নিচে যেন অশরীরীর ছায়া। তাতে একটা লন্ঠন নিভে যায়।

না অশরীরী নয়; অশরীরীর ছায়া পড়ে না। সেই বেড়ার ছায়া জানান দেয় আমি অশরীরী নই। শরীরী তবে মানুষ নই। কেবল জড় পদার্থ। যেমন ছায়া পড়ে কুকুরটার। সে শুনতে পেলে বলতো, আমি অশরীরী নই আমি কেবলই সারমেয়। প্রয়োজন হলে নিষ্ঠুর নই তোমাদের মতো, কিন্তু তোমাদের অনুরূপ উদ্বাস্তু। আচ্ছা কুকুরেরা কি উদ্বাস্তু হয়? কুকুররা একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। মিলন করে, বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চা বড় হয়ে ঘুরে, আলাদা হয় মার থেকে। তারপর নিজেই গণ্য হয়ে যায় স্বাধীন প্রাণীতে। ঝোলা থেকে রুটি তুলে মতিন। সেই রুটির একখণ্ড নিজে খায় একাংশ রুটি ছুঁড়ে দেয় কুকুরটার সামনে।

কুকুরটা প্রথমে খায় না। শুঁকশুঁক শুঁকে নাক লাগিয়ে। ‘বিষ খাওয়াইনা তরে। তরে বিষ খাওয়াইয়া আমার লাভ কি?’ কুকুরটার দিকে বদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে মতিন। কুকুরটা কি তার মনের কথা বুঝতে পারছে? নয়তো এমন খাচ্ছে কেন? জল খায় নাকি শুষ্ক রুটি? তাতে লাগে অমৃতচরণ। এবার যেন সে আদর চায় কাছে এসে বসতে চায় বোধহয়। দ্বিতীয় দফা রুটির আরেক টুকরো দেয় মতিন; এবার প্রথমবারের চেয়ে ছোট আকৃতির মানচিত্র ধরনের। বগলের তলের ঝোলায় এখনো পাঁচটা রুটি অবশিষ্ট আছে। কুকুরটা ফের পিটপিট করে দেখেনা। প্রথমবারেই গোগ্রাসে চাবায়। কৃতজ্ঞ হয়ে ঘুরে।

বিজ্ঞাপন

মতিন আর তাকায় না, ঢ্যাঙা শিমুলগাছটার দিকে, পাতাঝরা শিমুলগাছটা ন্যাংটা হয়ে আছে, উলঙ্গ নারীর মতো লাগে। উলঙ্গ নারীর চেয়ে অর্ধ উলঙ্গ নারী বেশী আকর্ষণীয়, অধিক সৌন্দর্যময়ী, আকর্ষণীয়। শিমুলগাছটার সে সৌন্দর্য নেই; সে নারী বটে নয়তো ফুল দেয় কি কবে? তুলা উঠে কি করে? যেমন ছিলো তেমনই কেবল তখন উদ্বাস্তু মুটেরদের ঘরগুলো ছিলো না। ছিলো না এমন পত্রহারা চেহারা। তখন সবুজে ছাঁকা, তার উপর ছিলো পূর্ণিমা রাত। আজকের মতো এমন পঞ্চমীর চাঁদ নয়। আবছা স্মৃতিতে ভাসে স্মৃতি হাতড়িয়ে মিলে না আর কিছুই। সে দৃষ্টি শুকিয়ে আসে। নেমেছিল একটি হাতে, মাতৃত্ব আর কোমলমতি রাতের শুরুতে। তারপর কতো কোজাগরী গেল এমন চাঁদের লহরি জোসনাও তো এলোনা। সেই গলা সদৃশ চাঁদটা যেন ভেংচি মারে। সুঁইয়ের পিচকির মতো, ভীমরুলের হুলের মতো সুতীক্ষ্ণ যন্ত্রণা দেয়। তবু এর চিকিৎসা আছে, কিন্তু আগের যন্ত্রণার উপশম নেই। নিদারুন সেই শূন্যতার ক্ষীনতা আছে। ঢ্যাঙা শিমুলগাছটার চূড়ায় উঠে যায় পঞ্চমীর চাঁদ। পুরু হয়েছে বেশ। এ চাঁদের আলো প্রস্থর ছাড়া পড়ে না। দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর হতে হয়।

এ চাঁদের আলো দোল খায় দিঘিতে। শিশু চাঁদ বলে পরিচিত নদী তীরে জলে যবে দোল খায় তখন বিমুগ্ধ চোখে মুখে কবিতা চেপে বসে। মেঘ নেই, কিন্তু কুয়াশায় ঢেকেছে চারপাশ। দক্ষিনের দিকে বাজার, পশ্চিমের দিকে বিস্তীর্ণ রেললাইনের পাশে ফসলের ক্ষেত। তাতে উদর প্রান্তবিহীন কুয়াশা। নৌকার ছইয়ের খোলা। মাঝে মাঝে হাওয়া ছাড়ে চারদিক হতে। কাঁপুনি সুদ্ধ হাওয়ায় চমকে যেতে হয় নিদারুণ শীতলতায়। ঐদিন এমন ঠাণ্ডা ছিলো না, বর্ষার মাঝে পূর্ণিমা রাত। মাঠজুড়ে অথৈ জলে থইথই। তার মাঝে উঁচু রেললাইন ধরে কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে বাঁকায় মোচড়ায় ট্রেন। কুকুরটা শুয়ে থাকে, দুচোখ বোঁজা তার। মাচার নিচে এই রাতেও গুঁড়ি পিঁপড়ার সারি। লন্ঠনটা বাঁশের চোঙার মধ্যে আটকানো। বাঁশের ছায়া পড়ে। মতিন উঠে। এভাবে সময় কাটে না। রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটে, পাতের উপর দিয়ে হাঁটে। ভারসাম্য ঠিক রাখা যায় না। একবার দুবার তিনবার চেষ্টা করে সে। ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারে না।

একবার দুবার তিনবার চেষ্টা করে। অবশেষে হয়, অনেকটুকু হাঁটতে পারে সে। চাঁদটাও যেন তার সঙ্গে হাঁটছে। স্টেশন দূরে ঝুপড়ির মতো মনে হয়। লণ্ঠনের আলোগুলোকে জেলে নৌকার আলোর মতো মনে হয়। ক্রমে ক্রমে দূরে চলে যায় সে। পা দুটো অবিরাম চলছে। সারাজীবন চললেও পা দুটো ক্লান্ত হবার নয়। অশরীরীর শক্তিতে যেন উষ্ণ হয়ে আসে। চাদরটা গা থেকে খুলে কাঁধে চড়ায় মতিন। ‘শুইনা যা মতিন, শুইনা যা’ তারপর আরও কাছে আরও কাছে শোনা যায় ‘শুইনা যা মতিন, শুইনা যা’। মতিন শুনতে পায় স্পষ্ট। আর স্পষ্ট শোনা যায়। মতিন চোখ বুজে, তারপর ফের মেলে। অস্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। শোঁ শোঁ শব্দ ভেঙ্গে আসে চারপাশ থেকে। এখানে সমুদ্রের শব্দ, সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ। রেললাইনের উপর বসে পড়ে মতিন। চোখ খুলে সঙ্গে সঙ্গে শব্দটাও অদৃশ্য হয়ে যায়। ঝিঁঝিঁর একটানা কোরাস। রেললাইনের দুধারে গাছ। কেমন বনের মতো গাছ। ঝোলা থেকে দিয়াশলাই বের করে মতিন। আগুন জালায়। রেললাইনের পাতের উপর ফেলে নিভে যাওয়া কাঠিটা। সে যেন নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। খানিকটা আলোয় আলোকিত হয়। তারপর জোরে বাতাস বয়ে যায়। অশরীরীরা যেন ধেয়ে আসছে। মতিন আড়ষ্ট হয়। বলে ‘কে কে অইহানে?’
‘আমি আমি।’ নিজে থেকেই আপনাভাবেই বলে সে।
আবার রব কে? ‘কে অইহানে?’
‘আমি, আমি।’ কে যেন বলে উঠে। মতিন শুনে এটি স্পষ্টই ওর গলা। মতিন চারপাশে ওর প্রতিধ্বনি শুনে। হাওয়ায় ভাসে ‘আমি মতিন, আমি মতিন’। সে উঠে হাঁটতে থাকে, হাঁটতে থাকে দূরের ষ্টেশনের আলোগুলো লক্ষ্য করে। দুপাশের ক্ষেত পেরিয়ে যায়। বাঁশঝাড়গুলো ধূসর হয়ে আসে। অস্পষ্ট জোসনার আলোতে দু তিনটা পেঁচা ডেকে উঠে। ঝিঁঝিঁর ডাক আর বুনো শব্দ দূর থেকে আসে।

এই পথ দিয়েই একদিন সে এসেছিল। তারপর কতোদিন যে গেল, কতো জায়গায় এই রেলপথ ধরেই গিয়েছিল সে। এমন নিস্তব্ধ পাতা পায়নি বটে। বেরোয়নি আজ রাতের মতো এমন রাত্রিরে। পেরিয়েছে বহু পথ, এমন শত নিস্তব্ধ পথ ও কিন্তু আজকের মতো এমন পথে কখনও আসেনি। বড় ভালো লাগছিলো মতিনের। ঘোলাটে চারপাশটা কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। কাঁধের উপর জল জমলে যেমনটা হয় ঠিক দূরের পথটুকু মনে হচ্ছে মরীচিকার মতো। হাত পা অনিচ্ছায় নড়ছে সে এক ঘোরের মধ্যে আছে। শরীর সায় দিচ্ছে অবলীলায়। হাত পা ক্লান্ত হয়ে আসছে। কিন্তু সে বসলোনা। রেললাইন ছেড়ে নামলো। নিচু পথ ধরে হাঁটলো। তারপর আবার রেললাইনে ফিরে এলো। পঞ্চমীর চাঁদটার আলো তেমন নেই। অন্ধকারে আবছা আলো পড়লে যেমনটা হয়, ঠিক তেমনই চাদরটায় বেশ আরাম অনুভব করছে সে।

বিজ্ঞাপন

এই রাস্তা এই রেলপথ ধরে এসেছিলো মতিন। সেই কতো বছর আগে। তখন বয়সটা শৈশবে পড়ে ছিলো। এমন রাত নয় তবে সন্ধ্যা। আসেনি এই রাত আর কখনো। যে মাত্র গেল বোনটা। সঙ্গের ভাই ও গেল। অর্থব বাবাও চলে গেল। তারপর আর কি করার ছিলো? কি করে মা তিনটি প্রাণ নিয়ে ছুটে এলো এখানে তা হয়তো কখনোই কারও জানা হবেনা। এখন কেমন আর তখন কেমন। সময়ের পার্থক্য কতো দীর্ঘ।

ওখানে ছিলো শোচনীয় অবস্থা। বাপ মরার আগে থেকেই মার উপর ছিলো পিশাচদের সাংঘাতিক লোভ সে আর না বলতে। বাপ ও ছিলো অর্থব ভঙ্গুর। শেষদিকে ধরেছিলো মৃগীরোগ। সে করেই ধীরে ধীরে শেষ হলো। কারও কোন আফসোস ও নেই তার উপর। মাকে বাবা মরার পর একবারো আফসোস করতে দেখেনি সে। তবে বাপ ছিলো এক ভরসা। মহিলাদের স্বামী আর যাই হোক স্বামী নাকি রক্ষাকর্তা। পরপুরুষের যতোই দৃষ্টি পড়ুক বিবাহিত হলে নিরাপদ বা রক্ষিত, আর অবিবাহিত হলে অরক্ষিত। এটাই ঠিক বোঝা গেল বাবার মরার পর। যেন দৌড়ে আসলো ক্ষুধার্ত হিংস্র নেকড়ের মতো। আর কই বেচারামপুর ওখানটায় এমনিতেই উন্মাদ মানুষের জায়গা। ভালো মানুষ ওখানে দুদিন জিরোতে পারে! শেষে পালিয়ে আসার মতোই অবস্থা হলো। মায়ের মামাই আশ্রয় দিলেন। আপন মামা নয়, নানীর চাচাতো ভাই। তবুও তো মামা। আপন মামারাই বা আর কি করলো। উল্টো বিয়ের কথা তুলল। কেবল আরেকটা বিয়ে দিয়ে দেওয়ার তালে ছিল। পাত্রও নাকি মাস্তান গোছের। রোজ এসে শাসিয়ে যেত।

এদের লজ্জা শরমের বালাই নেই। এক ছেলের বয়স আট পেরিয়েছে অথচ তাও কি চোখ রাঙ্গানি। এক ভ্যারেণ্ডা বাজিয়ের থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে মাতালের কাছে! বাহ বেশ উন্নতি হয়েছে! কিন্তু লোকটার টাকা গাড়ি ছিলো। টাকা গাড়ি দিয়ে কি হতো! সারা সন্ধ্যাভর মাতলামি করে নাকি গভীর রাতে বাড়ি ফিরে আসত। এসেই বউ পেটাত। পিটিয়ে পিটিয়ে দুই বউকে শেষ করল। শুনে মা আঁতকে উঠেছিল। শেষে মার সঙ্গে না পেরে নানী বলল ‘ইসরাফিলের কাছত চইলা যা।’ তখন তিনি পোস্ট মাস্টার। এখানে ঘর-দোর সবে করা। রান্না-বান্না করার জন্য একটা লোক দরকার। তাতেই মা রাজি হলো। কাজ তো জুটল।

তবে মামা খানিকটা ভবঘুরে আর উড়নচন্ডী। তবে চাকরি তো পায়ে পড়া সোনা। চাকরি যাওয়ার ভয় নেই। বয়স থাকতে বিয়ে করেনি। বয়স পেরিয়ে গেছে বলে সেই ধাতেও নেই। চলে যায় কেটে যায় দিনকাল, তবে সমস্যা ছিল। কিন্তু চিঠি লিখতেই বললো তবে তো বেশ। এখানে তো আমার সময়ই কাটেনা। এদের নিয়ে সময় কাটবে। তবে তো বেশ হয়। তাতেই হলো আর আপত্তি কিসের নেকড়ের পালের গোদার চেয়ে এ যে স্বর্গ। নিয়ম করে একদিন মার কাছে এলো মামা-ই। তুলে দিলো ট্রেনে। যতক্ষণে আসলো মতিনরা ততোক্ষণে পেরিয়ে গেছে সন্ধ্যাও। পূর্ণ জোসনায় চোখ বন্ধ করে স্পট যেন দেখতে পাচ্ছিলো মতিন। সেই চলে আসা।

তারপর তো আর ফেরা হলো না। দেখে আসাও হলো না বাপের কবরের মাটিটুকুও। মার কবর হয়েছে এখানে, ঐ বিলের পাড়ে কবরস্থানে। বাপ অথর্ব, মনে মনে বলে মতিন। অথর্ব হলেও জন্মদাতা তো। মার আগে গিয়েছিল বিন্দা আর মঈন। এখানে সবই গেল, এলো কে! এলো বটে চামেলি। তাও বিয়ের আধ বছর গেলে সেও একরাতের ভেদবমিতে ফটাস। মা তো কতো করে চেয়েছিলো আরেকটি বিয়ে করাবার। লোকে কি বিয়ে করে না! ছেলেপুলে কিছুই হয়নি। ঐ বউ কপালে ছিলো না। কিন্তু মতিন যে গোঁ ধরলো সেই গোঁ আর ছাড়লো না মতিন। জন্মের মতো ঘাড় ত্যাড়া। মা বলতো ‘তুই তর বাপের মতো। তর বাপের চাইল নাই চুলা নাই কিন্তুক কল্লা একখান আছিলো মাশাল্লাহ। জন্ম ত্যাড়া ডাইনে গেছে তো গেছেই ঠ্যাং ধইরাও বায়ে লইবার পারবো না কেউ।’ এখন মনে হয় মতিনের ‘তখন বিয়েটা করতে পারলে বেশ হতো। চামেলি মরেছে নয় বছর আগে। তখন বিয়ে করলে এতোদিনে একগাদা বাচ্চার বাপ হয়ে যেত সে। কিন্তু চামেলি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংসারিক জীবনের প্রতি জন্মের মতো ঘৃণা চড়ে গেল তার।

চাঁদটা আরেকটু চড়ে উঠেছে। রেললাইনের পাতের উপর থেকে উঠে দাঁড়ালো মতিন। শরীরটা দুলছে। ঠাণ্ডায় আবার জ্বরটর না চলে আসে। কপালে হাত দিলো মতিন। ঠাণ্ডা কপাল। এই ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে যাওয়া অমূলক নয়। যদিও চড়া ঠাণ্ডা নেই তবু রোগব্যাধি তো নোটিশ মানে না। সে দাঁড়ালো তারপর চললো। হাঁটতে হাঁটতেই দুহাত সমানে ঘষলো। তাৎক্ষনিকভাবে শরীর উষ্ণ করে নেয়ার কৌশল এটি। হাঁটতে হাঁটতে ষ্টেশনের কাছে চলে এলো সে। ষ্টেশনের টিকেট ঘরের টিনের চালে চালকুমড়োর মাচা দিয়েছে। বেশ ধরেছে। দোচালা ঘরে চালকুমড়ো বেশ হয় তবে তারচেয়েও বেশী ধরে একচালা ঘরে। তবে একচালা ঘরে খানিক ফুটো হলে ঝরঝরিয়ে পানি ঝরে তাই মানুষ জুতসই বলে দোচালা ঘরই করে। সবদিক দিয়েই সুবিধে।

শীতকালে শীত কম পড়ে, গরমকালে বেশ ঠাণ্ডা থাকে মাটির ঘরের মতো। লন্ঠন দুটো জ্বলছে। একটা মাঝামাঝি আরেকটা একপাশের শেষে ওটা মোটামুটি অন্ধকার থাকার কথা ছিলো। যদিও ঘরের লন্ঠনের আলো পড়ছে বলে ওপাশটাতেও আবছা আলো পড়ছে। হঠাৎ বিড়ি কিনবার ধাত হলো মতিনের। দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। ঢ্যাঙা শিমুলগাছটার আগায় উঠে গেল চাঁদ। আকাশটা বেশ স্পষ্ট। টিকেট ঘরের সামনে এগুতেই মতিন দেখলো লোকটা উঠছে। পিছনের মোটা লোকটা নেই, সম্ভবত চলে গেছে। লোকটা তোড়জোড় শেষ করে টিকেট ঘরের বাইরে এলো। ঘরটার উপরে শিকল টেনে তালাবদ্ধ করলো তারপর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বললো ‘আপনের গাড়ির দেরী আছে। লেইট হইবে আইজ।’ সাদা আলোয়ানটা সামনে আনলো লোকটা।

‘আপনে চইলা যাইবেন?’ মতিন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল।
‘বাইরে তো কোন কাম নাই। আইজ তো মানুষজন ও দেহি না। আপনে আইলেন, আর আপনের ঘণ্টা খানিক আগে তিনজন আইলো। ষ্টেশনের লগেই বাড়ি তারগো। ওগো আসবার দেরী আছে। আপনে আওনের খানিক আগে হেরা লোক পাঠাইয়া খবর নিছে ট্রেন কতক্ষণে আসবো। দেরী হইবো নাকি। কইলাম দেরী হইবো আইচ্ছা কইয়া চইলা গেল।’ মুখ থেকে পানের পিক ফেলে বললো লোকটি।
‘আর লোক আসলে? তখন টিকেট কই থেইকা পাইবো?’
‘আছে আছে। আমি যামু ঐ মুন্সি তো থাকবো, নেকাব্বর থাকবো। দুজন থাকবো। একজন তো সারারাইত থাকবো। আরেকজন থাকবো ট্রেন আসলে আলো দেখার লাগবো। তারপর হে যাইবোগা। টিকেট ওই বেচবো। আমার শইলটা ভালা না এর লাইগা চইলা যাই।’ লোকটা জবাবদিহিতার গলায় বলে। লোকটি এমনভাবে বলছে যে, মতিন হয়তো তার কর্তা। এতো কথা বলারও কোন কারন খুঁজে পেলোনা মতিন।

মুন্সি নেকাব্বর বলে লোকটা সামনের দিকে এগুলো। নেকাব্বর নামের চৌকিদারটা ঝিমুচ্ছিলো। লোকটা ক্ষেপে গিয়ে পিঠে হাতে রেখে বলল ‘ঘুমাইস না। দিন ধইরা কি করস? চুরি করস নাহি? এতো ঘুমাইয়া কি করবি? বেহান ধরি বিকেল ধরি খালি ঘুমাইস। তহন তো কেউ কিছু তরে কয় না। অহন ঘুমাইস না। দেহি উঠ।’ লোকটা আংশিক চোখ মেলেই ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে যায়। ওকে ফাঁকি দিয়ে ওর চোখে ঘুম ভর করেছে। দিনভর খালি ঘুম। হাত মুখ ধুইয়া ল। চা খাইয়া ল। তয় ঘুম আর আসবো না। নেকাব্বর টিউবওয়েলের ধারে গিয়ে মুখে চোখে পানি দেয়। বাইরে থেকে একটা লোক এগিয়ে আসতেই লোকটা বললো ‘মুন্সি আমি যাইগা। ট্রেনে উঠাইয়া দিও। চাইরজন হইলো। রাইতের তো অহন আর তেমন হইবো না। মনোহরপুরের থেইকা লোক উঠবো। এদিকের আর লোক কই। বুধবার শনিবার হইলে লোক দেখা যাইতো।’

‘মাস্টার বাবুর কোন এক আত্মীয় আছে নাকি?’ মুন্সি তাকিয়ে বলল।
‘না, টিকেট ফিরাইয়া দিছে। ওই আন্তঃনগরে যাইবো। টেকা থাকলে আর কি! বাসে কৃষ্ণপুর যাইবো ঐহান থেইকা ট্রেনে উঠবো। তুমি থাকো গেলাম আমি।’ বলে সাইকলটা ধরে লোকটা।
‘কই থেইকা কিনলা? কতো লইলো?’
‘এই দুইশো টেকা। ঐ জেলায় গেছিলাম।’
‘আইজ প্রথম আনছো কেন?’ কৌতূহলী গলায় বললো লোকটা।
‘হ। বার করি নাই। নোয়া জিনিস তো জাপানি জিনিস।’ বলে সাইকেলে হাত বুলায় মুন্সি।
‘আইচ্ছা ভালা হইছে জিনিসখান খাঁটি জিনিস। আইজ ট্রেন লেইট হইবে। কতোক্ষন আগে কইলো মেলা দেরী। হইলে দুইটা।
অহন কয়টা বাজে?’
‘এগারোটার মতো। আমি গেলাম। সাইকেলটা কইলাম চালাইবার দেওন লাগবো।’ মুচকি হেসে বললো লোকটি।
‘ঠিক আছে চালাইবার দিমুনে।’ বলেই সাইকেলের চাকায় শিকল বাঁধে মুন্সি। তার উপর জাপানী তালা লাগিয়ে চাদর মাথার উপর উঠিয়ে দেয় মুন্সি। তারপর মতিনের দিকে তাকিয়ে বলে ‘ভাইজানে কই যাইবেন?’
‘বকুলডাঙ্গা।’
‘সে তো মেলাদুর। টিকেট কাইটছেন?’
‘হ।’ স্থির হয়ে বলে মতিন।
‘ভাইয়ের বাড়ি কি এইহানে নাকি ঐ জায়গাত?’
কি জবাব দিবে মতিন? এখানেও না ওখানেও না। এখানে তো উদ্বাস্তুর মতোই। আর ওখানে সব নদী খেয়ে নিয়েছে গোগ্রাসে। এখানে তবু তো ভিটে কিনেছে সে। সে ধীরে বলে ‘এইহানে’।
‘এইহানে কই?’
‘মিঠাখালী।’
‘ও। বকুলডাঙ্গায় কি কাম?’ বলে শিকলটার দিকে হাত বাড়ায় সে। দরজার শিকলটা দেখে তা শোনার অপেক্ষা না করেই ‘চইলা গেল নাকি’ বলে দৌড়ায় মুন্সি। হাতের সাইকেলের চাবিটা পড়ে আছে নিচে আর সে সামনে দৌড়িয়ে এসে বলে ‘মহিউদ্দিন ভাই’। লোকটা ততোক্ষণে কতদূর গেছে কে জানে। মুন্সি দৌড়িয়ে ক্রমশ আঁধারের দিকে চলে যায়, এবং হারিয়ে যায়। । সেই বাঁশের মাচাটা আর নেই। সামনে ঢ্যাঙা শিমুলগাছটা আর তার মাথার উপরে পঞ্চমীর চাঁদটা। কুকুরটা ঘুমিয়ে থাকে।

তখন ত্রস্ত হয়ে মুন্সি ফিরে আসে এবং মতিনের দিকে তাকিয়ে বলে ‘হেত এক পাগল, মুইও আরেক পাগল। চাবিখান লইয়ে চইলে গেলো। হের দিবার মনে নাই, মোর চাইবার মনে নাই। আর মুইও চামু মোর হেই খেয়াল নাই। কিছু মনে কইরেন না, মুই কথা বেশী কই। মোর সমইস্যা হইলো ঐ একখানই।’ বলতে বলতে লোকটার মুখ হাসিতে ভেসে যায়। লোকটা বেশ সহজ সরল, পেটে বোধহয় কোন কথাই রাখতে পারেনা। যাদের পেটে প্যাঁচ কম থাকে এরা নাকি গরগরিয়ে কথা বলে, পেটে কথা রাখতে পারেনা। কোথায় যেন শুনেছে মতিন।
মুন্সি শিকলখুলে লণ্ঠনের টিমটিম আলোটা বাড়িয়ে দেয়। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে ‘চা খাইবেন?’
‘না’ মাথা নাড়িয়ে মতিন বলে।

‘শরম কইরেন না। খাওনের সময় শরম করতি নাই। চা আছে। মোর ঘুমে ঝুরায় বুইঝছেন! ঝুরায় যে এর লাইগা মুই চা খাই। খানিক বাদে বাদে চা খাই। চা খাইলে মোর ঘুমে ঝুরায় না।’ মুন্সি সরল গলায় বলে। মতিন কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। লোকটা ইকনিকে মাটির পেয়ালাটা উঠায়। তাতে পানি ঢালে। আগুন বাড়ায়। চা বানানো দেখতেও ভালো লাগে মতিনের। ইংরেজরা আর যা পারুক বা না পারুক এই চায়ের নেশাটা বাঙালিদের ধরিয়ে দিয়েছে। রোগে পড়লে মানুষ দলে দলে চা খায়, সর্বোৎকৃষ্ট ঔষধ মানে। সে ঠাণ্ডা ধরা হোক আর ঘুমে ধরা হোক। মুন্সি পেয়ালার ফুটানো পানিতে চায়ের গুঁড়ো ঢালে।

পানি লাল টকটকে হয়ে যায় তারপরে লোকটা আরও গুঁড়ো ঢালে। এতোবার চা বানানো দেখলেও মুগ্ধ চোখে পুনরায় দেখে সে। মাটির ভাঁড়ে অতঃপর গুঁড় ঢালে মুন্সি। চায়ের পেয়ালা উঠিয়ে মাটির ভাঁড়ে ছাকনি দিয়ে চা ঢালে। মোট তিনটা ভাঁড়ে ভাগ করে রাখে। একটা ভাঁড় মতিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে মুন্সি বলে ‘দেন লন, হইয়া গেছে।’ তবু নিতে লজ্জা পাচ্ছিলো মতিন। অন্যের জিনিস নেয়ার প্রতি সবসময়ই তার জড়তা এসে যায়। মুন্সি যেন বুঝতে পারে তাই বলে ‘মুই দিতাছি আপনে তো চাইয়া লন নাই।’ এবার পুনরায় আরেকদফা লজ্জা পেয়ে চা নেয় মতিন। মুন্সি চায়ে চুমুক দেয়। ‘তো বকুলডাঙ্গা কি কোন কামে যাইতাছেন?’ মতিনের দিকে তাকিয়ে বলে মুন্সি।
‘না।’
‘ও বুঝছি ঘুরবার?’
‘না।’ ঠাণ্ডা গলায় বলে মতিন।
‘তাইলে?’ কৌতূহলী গলায় বলে মুন্সি।
‘আব্বার কবর আর দাদা দাদির কবর জেয়ারত করমু।’ কি স্বাচ্ছন্দ্যে বলে দিলো মতিন, নিজেই অবাক হয় সে।
‘ও অইহানে আপনেগো এককালে বাড়ি আছিলো না?’
‘হ।’ নির্জীব গলায় বলে মতিন।
‘বেইচা ফালাইছেন?’
‘না, নদীয়ে ভাংছে।’ চায়ের চুমুকটা দিয়ে মতিন ভাঙ্গা গলায় বলে।
‘ও আল্লার কি রহমত কবরখানা রাখছে।’
‘না!’ দুপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে মতিন।
‘তয়?’
‘কবরও নাই।’
‘তয় কইলেন যে কবর জেয়ারত করবার যাইতাছেন!’ কণ্ঠে বিভ্রান্তির সুর মুন্সির।
‘তা তো কবর জেয়ারতের লাইগাই যাইতাছি।’ চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বলে মতিন।

মুন্সির চোখেমুখে পরিস্কার ভ্রান্তির রেশ। সে কিছুই বুঝতে পারেনি। ‘কবর ভাংছে ঠিক, তয় নদীর কোন পাশে তো কবর আছে। সব নদীর পানিত শেষ, কোন জায়গা আছিলো আমার মনে আছে।’ এবার খোলসা করে মতিন। তাতে ধীরে ধীরে উত্তর পেয়ে গেল মুন্সি। তবুও তার মনে হলো লোকটা বোধহয় পাগল। মুন্সি উঠে পড়ে তারপর বলে ‘হে মনে হয় ঘুম যায়। দেহি জাগাইয়া আহি।’ বলেই চা ভর্তি মাটির ভাঁড়টা হাতে নেয় তারপর অন্যহাতে লাঠিটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। মতিন হাত থেকে মাটির ভাঁড়টা রাখে টেবিলের উপর।

মুন্সি বাইরে থেকে শূন্য হাতে আসে। হেসে উঠে বলে ‘আর কয়েন না। ঘুম যাওনের ছিল বাকি। বেহান ধরি ঘুম যায় দুরফে উঠে রাইতের ঘুম আবার নেকাব্বরের কেমনে যে আসে। এতো ঘুম যাইবার কেমনে পারে মোর মাথাত ধরেনা। খালী ঘুম আর ঘুম। একবার গেলে মনে হয় কেউ না জাগাইলে এক সপ্তাহ ঘুমাইবার পারবো। সরকারী চাকরি করনে আরামে আছে তো, সরকারে তো আইয়া চায়না ঘুম গেছে নাকি কাম করছে। কিন্তু তয় মনরে বুঝ দিবার লাগি টেকা হালাল করনের লাগি কাম তো কিছু করন লাগবো। এম্নে রাইত ধইরা ঘুম যাইয়া কি হইবো!
এর লাইগা চুরি হয় না?’

‘চুরি হয় না আবার। অয় পাত্থর চুরি হয়, হেই কি মোরা জানি। দিনাত ধরি কতো লোক আহে যায়। এইহানে আহে দুইখান মেল আর একখান ডেমু। মেইলে তয় কি যাত্রী অয়! নামে কয়জনে, উডে কয়জনে! হে হিসাব টিকিটের হিসাব থাকে। টিকেট না কাইটাও তো কতো লোকে যায়! আর শনিবার অইলে লোক বেশী।’ মুন্সি গড়গড় বলতে বলতে টিকেট ঘরের ভিতরে ঢুকে।

‘কয়টা বাজে?’ জিজ্ঞেস করে মতিন। ‘পৌনে বারোটা।’ উত্তর দেয় মুন্সি। টিকেটটা দেখে মতিন। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে লেখাতার দিকে তাকিয়ে মতিন বলে, ‘ভাই ট্রেন আইবার কতক্ষণ?’
‘অহনো দেরী আছে। দেড়টার আগে ট্রেন আইবো না, চিন্তা কইরেন না।’ ট্রেনটা যথা সময়ে এলে বারোটার দিকে যেত ভাবলো মতিন। টিকেটটার গায়ে বকুলডাঙ্গা লেখা। লেখাটা দেখে শরীরে শিহরণ অনুভব করলো মমিন। যদিও ওখানে আর কোন টান নেই। সেই আসার পর থেকে একবারের জন্যও যায়নি সে। কেউ যেতে বলেওনি। বলবেই বা কি করে, ওদের নিজেদেরও কি অস্তিত্ব আছে। সব নদী খেয়েছে। চামেলি থাকলে এতোদিনে একটা সুন্দর সংসার হতো। অথচ ভেঙ্গে গেল, ফেঁসে গেল জীবনটা। আজ যেন সে জীবনের দাহ করতে যাচ্ছে।

কুয়াশাটা নেমে গেছে। পলকা হাওয়ার ঠাণ্ডাটা কড়কড়িয়ে লাগছে। গ্রামগুলো ঘোলাটে থেকে খানিকটা স্পষ্ট হচ্ছে। এখন গিয়ে কি হবে? কেন যাচ্ছে সে? মনে মনে প্রশ্ন জাগলো মতিনের। কাকেই বা আর দেখে সে চিনতে পারবে? বছর তিনেক আগে এসেছিলো কাকা। মা তখন জীবিত। এসেছিলো খোঁজ নিয়ে। যেবার নদীতে ঘর দুয়ার সব ভাংলো। ভিটেবাড়ি সব এক রাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কেন এসেছিলো জানতো মতিন। এসেছিলো অথৈ জলে পড়ে। তবু মায়ের অনুরোধে কিছু দিয়েছিলো মতিন। দিতে কার্পণ্য করতো না যদি এই কাকা না হয়ে অন্য কোন পরিচিত অপরিচিত লোক হতো। এই কাকাই এক সময় মাকে অপমান করতে ছাড়েনি। পিছনে লোক লাগিয়ে বাড়ি থেকে তাড়ালো। জায়গা দখল করল। ঐ লোকগুলো শেষমেশ মার পিছনে লাগল।

ঐ লোকগুলোকে ধরে বাবার সম্পত্তি বাগিয়ে নিল। পুকুর টেনে বেড়া দিলো দখলের। তাদের বিরুদ্ধে গাঁয়ের লোক অব্দি টুঁ শব্দ করতে পারতোনা। সবের পিছনে কলকাঠি নেড়েছে তো এই লোকই। সে জমি দখল করলো বটে কিন্তু কি করতে পারলো? নদী সব গিলেছে। দুইদিনেই দেড় গ্রাম উজাড় করে খেয়েছে। নিজের জমি, দখল করা জমি সব। নদী ভাংলে মসজিদ কি আর মন্দির কি শ্মশান কি আর কবরস্থান কি সব নিমিষেই জলের তলে। তখন লর্ড লিটন কি আর রাণী ভিক্টোরিয়া হোক, ইমাম কি আর পুরোহিত কি! সব ভেঙ্গে সাফ।
তবুও দিয়েছিলো বটে সে। কাকা এসেছিলো ভিক্ষুকের মতো। মার আবার দয়ার শরীর। বলে ‘এখানে থেকে যাইবার পারোস। বাড়িত যাইয়া আর কি করবি? অহন তো বেবাক নদী।’ কাকা তো হাতে যেন স্বর্গ পাচ্ছিল। থাকতে তার আপত্তি নেই। সে দয়া মতিন দেখাল না। যথেষ্ট করেছে। খেদিয়ে বিদায় করেনি যে এই ঢের। খোদার শিক্ষা খোদা দিয়েছে। এবার শিক্ষা হলেই হয়। কিন্তু মতিন উপরে বললো ভিন্ন কথা। বলল, ‘রিফিউজি হইয়া যান। জমি জিরাত সব পাইবেন।’ কাকা মাথা উঁচু করে বললো ‘কনে পামু?’ মতিন বিস্মিত হলো। লোকটার লোভ এখনো যায়নি! এখনো চোখ লোভে চকচক করছে। সে বললো ‘কেন, নদিয়ার মজলিশপুরের দিকে চইলে যান।’ কাকার কণ্ঠে তবু আপত্তি নেই বরং সে প্রত্যাশায় বলে উঠলো ‘দেখি, যাইবার পারলে তো হইতোই।’

ঢ্যাঙা শিমুলগাছটা হাঁক পড়ছে। এক বর্ষায় দেখেছিলো সে। মতিন এমন সব বর্ষায় বহু জায়গায় গিয়েছে। ডিমাচুলি, কাচিনপুর, গঙ্গারামপুর, নানুদহ, কোটলা চাঁদপুর, নয়াগ্রাম এমন কতো নামের স্টেশন। তারপর নলদা, হাড়িরপুর, শিমুলগঞ্জ এমন চেনা অচেনা। প্রথমে কাঠের উপর লটকানো টিনের নামফলকটা দেখে মতিন সেই কবে মুখস্ত হয়ে গেছে। ডিমাচুলির কেবল পোস্ট অফিস, কাচিনপুরের পোস্ট অফিস গঙ্গারামপুরে। পাশে মার মামা বসে থাকতো সাইকেলের পিছনে পোস্ট অফিস গুলোতে যেত মতিন। সাইকেল সকালের ট্রেনে উঠিয়ে দিতো আবার স্টেশন এলে নামিয়ে দিতো। সেসব গঞ্জের হাটের লোকজনও চিনতো নানাকে। যাওয়ার সময় হাঁক ছাড়তও ‘বইসে যান মাস্টার মশাই।’ নানা পিছনে হাত তুলে বলতো ‘কাম আছে। আওনের সময় বসুম নে।’ আসার সময় আর বসা হয়না ওরা অন্য পথ দিয়ে ফিরে যেত। আসবার সময় ট্রেন তো আর নেই। আসে পরের মেইল ঐ রাত বারোটায়।

চারদিক নিস্তব্ধ, একটানা ঝিঁঝিঁর কোরাস। মুন্সি তাড়াতাড়ি করে। চারজন এসে পড়ে, আরও দুজন পিছুপিছু। এসেই হুমড়ি খেয়ে বলে ‘ট্রেন কতোদূর আইলো?’
‘চলি আসছে, আর বিশ মিনিট আছে।’ যতো দেরী হওয়ার কথা ছিলো ততো দেরী হয়নি। ওরা বাক্স পেটারা গোছায়। গোছানোর কিছুই নেই মতিনের। তাই তার ভাবনাও নেই। তবুও পকেটে চল্লিশ টাকা নিয়েছে সে। ব্যাগে দুটো লুঙ্গি ফতুয়া, পায়জামা একটা পাঞ্জাবীসহ কয়েকটা কাপড়। কাঁধে এক ঝোলা। যদি আত্মীয় কাউকে পায় তাদের জন্য তো কিছু দিতে পারবে এইজন্যই টাকা সঙ্গে নেয়া। কিন্তু সে কি কাউকে চিনবে! বাড়ি, বংশ কোথায় ভেসে গেছে। শেষ ছিলো মা; তাও এখন নেই। অবশ্য পোস্টমাস্টার নানাদের ঘরে একবার যাবে সে। সে তো নানার বাড়িতে। ওখানেও এখন কেউ নেই। মামারাও মরে গেছে। বহুদিন যাওয়া হয়না নানার বাড়িতেও। এবার সব একসাথে ঘুরে আসবে সে।

লোকগুলো তোড়জোড় করছে। কজন আর হবে তবুও মানুষের চলাচলে স্টেশন যেন প্রাণ ফিরে পায়। নেকাব্বর লোকটার ঘুম টুটে গেছে বোঝাই যায়। সে বাঁশিতে ফুঁ দেয়, ষ্টেশনের কুকুরটা পিটপিট তাকিয়ে দেখে অবস্থা। কতক্ষণ চোখ মেলে তাকায় আবার চোখে বুজে। দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। চলে এসেছে ট্রেন প্রায়। সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে যায় মতিনের। তবে সে ফিরছে বকুলডাঙ্গায়। তার জন্মভূমিতে। তবে সে ফিরছে তার শৈশবের টানে! ট্রেনটা আসতেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায় যাত্রীদের মধ্যে। মতিন টিকেট দেখার সুযোগটাও পায়না। মাত্র পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে ফের টান দিবে ট্রেন। বেশ ফাঁকাই ট্রেন। উপরে উঠে সে সিটের উপর চাদরটা রাখে।

তারপর জানালার পাশ দিয়ে তাকিয়ে হাত নাড়ায় মুন্সির উদ্দেশ্যে। মুন্সি দেখতে পেয়ে জোরে বলে ‘সাবধানে যাইয়েন। আসবার পরে দেখা কইরেন।’ ফের ভিতরে হাত ঢুকায় মতিন। বগির মানুষগুলো বিভোর ঘুমে মগ্ন। ঢ্যাঙা শিমুলগাছটার দিকে তাকায় মতিন। সেই আসবার সময় দেখেছিলো সে। তখন ছিলো পাতাভরা অথচ এখন পত্রশূন্য। ট্রেনটা ছাড়ছে, এক পা, দু পা করে এগুচ্ছে; শিশুকে হাঁটা শেখানোর মতো। তারপর কিশোরের মতো দৌড়াচ্ছে ক্রমান্বয়ে যুবকের মতো ছুটছে। পেরিয়ে যাচ্ছে কতো গ্রাম, আর কুয়াশগার বুক চিরে মেঠোপথ, বিল আর জগতের অজস্র পথ। মাথাটা বাইরে রাখে মতিন।

বাতাসের গতিতে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। বকুলডাঙ্গার পানে দীর্ঘ অভিমান ভেঙ্গে যাচ্ছে তবে সে। চোখ বুজে মতিন। হাওয়ায় ভেসে আসছে হরিহর পণ্ডিতের ধ্বনি ‘বল দুই একে দুই, দুই দু গুণে চার, তিন দু গুণে ছয়, চার দু গুণে আট’ । ‘আবার বল দুই একে দুই, দুই দু গুণে চার, তিন দু গুণে ছয়, চার দু গুণে আট, পাঁচ দু গুণে দশ। ছয় দু গুণে .. বা…র……।’

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন