বিজ্ঞাপন

কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা [সপ্তম পর্ব]

April 26, 2023 | 4:37 pm

মনি হায়দার

[সপ্তম পর্ব]

বিজ্ঞাপন

আমপুরার ওয়ার্ড কমিশনার মি. দিগ্বিজয় রায়ের বিশাল ড্রয়িংরুমে কুকুরেরা সারিবদ্ধভাবে বসা।
কুকুরদের সবার সামনে সাদা-কালো কুকুর। সাদা কালো কুকুরের পিছনে কালো কুকুর। লাল কুকুর কালো কুকুরের পিছনে। বাকীরা একত্রে বসে আছে নির্দেশের অপেক্ষায়। মি. দিগ্বিজয় রায় কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করেছে, কুকুরদের সঙ্গে কোনোওভাবে রাগ করবেন না। দেখতে, কুকুরের বাচ্চাদের দৌড় কতো দূর! হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা কুত্তা!
মি. দিগ্বিজয় রায়, আপনি আপনার জমি বা বাড়ির কাগজপত্র এনেছেন?
সাদা-কালো কুকুরের প্রশ্নে উত্তরে হাসে মি. দিগ্বিজয় রায় বিশাল চেয়ারে বসে। পাশে রাখা কাগজের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেয়, এই নাও আমার জমি ও বাড়ির দলিল রেকর্ড এবং কাগজপত্র।
সাদা কালো কুকুর কাগজপত্রের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে পেছনে অপেক্ষায় থাকা কালো কুকুরের কাছে দেয়। কালো কুকুর প্যাকেট খুলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখে। প্যাকেটের কাগজপত্র দেখার পর ব্যাগ খুলে নিজেদের সংগ্রহ করা কাগজপত্রের সঙ্গে মেলায়। দুইপক্ষের কাগজ দেখার পর কৌতুক করে হাসে কালো কুকুর, সব কাগজই ঠিক আছে।
কালো কুকুরকে ব্যাগের মধ্যে থেকে কাগজপত্র বের করতে দেখে, অবাক মি. দিগ্বিজয় রায়। মনে মনে ভাবে, শালার কুত্তা, তোরাও কাগজপত্র বুঝিস! দেখি, বুঝতে বুঝতে কতো দূর যাও!
মি. দিগ্বিজয় রায়― আপনি যে কাগজপত্র দিয়েছেন এই জমি ও বাড়ির সম্পূর্ণটাই ভুয়া।
মানে? খেঁকিয়ে ওঠে দিগ্বিজয় রায়। বাড়ির দলিল, দলিলের টিকেট, রেকর্ড সব সরকারি তোষাখানা থেকে এনেছি তোমাদের মতো নিম্নশ্রেণীর কুত্তাদের দেখানোর জন্য।
পেছনের লাল কুকুরেরা ঘোঁ ঘোঁ ঘোঁ শব্দে রাগ প্রকাশ করলে সাদা-কালো কুকুর ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ওরা চুপ।
আপনি যখন এই বাড়ি বা জমি দখল নেন, তখন এই বাড়ির মালিক কে ছিলেন?
তখন এই বাড়ির মালিক কে ছিলেন, দলিলে লেখা রয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়েছে মি. দিগ্বিজয় রায়। না― রাগ দেখানোর সময় আসেনি এখনও।
আপনার মুখে শুনতে চাই―
আমি জমি ক্রয় করেছি মি. গোপাল রঞ্জন হালদারের কাছ থেকে।
গোপাল রঞ্জন হালদার কি আপনার কাছে জমি বিক্রি করতে চেয়েছিল?
অবাক প্রশ্ন, বিক্রি না করলে কিনলাম কি করে?
আপনি জোর করে কিনেছেন মি. দিগ্বিজয় রায়।
কি আজগুবি প্রসঙ্গ আনছেন, এতোদিন পরে। আমি জমি কিনেছি প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেল। বাড়িও তো করেছি বিশ বছর হলো।
মি. দিগ্বিজয় রায়, আপনাকে আমরা একটা ভিডিও দেখাবো।
ভিডিও?
হ্যাঁ ভিডিও। সাদা-কালো কুকুর ইঙ্গিত করলে পেছনে নীল রঙের একদল কুকুর এগিয়ে গিয়ে দেওয়ালে একটা সাদা কাপড় টাঙ্গিয়ে দেয়। আর একদল নীল রঙের কুকুর পেছনের দেওয়ালের পাশে ছোট টেবিলের উপর প্রজেক্টর মেশিন বসায়। একটা কুকুর ড্রয়িং রুমের আলোগুলো নিভিয়ে দেয়। প্রজেক্টর চালু করে দেয় নীল কুকুরের দল। বিপরীতে সাদা পর্দায় দেখা যায় পঁচিশ বছর আগের সময়ে।
মি. দিগ্বিজয় রায় দাঁড়িয়ে আছে মি. গোপাল রঞ্জন হালদারের একতলা টিনের বাড়ির সামনের বারান্দায়। সঙ্গে আট নয়জন সঙ্গী। কারও হাতে চাপাতি, কারও হাতে বিরাট ছুরি, কারও হাতে কুড়াল, কয়েকজনার হাতে পিস্তল। এই লোকগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে গোপাল রঞ্জন হালদার, গোপালের স্ত্রী নমিতা রানী হালদার। দুজনের আঠারো বছরের মেয়ে সঞ্চিতা, পনেরো বছরের মেয়ে পারুলিমা, এগার বছরের ছেলে সৌভিক কুমার।
মি. দিগ্বিজয় রায়ের হাতে দলিলের কপি, খুব সংহত আর বিনয়ের সঙ্গে বলছে গোপাল রঞ্জন হালদারকে, দেখুন― আপনার এগারো কাঠা জমি আমার পছন্দ হয়েছে। একেবারে আম-কাঁঠালেঘেরা এমন একটা বাড়ি আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি। পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আপনার মেয়ে মিস সঞ্চিতার বিয়ের বিষয়ে আমার বন্ধু মি. আশুতোষের সঙ্গে এসে, আমি আপনার বাড়ি দেখে মুগ্ধ। আরে এই বাড়িটাইতো আমি খুঁজছিলাম। দুইদিন পরে এসে আমি আপনাকে প্রস্তাব করি বাড়িটা বিক্রির।
আপনি না করলেন। বললেন, বাপ-দাদার বাড়ি বিক্রি করবো না।
আমি বললাম, জায়গার দাম তো আট দশ লাখ টাকা। আমি আপনাকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দেব―
আপনি রেগে গেলেন মশাই, বললেন― আপনি আমার বাড়ি থেকে চলে যান। নইলে পুলিশ ডাকবো। আমি ভদ্রলোক মানুষ। আইন মানি। পুলিশের ভয় দেখালেন, আমি চলে গেলাম। কিন্তু আমি নিজেই পুলিশ হয়ে এসেছি। দলিল লিখে নিয়ে এসেছি, সই করে আট লাখ টাকা নিয়ে কেটে পড়ুন। নইলে, জবাই করবো।
আপনার স্ত্রী নেহায়েত ভালো মানুষ, আপনাকে সই করে প্রাণ নিয়ে যেতে বললে, আপনি সই করে দিলেন। ব্যাস আপনারা মুক্ত। চলে যান।
কোনোওভাবে টাকার বান্ডিলগুলো হাতে নিয়ে গোলাপ রঞ্চন হালদারেরা বাড়ির বাইরে চলে গেল কাঁদতে কাঁদতে। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েছিল একটি মাইক্রোবাস। ওরা মাইক্রোবাস পার হবার সময়ে একদল ষন্ডামার্কা লোক, যারা অপেক্ষায় ছিল গাড়ির কাছে, গোপাল হালদারের সংসারের লোকগুলোতে ধরে ধরে গাড়িতে তোলে এবং মুখের কাছে রুমাল ধরলে প্রত্যেকে জ্ঞান হারায়। গাড়ি চলতে শুরু করে।
চোখের সামনে সাদাপর্দার দৃশ্যগুলো দেখে মি. দিগ্বিজয় রায়ের চোখের মণি ছিটকে বাইরে আসতে চায়। সেই সময়ে এই ভিডিও ধারণ করেছিল কে? কুকুরগুলো তো তখন এই গলিতে ছিল না। তাহলে? এই শালার নেমকহারাম কুত্তারা এই সাদা কালো যুগের এই রঙিন ভিডিও কোথায় পেলো? এইতো দেখছি, ঘাড়ের উপর আসমানী বালা! কি করবো, কাকে ডাকবো! একমাত্র ভরসা― মি. আম্বিয়াচরণ!
মি. দিগ্বিজয়ের লোকেরা গাড়ি থামায় বিশাল একটা বিলের পাশে। বিলের ঘাটে বিরাট একটা নৌকা লাগানো। নৌকায় কয়েকটা পিপা। দুপুরের তপ্ত রোদ। কোথাও কোনোও জনমানুষ নেই। গাড়ির ষন্ডামার্কা লোকগুলো গাড়ি থেকে গোপাল রঞ্জন হালদার এবং পরিবারের সবাইকে টেনে টেনে নৌকায় তোলে। নৌকায় তোলার পর বড় বড় পিপার মধ্যে ধরে ধরে ঢুকিয়ে দেয়। পিপার মধ্যে পাথর আর চুন ভরা। যখনই যাকে পিপার মধ্যে ঢুকিয়েছে, অজ্ঞান অবস্থায় মারা গেছে। সবাইকে ঢুকিয়ে মুখের ডালা দিয়ে বন্ধ করেছে। পিপা বন্ধ করার পর নৌকা গভীর বিলের দিকে নিয়ে গেছে। নৌকাটা যেতে যেতে পর্দা থেকে হারিয়ে যায়।
মি. দিগ্বিজয় রায়ের ড্রয়িংরুমে আলো জ্বলে। মি. দিগ্বিজয় রায় বিস্মিত, বিপন্ন, অস্থির আর চলতশক্তিহীন। পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিটি বিন্দু-পল যদি পুনরায় চোখের সামনে হাজির হয়, কিভাবে স্থির থাকে? এতোগুলো মানুষ খুন, বাড়িদখল।
আপনার কিছু বলবার আছে মি. দিগ্বিজয় রায়? প্রশ্ন করে কালো কুকুর, কুকুরদের আইন শৃঙ্খলার প্রধান।
তোমরা কিভাবে এই ভিডিও বানালে?
হাসে কালো কুকুর, কুকুরদের বিজ্ঞান কতোদূর এগিয়েছে, বুঝতে পারছ?
কুকুরদের বিজ্ঞান?
হ্যাঁ, আমরা মানুষের পৃথিবী দখলের জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় নেমেছি অনেক অনেক আগথেকেই। যাই হোক, তুমি বুঝতে পারছ, এই বাড়ি তুমি অন্যায়ভাবে দখলে নিয়েছো। এখন ছেড়ে চলে যাও। আমরা দখল নেব।
কিন্তু কেনো?
এটাই পৃথিবীর নিয়ম। যে প্রাণীগোষ্ঠী বিজয় লাভ করবে, সেই প্রাণীরা টিকে থাকবে। যারা হেরে যাবে, তারা হারিয়ে যাবে। তোমরা মানবগোষ্ঠী, আমাদের কাছে হেরে যাচ্ছ।
মি. দিগ্বিজয় রায় সময় ক্ষেপণ করছে, আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকায়। আর মাত্র দশমিনিট পর হেলিকপ্টারে কমান্ডোরা আসছে। ধীরে ধীরে উঠে মি. দিগ্বিজয় রায় ঘরের মধ্যে যাবে। ঘরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবে ছাদে, হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসবে দড়ির সিঁড়ি। সেই দড়ির সিঁড়ি বেয়ে চলে যাবে হেলিকপ্টারে আর কুকুরের বাচ্চা কুত্তারা খাবে গুলি, গুলি আর গুলি।
মি. দিগ্বিজয় রায়, ডাকে সাদা-কালো কুকুর।
তাকায় দিগ্বিজয় রায়, বলো।
আপনার জন্য আমাদের একটা উপহার আছে।
কি উপহার?
সাদা-কালো কুকুর ইঙ্গিত করলে, ড্রয়িংরুমের পেছনে থাকা কয়েকটা লাল কুকুর প্লাস্টিকের একটা লম্বা ব্যাগ টেনে নিয়ে আসে মি. দিগ্বিজয় রায়ের সামনে। কি হতে পারে ব্যাগের মধ্যে, ভাবছে দিগ্বিজয় রায়। একটা লাল কুকুর মুখের দিকের চেইন টান দিয়ে খুলে দিলে, তাকায় দিগ্বিজয় রায়। ক্ষতবিক্ষত মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে মৃত নাহিয়ান। নাহিয়ান হেলিকপ্টারের পাইলট।
অপলক তাকিয়ে থাকে মি. দিগ্বিজয় রায় নাহিয়ানের মৃত মুখের উপর। কিভাবে কি ঘটলো বুঝতে পারছেন না। তাহলে হেলিকপ্টারে কমান্ডোরা আসছে না। মি. দিগ্বিজয় রায় বুঝতে পারছে, সব পথ বন্ধ। বাড়ির চারপাশে নিশ্চয়ই কুকুরেরা অপেক্ষা করছে।
মি. দিগ্বিজয় রায়, সাদা কালো কুকুর বলে, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আপনি এখন শুন্য। কেউ আপনার সাহায্যে আসবে না। এখন দয়া করে প্রাণ নিয়ে যেতে চাইলে, এখনই আপনাকে চলে যেতে হবে এই বাড়ি, আমপুরার এই গলি ছেড়ে। কি করবেন আপনি?
পঁচিশ বছর আগে গোপাল রঞ্জন হালদারের পরিবারের চলে যাবার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে! দিগ্বিজয় রায় বলেন, আমি বাসার ভেতরে যাব। জামা কাপড় গুছিয়ে একটা ব্যাগে নিয়ে যেতে চাই।
না।
না?
হ্যাঁ, আপনি ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন না। যেভাবে আছেন, সেইভাবেই যেতে হবে। আপনি যেতে দেরী করলেই বিপদে পড়বেন।
অসহায় চোখে নিজের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে দিগ্বিজয় রায়। দরজার কাছে এসে একবার ফিরে তাকায় পেছনে, এই শেষ! মি. দিগ্বিজয় রায়ের পেছনে কুকুরেরা নামছে। মি. দিগ্বিজয় রায়ও নামছে।

আট.
চারজন স্ত্রী― শাকিলা পারভীন, করুণা বিবি, জয়নাব লতা আর দিলবুরা ছন্দাসহ মি. আগা খান গলি দিয়ে হাঁটছে। যাচ্ছে প্রধান সড়কের দিকে। এইভাবে জীবনের কাছে হেরে যাবে, কুকুরদের কাছে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। এই কুকুরেরা কিভাবে এল? কেনো আগে টের পাইনি? কুকুরেরা কি ঠাডা শহর দখলে নেমেছে? গোটা দেশ? স্ত্রীরা হাঁটতে পারছে না। অনেক বছর বাড়ি থেকে বের হয়নি ওরা। হাঁটতে পারছে না স্ত্রীরা। খুব অসহায় লাগছে। পেছনে পেছনে আসছে শত শত কুকুর। কুকুরের দল।
মি. দিগ্বিজয় রায়ের বাড়ির সামনে আসতেই অবাক মি. আগা খান। বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছে মি. দিগ্বিজয় রায়ও। পেছনে শত শত কুকুর। দুজনে পরম্পর তাকায়। অসহায় পরস্পর তাকায়, মৃদু হাসে, সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে আমপুরার ছোট গলি পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়ে দুটি পরিবার। ওরা, মেইন রোডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ ঘেউ উল্লাসে মেতে ওঠে।
গলিটার মধ্যে আর কোনোও মনুষ্যবসতি নেই। গোটা গলিটাই কুকুরদের দখলে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন