বিজ্ঞাপন

বিষন্নতার সাথে বসবাস

October 10, 2023 | 7:27 pm

আনোয়ার হাকিম

আজ আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এই প্রসংগে দেশীয় প্রেক্ষিতে কিছু আলোকপাত করা জরুরী হইয়া পড়িয়াছে।

বিজ্ঞাপন

বেশ কয়েক বছর আগে টিভির একটি বিজ্ঞাপন সকলের নজর কাড়িয়াছিল। উহা ছিলো একটি ওষুধের প্রচার-বিজ্ঞাপন। উহাতে বলা হইয়াছিল বিষন্নতা একটি রোগ। তখন হইতেই আমরা নড়িয়া চড়িয়া বসিয়াছি। বলাচলে বিষন্নতাকে লইয়া তখন হইতেই ভাবিতে শুরু করিয়াছি। তাই বলিয়া আমাদের মধ্যে যে ইহার আগেও বিষন্নতা বোধ ছিল না তাহা নহে। হয়ত সেইভাবে বিষয়টিকে দেখা হয় নাই। আজ এত বছর পর এত এত উন্নয়নের পরেও চারিদিকে দেখিতেছি বিষন্নতাকে লইয়াই আমাদের বসবাস। ইহা যেন বিনাশী এক প্যারাসাইটিস।

বিষন্নতা একটি মানসিক সমস্যা সন্দেহ নাই। ইহার লক্ষ্মণ সমূহের মধ্যে থাকিতে পারে প্রায় সময় মন খারাপ থাকা, আগে যে কাজে আনন্দ পাওয়া যাইত এখন উহাতে ভাটা পড়া, কাজে ও চিন্তায় ধীর গতি আসা, নিজেকে লইয়া নেতিবাচক চিন্তা করা বা ঘটমান সকল খারাপ অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করা ইত্যাদি। আরো আরো লক্ষ্মণ থাকিতে পারে। উহা চিকিৎসক আর মনোবিজ্ঞানীদের সাবজেক্ট।

বিষন্নতার কারণে ব্যাক্তি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি তাহার পারিবারিক, সামাজিক জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইহার ফলে ব্যাক্তির স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। চিকিৎসক আর মনোবিজ্ঞানীরা কি বলিবেন উহাতে না গিয়া আমরা যাহারা অতি সাধারণ তাহারা এই বিষন্নতাকে লইয়া একটু অনুসন্ধান কার্য করিতে পারি। বলাবাহুল্য হইবে যে, বিষন্নতার এই প্যারাসাইটিসকে আমরাই পালিয়া পুষিয়া এত বড় করিয়াছি। আমাদের একটা নিস্তরঙ্গ জীবন ছিল। উহাতে ঋতুভেদে রকমারি আবহাওয়া দোল দিয়া যাইত। আমরা আন্দোলিত, উদ্বেলিত হইতাম। ইহাতে আমাদের বেশি দিন ভালো লাগে নাই। আমরা জীবনে তরঙ্গ চাহিয়াছি। তাই উত্তুঙ্গ হইয়াছি। বিদেশি কালচার ভাড়া করিয়া উহাতে মজিয়াছি। আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের দর্শন ছিলো, মোটা কাপড় মোটা ভাত। তথা প্লেইন লিভিং প্লেইন থিংকিং। আমরা উহাতে নানা ভ্যারাইটি যুক্ত করিয়াছি। আমাদের উদ্দীপনা মন্ত্র ছিলো মানবিক গুণাগুণ ও মূল্যবোধ। আমরা উহার স্থলে আমদানি করিয়াছি চাকচিক্যময় প্রদর্শনীর দর্শন। সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের স্থলে প্রতিস্থাপন করিয়াছি ব্যাক্তিক সংকীর্ণ অভীপ্সা। দশে মিলিয়া করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ-এই মূল সংগীতকে একপাশে সরাইয়া রাখিয়া একলা চলো রীতি রপ্ত করিয়াছি। আমরা কেহই হারিবার মানসিক ভার সহ্য করিতে পারি না। হারিয়া যাওয়া মানেই পিছাইয়া যাওয়া, ক্রমে ক্রমে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাওয়া- এই নেতিবাচক বোধ আমাদের কাছে প্রিয় বলিয়া উদ্ভাসিত হইয়াছে। আমরা সবাই জিতিতে চাই। ইহার জন্য অন্যকে পাড়াইয়া, মাড়াইয়া, কলিজা ছিড়িয়া, হৃদয় বিদীর্ণ করিয়া ছল-বল-কৌশল প্রয়োগ করিয়া চৌ প্রহর ব্যাতিব্যস্ত থাকিতেছি। আগাইয়া যাইবার জন্য নিরন্তর দৌড়াইতেছি কিন্তু অভীষ্টের মাইল পোস্ট যেন ক্রমাগত সম্মুখবর্তী হইতেছে। আমরা আমাদের প্রত্যাশার গন্ডীকে আকারে, প্রকারে ও পরিমাণে এত বড় করিয়া ফেলিয়াছি যে, দিনশেষে ইহার সহিত প্রাপ্তির এন্ট্রি সমূহ বড় ম্রিয়মাণ বলিয়া মনে হইতেছে। ইহাতে আমাদের খেদ আরো বাড়িতেছে। খেদের চোটে আমরা আরো ক্ষিপ্র হইয়া ছুটিতেছি। ইহার ফলে আমাদের মাংসপেশিতে টান পড়িতেছে, হার্ট পাম্প করিয়া কুল পাইতেছে না। স্ট্যামিনায় ঘাটতি পড়িতেছে। তবু দৌড়াইবার কমতি নাই।

বিজ্ঞাপন

আগে শিক্ষিত হইবার দীক্ষা ছিলো। সুশিক্ষিত মানুষ সমাজ প্রগতিতে মূল্যবান ভূমিকা রাখিত। লেখাপড়া করে যে গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে এই প্রবাদ লোভনীয় ছিলো। ইহার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের পেরেশানী-প্রস্তুতিও ছিল ব্যাপক। সেই শিক্ষার সহিত মানবিক গুণাবলীর দীক্ষাও ছিলো। আগে শিক্ষার জন্য এক ঝাঁক কারিগর ছিলো। মূল্যায়ন তরিকা সহীহ ছিলো। মেধাবীরা তাহাদের প্রাপ্য বাস্তব জীবনে প্রবেশ করিবা মাত্রই পাইতে থাকিত। আজকাল শিক্ষা ক্ষেত্রে দারুণ বিপ্লব আসিয়াছে। আগেকার সেই জীর্ণশীর্ণ বিদ্যায়তন দেখা পাওয়া যাইতেছে না। সেইখানে সুদৃশ্য ও সুউচ্চ দালান উঠিয়াছে। আগেকার সেই ভাঙ্গা বেঞ্চ আর টেবিল নাই। ইহাতেও রমরমা অবস্থা যোগ হইয়াছে। শ্রেণী শিক্ষকের সংখ্যাও বাড়িয়াছে। তথ্য প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হইয়াছে। কিন্তু পরীক্ষা উঠিয়া গিয়াছে। ছাত্রদের সামনে কোন অভীষ্ট নাই। অভিভাবকও জানে না তাহার সন্তানের পাঠ কি, গন্তব্য কি? শিক্ষকও জানে না কী করিতে হইবে, কীসের জন্য? মোটকথা শিক্ষার কাঠামোগত হার্ডওয়ারের কাজ বেশ হইয়াছে কিন্তু সফটওয়্যারের কাজটিই সঠিকমত হইতেছে না। সবাইকে জিপিএ ফাইভ বা গোল্ডেন ফাইভের নেশায় পাইয়া বসিয়াছে। অনায়াসে তাহা মিলিতেছেও। উচ্চশিক্ষা আসক্তি আরো প্রবল হইয়াছে। কিন্তু সার্টিফিকেটের ওজন বাড়িতেছে না। বিশ্বের মানদন্ডে প্রথম আটশত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দেশের কোন স্থান নাই। অথচ আমরা এই খাতে যথেষ্টই ব্যয় করিতেছি। শিক্ষা শেষে কর্ম নাই। তাই তরুনরা ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশমুখী হইতেছে। ডলার বিচারে ইহাতে দোষের কিছু নাই। কিন্তু প্রকৃত মেধাবী জনগোষ্ঠীর আর ফিরিয়া আসিবার সম্ভাবনাও নাই। বেকারত্ব বাড়িতেছে কিন্তু কারিগরি শিক্ষায় ঝোঁক লক্ষ্য করা যাইতেছে না। সবাই জেনারেল লাইনে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করিতে ব্যস্ত। দেশীয় চাকরির বাজার সম্প্রসারিত হইতেছে না। তাই লক্ষ লক্ষ তরুন কিছু একটা জীবিকার জন্য মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। এখান হইতেই বিষন্নতা দানা বাধিতে শুরু করিতেছে।

আগে যাহা ভালো লাগিত এখন তাহা আর ভালো লাগে না। পৃথিবীর সবকিছুই যেন উপহাস করিতেছে বলিয়া মনে হইতেছে। অন্যরা যাহা পারিতেছে আমি কেন তাহা পাইতেছিনা জাতীয় প্রদাহ সারাক্ষণ হইতেছে। তখন ইহার জন্য ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ বলিয়া নিজের কপালকেই অপরাধী বলিয়া মনে হইতেছে। এই জীবন রাখিয়া কি লাভ জাতীয় মনস্তত্ত্বেরও সৃষ্টি হইতেছে। পারিবারিক জীবনেও ইহার আছর পড়িতেছে। পাশের বাড়ীর অমুক সর্ব বিচারে হীন হইলেও তাহার রমরমা দশা গৃহদাহের সৃষ্টি করিতেছে। যাহাদের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা তাহারা হয় অযোগ্যদের পিছু পিছু কাচুমাচু করিতেছে নয়ত ছা-পোষা জীবন যাপনে বাধ্য হইয়া পরিবার ও সমাজের নিকট বিশেষ পরিহাসের বস্তুতে পরিণত হইতেছে। যেখানে সবারই দৈনন্দিন বাজার করিতে হাপিত্যেশ অবস্থা সেইখানে অনেকেই ইউরোপ-আমেরিকা করিয়া বেড়াইতেছে। তাহাদের দাপট পরিবার, সমাজ ছাপাইয়া রাজনীতির চাতালকেও অধিগ্রহণ করিয়াছে। হাজার কোটি টাকা এখন আর ব্যাংকের মূলধন না ইহা অনেক ব্যাক্তির একক মূলধন হিসাবে দেশে-বিদেশে (সৌ)গন্ধ ছড়াইতেছে। এইরূপ বিসদৃশ চিত্র আজকাল সর্বত্র ভাইরাল হইতেছে। আগে সাদা মনের মানুষদের সর্বসমক্ষে তুলিয়া ধরা হইত। এখন হয় না। মিডিয়ার কাজ এখন রাজনীতিবিদ, আমলা আর মডেল-তারকাদের লইয়া। দেশে সিনেমার সংখ্যা আংগুলে গুনিতে হইবে না। অথচ তারকা আর মডেলদের নাচানাচি, কুঁদাকুঁদি মিডিয়া জুড়িয়া ভাইরাল হইয়া থাকে। ইহাদেরকেই এখন আদর্শ স্থানীয় বলিয়া একদল লোক মনে করিয়া রতিসুখের পাশাপাশি বিষন্নতাকে ভুলিয়া থাকিতে চায়। বিষন্নতা হইতে মুক্তি পাইতে লোকজন আজকাল ছুটি পাইলেই দেশের আনাচে-কানাচেতে থাকা পর্যটন স্পটে ছুটিয়া যায়। সেখানে খাইয়া না খাইয়া, শুইয়া না শুইয়া, পয়সার শ্রাদ্ধ করিয়া নির্মল শ্বাস লইতে যায়। কিছু দিন পরপর মিডিয়াতে উহার চিত্র দেখা যায়। আমাদের সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিষন্নতা ভর করিয়াছে। ইহা হইতে মুক্তির পথ কি? ইহা কাহারো জানা নাই। কেহ ইহা লইয়া চিন্তাও করিতেছে না। পাবলিক না পাইতেছে আয়ের পথ না পারিতেছে ব্যয় সংকুচিত করিতে। সরকারি সেবা পাইতেও বিরাট হ্যাপা। অথচ এই সমস্ত লইয়া আলোচনা নাই। সমালোচনা করিলে তো নির্বান্ধব হইয়া যাইতে হইবে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কেবলই বাড়িতেছে, পাল্লা দিয়া হেনস্তার অবস্থাও চাউর হইতেছে। দেখিয়া শুনিয়া মনে হইতেছে বিষন্নতাক্রান্ত পাবলিক কেবলই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতেছে। যেন দাঁড়াইলেই ক্ষতি। দম লইলেই বিষন্নতা-ভীতি পাইয়া বসিবে।

আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে বিষন্নতা বিদূরীকরণের লক্ষ্যে নানাবিধ সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করিবার জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান রহিলো। মনে রাখিতে হইবে বিষন্নতা একটি রোগ। ইহার মাত্রা লাগামহীন হইলে ফাটক আর গারদের সংখ্যা বাড়াইয়াও কাজ হইবে না।

বিজ্ঞাপন

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন