বিজ্ঞাপন

ফিলিস্তিনিদের কান্না- আজন্মের পাওনা

November 4, 2023 | 5:26 pm

আনোয়ার হাকিম

কোনো দুর্বৃত্তের সাথে যদি ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী বা ততোধিক দুর্বৃত্তের সরাসরি খাতির থাকে বা স্বার্থের সংলিষ্টতা থাকে বা অন্ধ প্রেম জাতীয় আশীর্বাদ থাকে আর সেই দুর্বৃত্তের সাথে যদি আপনার কোন কিছু নিয়ে ঝামেলা হয়েই যায় বা আপনি তার স্বার্থের দুরভিসন্ধির মধ্যে পড়েই যান তাহলে আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠবে বিপদসংকুল ও অনিশ্চিত। ফিলিস্তিনিদের অবস্থাও হয়েছে তদ্রুপ। পচাত্তর বছরের কান্নার যেন শেষ নেই। টানেলের শেষ প্রান্তে আপাতত কোন আলোক ছটাও দেখা যাচ্ছে না। পৃথিবীতে এরূপ লাগাতার জুলুমের কাহিনীচিত্র এর আগে দেখা যায় নি, শোনাও যায় না।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবী বয়সে বেড়েছে, বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়েছে, তথাকথিত মানবিকতায় উদার হয়েছে, ন্যায় বিচারের আবরণে বাছ-বিচার আর নির্বিচারের কাহিনীতে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ আর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট টানাপোড়েনে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এত কিছুর পরেও সন্ধি হয়েছে, কাইজ্যা-বিরতি হয়েছে, আড়াল-আবডাল খেলা হয়েছে, কুটনৈতিক রঙ্গ-তামাশাও হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায়, সমঝোতায় অথবা পরাশক্তির জাবরদস্তি মূলক পেষণে দেশ ভেঙ্গে একাধিক টুকরোও হয়েছে। কোনটার মাথা কেটে নেওয়া হয়েছে, কোনটার লেজ পৃথক করে অন্য কারো সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সবল দুর্বলের উপর চড়াও হয়েছে। দুর্বল রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, এমনকি শক্তির কাছে অসহায় সমপর্ণে বাধ্যও হয়েছে। আগে বিশ্ব দুই মহাজোটে বিভক্ত ছিল। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন তথা ন্যাম মাঝখানে থেকে কিছুটা দরকষাকষি করার সুবিধা নিত। বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ার মধ্য দিয়ে, রাশিয়া বিভক্তির সাথে সাথে পরাশক্তির ভারসাম্যের পাল্লা এক মুখী হয়ে গেছে। পুতিনের উত্থানে রাশিয়া ও তার মিত্র বলয় আশান্বিত ও চাঙ্গা হলেও রাশিয়া নিজেদের দুরাবস্থাকে ছাপিয়ে মিত্রদের কাছে মহীরুহ হওয়ার মত আস্থার জায়গায় এখনো যেতে পারে নি। ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পুতিন কী ফায়দা লাভ করতে চাচ্ছে বা পারবে তা দেখার জন্য আমাদেরকে আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।

ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ফিলিস্তিন সমস্যার রয়েছে বহু মুখ। কিন্তু এর পরিণতি একপাক্ষিক। ইসরায়েল নামক রাস্ট্র আর ইহুদিবাদ সমার্থক হয়ে এখন গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। আকারে ছোট্ট এই বিষ ফোঁড়াকে অপসারণ বা নিরাময় করার কোন প্রচেষ্টা নেই বরং এটাকে জিইয়ে রেখে কার কী লাভ হচ্ছে সেটাই এখন প্রশ্নœ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিরোধের সূত্রপাত মূলতঃ সেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে থেকে। ব্রিটিশরা সেখান থেকে চলে আসার সময় ইসরায়েল নামক রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তাকে জাতিসংঘের হাওলা করে দিয়ে আসে। এর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ দুটি আলাদা ভূ-খন্ডকে চিহ্নিত করে অন্যায়ভাবে মোট ভূমির ৫৫% ইসরায়েলকে এবং ৪৫% ফিলিস্তিনকে প্রদানের রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এই অংগীকারও আর আলোর মুখ দেখে নি। ফলতঃ দুটি যুদ্ধমান ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বেড়েছে হিংসা, অনৈক্য ও সংঘাত। উভয়পক্ষই একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য বদ্ধ পরিকর। এরপর থেকে মার্কিনীরা সেই অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মূলত: সেখান থেকেই ইসরাইল পশ্চিমাদের ছত্রছায়ায় আদুরে দুলালের স্ট্যাটাস পেয়ে দুর্বত্তপণা শুরু করে দেয়। মুসলমান ঠেকাও তথা কোপানোর হাতিয়ার হিসেবে তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ করে এনে শুধুমাত্র জন্মসূত্রে ইহুদী হলেই নাগরিকত্ব দিয়েছে। ক্রমে ক্রমে তারা শক্তিশালী হয়েছে। তাদের আজকের এই উত্থানের পেছনে রাশিয়ারও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। সম্প্রতি ভারত ইসরায়েলকে অকুন্ঠ সমর্থন দানের কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করে এই বার্তাই জানান দিয়েছে যে, তার অভ্যন্তরীণ মুসলিম নিধন এজেন্ডা বহির্বিশ্বে তথা মধ্যপ্রাচ্যে প্রণোদনা সৃষ্টি করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি-সামর্থে ইসরায়েলের আজকের এই সুদৃঢ় অবস্থানের পেছনে মোটা দাগে যে কারণ গুলো রয়েছে তা হলো: ১) অব্যাহত পশ্চিমা সাহায্য লাভ, ২) সামরিক ও প্রযুক্তির বিকাশ, ৩) জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং ৪) কঠিন নেতৃত্ব। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনকে ঘিরে থাকা আরব দেশ সমূহের মধ্যে উপর্যুক্ত কারণ গুলোর প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন লক্ষ্য করা গেছে। এর ফলে পরাশক্তির ইচ্ছার ভাঁজে ভাঁজে চলে তাদের টিকে থাকার ওয়ান টু ওয়ান কৌশল কেবল অপরিণামদর্শীই না চরম বোকামী বলেও প্রমাণিত হয়েছে। আরব রাস্ট্রসমূহের নিয়ে ওআইসি নামের একটি সংগঠন রয়েছে। একদা তাদের মধ্যকার বন্ধন যে কোন শক্তিবলয়ের কাছে দশ বার ভেবে দেখার বিষয় ছিলো। তরল জ¦ালানী ছিলো এর অন্যতম হাতিয়ার। কালে কালে তারা নিজেদের স্বার্থান্বেষী মনোভাব প্রদর্শন ও কার্যক্রম গ্রহণ করে সংগঠনটিকে করেছে পশ্চিমাদের আজ্ঞাবাহী আর মুসলিম উম্মাহকে করেছে বিচ্ছিন্ন। উম্মাহর উন্নয়নে তাদের কোন বড় ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় নি। এখনো সেরকম কিছু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ বিলাসি পশ্চিমা জীবন যাপনের সকল শাখায় তাদের বিনিয়োগ-আয়োজন পশ্চিমাদেরকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এরই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। তাদের কৌশলের ফাঁদে স্বেচ্ছায় পা বাড়িয়ে দেওয়া আরব রাজতন্ত্র ককটেল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলত পশ্চিমা শক্তি বলয়ের কাছে ফিলিস্তিন সমস্যা কোন সময়েই সেভাবে মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে জোরালো হিসেবে চিহ্নিত ও উপস্থাপিত হয় নি। বাস্তবায়ন উদ্যোগ তো পরের কথা।

ফিলিস্তিন সমস্যাকে সামনে রেখে ইয়াসির আরাফাতের উত্থান হয়েছে, মৃত্যুও হয়েছে রহস্যজনক ভাবে। মাহমুদ আব্বাস এখন গৌণ হিসেবে কদাচিৎ বিশ্ব দরবারে আওয়াজ তুলেন। অনেকে হয়ত বলতেই পারবেন না, উনি আদৌ বেঁচে আছেন নাকি দায়িত্বে আছেন। তার কথা কেউ দুই পয়সা দিয়ে ওজন দেয় বলে মনে হয় না। এভাবেই ফিলিস্তিন সমস্যা যে তিমিরে ছিলো সে তিমিরেই রয়ে গেছে। মাঝখান থেকে সশস্ত্র গ্রুপের উদ্দেশ্যহীন হামলার শিকার হয়ে অগণিত বেসামরিক নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ আহত-নিহত-বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। হামাস ও হিজবুল্লাহ গ্রুপের সাম্প্রতিক কর্মতৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এদের দীর্ঘস্থায়ী শক্তিমত্তা ও রাজনৈতিক-কুটনৈতিক সক্ষমতা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে হামাসের হামলায় ইসরায়েলিদের প্রাথমিক কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও এর পরের ধাক্কা কিন্তু সাংঘাতিকভাবে ব্যাক ফায়ার করেছে। অধিকৃত এলাকায় পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের মত মানবিক সুবিধাও এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা ইসরায়েলের পাশে তাদের অব্যাহত সাহায্য ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সেসব দেশের রাস্ট্রপ্রধানগণ ইসরায়েলে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এই সাহায্য ও সমর্থনকে পুন:ব্যক্ত করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে এ নিয়ে কিছুটা উত্তাপ ছড়ানো আলোচনা হলেও দিন শেষে সব রসুনের বটমই এক সূত্রে গাঁথা। আর জাতিসংঘ মার্কিন ও পশ্চিমাদের নিযুক্ত রেফারির ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সমস্যা সমাধানে কেউ নেই। সবাই জ্বলন্ত আগুনে রিফাইন্ড ঘি ঢেলে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গটিকে আরো উসকে দিচ্ছে। শক্তিমত্তায় হামাস বা হিজবুল্লাহর অবস্থান কিরূপ তারা নিজেও তা জানে কিনা ব্জানি না। তবে ঈমানী দৃঢ়তা নিয়েই এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা নিয়ে অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা, অনেক সমালোচনা থাকাই যথার্থ।

বিজ্ঞাপন

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ও অসলো চুক্তির কি হলো তা নিয়ে এখন আর আলোচনা হয় না। এর কুশীলবদেরকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হলেও এ অঞ্চলে শান্তি তো দূরের কথা জিঘাংসার মাত্রা এতটুকু কমেনি। বরং তা বেড়েছে বহুগুণ। বিশ্ব মিডিয়ায় দু একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া হামাসের সাম্প্রতিক হামলা জনিত ক্ষয়ক্ষতি ও এর পরবর্তী দুর্বিষহ অবস্থার সচিত্র প্রতিবেদন ঘন্টায় ঘন্টায় ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। বিপরীতে ইসরায়েল বাহিনীর হাসপাতাল ও বেসামরিক নাগরিকের উপর উপুর্যুপরি নৃশংস হামলা, ক্ষয়ক্ষতি ও পানি-বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্নকরণ সহ মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র সাদামাটা ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সন্নিহিত দেশ মিসর মানবিক এ বিপর্যয়ে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তদ্রুপ জর্ডান। ওআইসি পশ্চিমাদের দিকে তাকিয়ে। তারা একটা বৈঠক ডাকারও সাহস রাখে না। সৌদী আরব পড়েছে হাই ফাই, স্মার্ট যুবরাজের উন্নাসিকতার কবলে। অতি সম্প্রতি যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করতে তার ঘোষণা কতটা লোক দেখানো আর কতটা পশ্চিমাদের সাথে দরকষাকষির তা নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। ্এক কালের আরব লীগও মুখে কঠিন কুলুপ এটে বসে আছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। হামাস খোঁচা দিয়ে পরিস্থিতি উসকে দিয়ে এটুকুই জানান দিতে সমর্থ হয়েছে যে ফিলিস্তিন প্রশ্নটি এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। যুগে যুগে মার খেতে থাকা জাতির আত্মরক্ষার অধিকার কারো অনুমোদনের অপেক্ষা রাখে না। তবে এই হামলা দিয়ে গেছে ব্যাপক রক্ত ক্ষরণ।

এভাবেই হয়ত একসময় আগেকার মত সব কিছু স্তিমিত হয়ে যাবে। প্রসঙ্গটি হয়ত চাপাও পড়ে যাবে। হামাস-হিজবুল্লাহর বিচ্ছিন্ন টোকেন হামলা বা ইসরায়েলের নৃশংসতায় হয়ত কখনো কখনো ফিলিস্তিন প্রসংগ আবারো আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোণাম হবে। আবার মোড়লদের মাতব্বরি শুরু হয়ে যাবে। মিডিয়া ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠবে। চারিদিকে পক্ষে-বিপক্ষে নিন্দা আর সহানুভূতি প্রকাশের হিড়িক পড়ে যাবে। লম্বা জুব্বা পরিহিত আরব ধনকুবের রাজর্ষিদের সফেদ অবয়বে কৃত্রিম দরদ ফুটে উঠবে ও লোক দেখানো নড়াচড়া শুরু হয়ে যাবে। পরিশেষে পর্বতের মুষিক প্রসবের মত যা হওয়ার তাই হবে। মাঝখান থেকে পক্ষে-বিপক্ষে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে, সে অঞ্চলে আরো মাতব্বরি ও মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। ইসরায়েল আরো হৃষ্টপুষ্ট হবে। তার মিত্রের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে, পারস্পরিক বন্ধন আরো দৃঢ় হবে। ফিলিস্তিনি মানচিত্র আরো সরু হতে থাকবে। এক পর্যায়ে তা অধিকৃতদের দখলে চলে যাবে। হয়ত একেবারে সীমিত আকারে একটি করিডোর নিয়ে ফিলিস্তিনিরা টিকে থাকবে ইসরায়েলের করদ রাজ্য হয়ে। অবস্থা দৃষ্টে এমনটিই মনে হওয়া স্বাভাবিক। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তাই সময় থাকতেই সংশ্লিষ্ট পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে কথিত মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে, মানিবিক বিপর্যয় রোধ করতে, জাতিগত সহিংসতা বন্ধ করতে। ধর্মীয় দিক থেকে এই অঞ্চল বিশেষত এই ভূখন্ডটিকে নিয়ে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের রয়েছে গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও অধিকারবোধ। এদের প্রতিটি ধর্মীয় গ্রন্থেই এই ভূ-খন্ডকে ঘিরে রয়েছে ধর্মীয় আবেগ। তাদের সকলের কাছেই এই ভূ-খন্ড অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত। তাই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষিতেই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

মনে রাখতে হবে ব্রিটিশরা ইহুদীদেরকে এমনি এমনি বসিয়ে দিয়ে যায় নি। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দহন জ্বালা নিয়ে ভারতবর্ষে তারা যেভাবে কাঁচি চালিয়ে টুকরো টুকরো করে আজীবনের জন্য কোন্দলের বীজ বুনে গেছে তেমনি ইসরায়েল নামক রাস্ট্রের স্বাধীনতা প্রদানের মাধ্যমে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যেও অনুরূপ জিঘাংসার ডিনামাইট পুঁতে রেখে গেছে। যার বিস্ফোরণ জ্বালা এই দুই অঞ্চলের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সত্তরের দশকে ফিলিস্তিনের সমস্যা যে আকারে ও যে প্রকারে বিরাজমান ছিল এখন তা গুণে-মানে-পরিমানে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তখন ইসরায়েল রাস্ট্র একান্তভাবে মার্কিন মদদপুষ্ট ও পশ্চিমা রসদযুক্ত ছিল। এখন তার ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অপর দিকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরবরা তখন ছিল ঐক্যবদ্ধ ও সহানুভূতিশীল। কিন্তু এখন সেই ঐক্যের জায়গায় অনৈক্য বৃদ্ধি পেয়েছে ও নিজ নিজ স্বার্থ সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই, মুসলিম উম্মাহর অবস্থানকে সুসংহত করতে হবে সর্বাগ্রে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তি আর কারিগরীতে, কুটনীতি আর অর্থনীতিতে, সামরিক সক্ষমতায় আরো শক্তিশালী হতে হবে। ধনী আরব দেশ সমূহকে এসব খাতে বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। সারা বিশ্ব থেকে মেধাবী মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বাছাই করে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চ্চায় ও গবেষণায় নিয়োজিত করতে হবে। নিজেদের মধ্যে বৃহত্তর অর্থনৈতিক জোট গঠন করে বিভিন্ন প্রণোদনা- সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে মুসলিমদের মাঝে সাম্যতা আনতে হবে ও বিভেদ প্রশমন করে নবতর বলয় সৃষ্টি করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পবিত্র কোরআনের প্রথম প্রত্যাদেশের প্রথম শব্দটিই ছিলো ‘ইকরা’ অর্থ পড়। ভোগবিলাসী কৃত্রিম জীবনোপকরণে বিনিয়োগের পরিবর্তে মুসলিম উম্মাহর আত্মনির্ভরতার জন্য কাজ করতে হবে। আরব ঐক্যই হতে পারে মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণকর। আর মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হলে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান পথ বের হয়ে আসতে সময় নেবে না বেশি দিন। কিন্তু মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েল ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে অপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যবিহীন এ ধরণের হামলা করলে ইটের পরিবর্তে পাটকেলের ব্যাপক প্রাণঘাতী আক্রমন হজম করতে হবে। এতে করে শক্তিক্ষয় আর লোকক্ষয় ছাড়া বিশেষ কিছু হাসিল হবে বলে মনে হয় না।

সাম্প্রতিক উত্তেজনার বিষবাষ্প মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক অবস্থা কোথায় নিয়ে যাবে তা অনুমান করা বেশ কঠিন। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ফিলিস্তিনিদেরকে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন ইসরায়েলের আজকের এই সুদৃঢ় অবস্থানের পেছনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। পক্ষান্তরে না মধ্যপ্রাচ্যে না ফিলিস্তিনে এককভাবে গ্রহণযোগ্য কোন নেতৃত্ব এখন নেই। একসময় মিসরের আনোয়ার সাদাত, সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদ, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, জর্ডানের বাদশা জহীর, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি প্রমুখ নেতৃবৃন্দের দৃঢ়তা ও গ্রহণযোগ্যতা মধ্যপ্রাচ্যের গন্ডী পেরিয়ে সমগ্র বিশ্ব তথা পশ্চিমাদের কাছে সমীহ জাগানিয়া ছিলো। এখন নেই। নেতৃত্বের এই শূন্যতা ও মুসলিম উম্মাহর অনৈক্যের কারণে ফিলিস্তিনিরা উপুর্যুপরি আক্রান্ত হচ্ছে আর নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। তাদের প্রাত্যহিক সাধারণ জীবন বলে কিছু নেই। ভবিষ্যৎ বলে যতটুকু দৃশ্যমান হয় তার সবটুকুই ঘোর কুয়াশাচ্ছন্ন, তমসাচ্ছন্ন। তারা যেন ভুতুড়ে জনপদে কাটা তারে ঘেরা নিজ দেশে উদ্বাস্তু একদল মানব দাস। কান্নাই যাদের অজন্ম পাওনা।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন