বিজ্ঞাপন

প্রবীণ দিবসে প্রবীণের ভাবনা

October 1, 2023 | 3:48 pm

আনোয়ার হাকিম

“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে/ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল/পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন/তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল/সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন/ থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন”।

বিজ্ঞাপন

কবিতাটি আপাত রোমান্টিকতা আর বেদনা বিধুরতার অনুপম দৃষ্টান্ত হইলেও এর গুঢ় রহস্য আরো ব্যাপক। জীবনানন্দ দাশ দিনশেষে অন্ধকারে মুখোমুখি বসিয়া জীবনের সব লেনদেন শেষ করিতে চাহিয়াছিলেন। পারিয়াছিলেন কিনা তাহা লইয়া গবেষণা হইতে পারে। কিন্তু আমরা যান্ত্রিক ট্রামের নিচে তাহার দেহদান চাক্ষুষ করিয়াছি। কবিতাটির এই কয়েকটি চরণ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে স্মরণ করিয়া কিছুটা বিশ্লেষণে প্রয়াসী হইয়াছি।

প্রবীনদের লইয়া বিশ্বের উন্নত দেশ সমূহে নানাবিধ কল্যানমুখী ও সেবা ধর্মী সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। প্রবীনদের চাহিদা, তাহাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা লইয়া চিন্তার মেলা ক্ষেত্র উন্মোচিত হইয়াছে। আর অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশে প্রবীনদেরকে বোঝা হিসাবে গন্য করা হইয়া থাকে।

আমাদের মত উন্নয়ন কামী দেশ সমূহে প্রবীনদের লইয়া অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হইলেও এখনো অনেক কিছু করার বাকি রহিয়াছে। বৈশ্বিক গ্রামের সার্বিকতাকে মাথায় লইয়া জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে প্রবীনদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করিবার পাশাপাশি বার্ধক্য জনিত বিভিন্ন বিষয় লইয়া গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইহার অনুবৃত্তিক্রমে ১৯৯১ সাল হইতে প্রতি বছরের ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসাবে দেশে দেশে পালিত হইয়া আসিতেছে।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে ৬৫ উর্ধ্ব ব্যক্তিকে প্রবীণ হিসাবে গণ্য করা হইলেও আমাদের দেশে ৬০ উর্ধ্ব ব্যক্তিকে প্রবীণ বলিয়া ধরা হইয়া থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু সাড়ে ৭০ বছর হওয়ায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। সেই হিসাবে দেশে প্রবীণ জনসংখ্যা প্রায় সোয়া কোটি হইতে পারে।

আমাদের দেশের প্রবীণদের সমস্যাসমূহ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা ভিন্ন হইলেও মোটা দাগে সারা বিশ্বের প্রবীণদের সমস্যা একইরকম। ইহাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক, পারিবারিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যাই প্রকট। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থান একটি বড় সমস্যা। সঙ্গত কারণে প্রবীণরা ইহার অন্যতম ভুক্তভোগী। এখনকার বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তিই সবচাইতে বড় শক্তি বলিয়া স্বীকৃত বাস্তবতা। সামাজিক সমস্যা আবহমানকাল হইতে জারী থাকিলেও ইদানীং ইহার নানাবিধ সাইড ইফেক্ট দেখা যাইতেছে। আগে প্রবীণরা অবসর জীবন যাপনে সামাজিক বিশেষ মর্যাদা পাইত। এই প্রাপ্তি তাহাদেরকে মানসিক দৃঢ়তা যোগাইত। এখনো যে তাহাদের উপযোগিতা রহিয়াছে তাহা অনুভব করিত। এখন ইহাতে যথেষ্ট ভাটা পরিলক্ষিত হইতেছে। অন্যদিকে তাহাদের উপযোগী সামাজিক বিনোদনের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হইতেছে না। দিনে দিনে পরিবারের আকার ছোট হইয়া যাওয়ায় এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে পরিবারের সক্ষম জনবলের উদয়াস্ত বাহিওে কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকার কারণে পরিবার মধ্যে তাহাদের বিনোদনের সুযোগ হইতেছে না। তাই কেবলমাত্র ধর্মকর্মের মধ্যেই তাহাদেরকে আত্মীক বিনোদন খুঁজিয়া লইতে হয়। মানসিক সমস্যা প্রবীণের জন্য আরেক বড় সমস্যা। একসময় পরিবারের স্টিয়ারিং হাতে থাকিলেও প্রবীণতা তাহাকে অবসরের কঠিন বাস্তবতায় লইয়া যায়। তখন হঠাৎ করিয়া পরিবারের মধ্যে তাহার গুরুত্ব হ্রাস পাইলে মনস্তাত্ত্বিক যাতনা শুরু হয়। সমাজ তাহাকে উপেক্ষা করিতেছে, যথাযথ গুরুত্ব দিতেছে না বা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখিতেছে না এই বোধ তাহাকে মানসিকভাবে সারাক্ষণ যন্ত্রণা দেয়। আর এইসবের সবকিছুকে ছাপাইয়া স্বাস্থ্যগত দিক তাহাকে পর্যুদস্ত করিয়া ফেলে। আমাদের মত দেশে স্বাস্থ্য সেবা প্রতুল না। সহজলভ্যও না। আবার তাহা যথেষ্ট ব্যায়বহুলও বটে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার গন্ডি সম্প্রসারিত না হইলে প্রবীণের এই ভোগান্তির শেষ হইবে না।

মোটা দাগে আমাদের মত দেশে প্রবীণদের চাহিদা খুব সীমিত। যেমন: মানসিক, সামাজিক, মনস্তাত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, স্বাস্থ্যগত ও ধর্মকর্মের। প্রবীণের সমস্যা গুলি হইলো পরিবারে গুরুত্ব না থাকা, রাগ বৃদ্ধি পাওয়া, নালিশের প্রবণতা বৃদ্ধি, একাকীত্ব, সমাজ হইতে বিচ্ছিন্নতা, কথা বেশি বলার প্রবণতা, নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করা, ঘন ঘন অপমান বোধ জাগ্রত হওয়া, অবহেলার শিকার বলিয়া নিজেকে মনে করা ইত্যাদি। বিপরীতে প্রবীণের সম্ভাবনাও প্রচুর। অনেকেই হয়ত ইহাতে হাস্যরসের উপাদান খুঁজিয়া বেড়াইবেন। কিন্তু বিষয়টি এতটা হাল্কা নয়।

বিজ্ঞাপন

প্রবীণের অভিজ্ঞতা অনুজদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তাহাদের অভিজ্ঞতালব্ধ পরামর্শ বা যুক্তিসঙ্গত মতামত হইতে উপকৃত হইতে পারে। পরিবারের ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখভাল করার ক্ষেত্রে তাহারা আন্তরিক সেবা প্রদান করিতে পারে। যাহা মোটা টাকার বিনিময়েও কেয়ার গিভারের নিকট হইতে আশা করা যায় না। নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রকৃষ্ট শিক্ষকের দায়িত্বও তাহারা পালন করিতে পারে। ইহা ছাড়া সমাজের ও পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে পারিবারিক, সামাজিক কাইজ্যা-ফ্যাসাদ ও বিরোধ নিষ্পত্তিতেও তাহারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখিতে পারে।

প্রবীনদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। যদিও বয়ষ্ক ভাতাসহ সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর পরিধি বৃদ্ধি পাইতেছে। তবু তাহা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। সরকারি, বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বিকাশমান হইলেও এই ব্যবস্থা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায় নাই। এই ব্যবস্থার দুই দিকই ধারালো। বৃদ্ধাশ্রম ব্যবস্থা প্রবীণদের জন্য সুখকর কোন বিকল্প ব্যবস্থা হইতে পারে না। সমাজ ও পরিবারকেই প্রবীণদের দায়িত্ব লইতে হইবে। ইহার জন্য নানাবিধ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবাগত নতুন নতুন প্রণোদনা দেওয়া যাইতে পারে। বিদ্যমান সেবা সুবিধার সম্প্রসারণ করা আবশ্যক। রাষ্ট্রকে এই খাতে অতি আবশ্যিকভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করিতে হইবে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে প্রবীণদের এই চাহিদা ন্যুনতম। সর্বোপরি, প্রবীণদের প্রতি সামাজিক মনোযোগ আরো বৃদ্ধি করিতে জনসচেতনতা মূলক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি করিতে হইবে। বয়স ও পটেনশিয়ালিটি বিবেচনায় তাহাদের জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিং ও কর্মক্ষেত্র তালাশ করিতে হইবে। মোটকথা, প্রবীণ বান্ধব সামাজিক একটা আবহ তৈরি করিতে হইবে। প্রবীণের স্নেহ ছায়ায়, অভিজ্ঞতা পুষ্ট দিক নির্দেশনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী প্রাণের আনন্দে জাগ্রত হউক ইহাই আজকের এই দিনে সবার কাম্য। প্রবীণের প্রত্যাশাও তাই। নতুবা জীবনানন্দ দাশের মত দিন শেষে অন্ধকার আসিলেও মুখোমুখি থাকিবে একরাশ হতাশা আর যাতনা।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন