১০ বছরে পঞ্চম ফাইনাল হারের হতাশা ভারতীয় দলে। ছবি: সংগৃহীত
November 20, 2023 | 9:18 pm
স্পোর্টস ডেস্ক
চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ২০১৩। এক দশক আগে আইসিসির টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল ভারত। ইংল্যান্ডকে ৫ রানে হারিয়ে শিরোপাও ঘরে তুলেছিল। এরপর পেরিয়ে গেছে ১০টি বছর। এই সময়ে টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে আর টেস্ট মিলিয়ে ভারত ৯ বার সেমিফাইনালে উঠেছে। এর মধ্যে পাঁচবারই সেমির দরজা পেরিয়েছে তারা। কিন্তু ফাইনালের দরজা আর পার হতে পারেননি ধোনি-রোহিত-কোহলিরা। পাঁচ পাঁচবার মাঠের লড়াইয়ে পরাজিত হতে চোখের সামনে শিরোপা নিয়ে যেতে দেখেছেন প্রতিপক্ষকে।
১০ বছরের মধ্যে পাঁচটি ফাইনালে পরাজয়। এর সঙ্গে আরও চারটি সেমিফাইনাল থেকে ফেরা শূন্য হাতে। বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশটিই কি তবে ক্রিকেটের নতুন চোকার্স! গত বছর দুয়েক হলো এমন প্রসঙ্গ আলোচনায় এলেও খুব একটা পাত্তা পায়নি। তবে এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে দুর্দান্ত দল নিয়েও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একই পরিণতি বরণ করায় সেই প্রশ্নই নতুন করে উঠে এসেছে আলোচনায়।
ভারতের এই ‘চোক করা’র শুরুটা ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের পরের বছর ২০১৪ সালেই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির দল। তারকাখচিত ব্যাটিং লাইনআপ নিয়েও সংগ্রহ ছিল মাত্র ১৩০। শ্রীলংকা সে সংগ্রহ অনায়াসে পেরিয়ে যাওয়ায় ট্রফি জিততে পারেনি ভারত। এরপর ২০১৮ আর ২০২০ সাল বাদ দিলে প্রতি বছরই ভারত কোনো না কোনো বৈশ্বিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বাদ পড়েছে সেমিফাইনাল কিংবা ফাইনাল থেকে!
বিরাট কোহলির এই ছবিই বলে দিচ্ছে ফাইনালের হারে কতটা হতাশ হয়েছে ভারতীয় দল। ছবি: আইসিসি
২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে উঠেছিল ভারত। প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩২৯ রানের টার্গেটে মাত্র ২৩৩ রানে গুটিয়ে গেলে আর ফাইনালে ওঠা হয়নি ভারতের। ২০১৬ সালেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিতে ভারত। ঘরের মাটিতে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথমে ব্যাট করে ১৯২ রান সংগ্রহ করেও লেন্ডল সিমন্স আর আন্দ্রে রাসেলের টর্নেডো ইনিংসের কাছে হার মানতে হয় ভারতকে।
২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অবশ্য সেমির বাধা পেরোয় ভারত, পৌঁছে যায় ফাইনালে। লন্ডনের দ্য ওভালে ওয়ানডে ফরম্যাটের টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষ ছিল চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। সেবার বড় পরাজয়ের লজ্জাই বরণ করতে হয় রোহিত-কোহলি-যুবরাজ-ধোনিদের। পাকিস্তানের ৩৩৮ রানের বিপরীতে তারা সংগ্রহ করতে পারে মাত্র ১৫৮।
আরও পড়ুন- ভারতীয়দের কাঁদিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়
এরপর ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপেও ভারত সেমিতে। প্রথমে বল করে প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ডকে মাত্র ২৩৯ রানে বেঁধে ফেলেন ভুবনেশ্বর-বুমরাহ-জাদেজারা। পরে ব্যাট করতে নেমে ২৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ভারত। পরে রিশভ প্যান্টের ৩২, হার্দিক পান্ডিয়ার ৩২, ধোনির ৫০ আর রবীন্দ্র জাদেজার ৭৭ রানেও শেষ রক্ষা হয়নি। ২২১ রানে অলআউট হয়ে গেলে ১৮ রানে হার শিকার করে মাঠ ছাড়তে হয় ভারতকে।
২০২২ সালে আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, আরেকবার সেমিতে ভারত। এডিলেডে পান্ডিয়ার ৩৩ বলে ৬৩ রানের ইনিংসে ১৬৮ রানের সংগ্রহ তাদের। জবাবে ব্যাট করতে নেমে জস বাটলার আর অ্যালেক্স হেলস যে ঝড় তুললেন, তা থামানোর সাধ্য হয়নি ভারতের কোনো বোলারের। ১৬ ওভারেই বিনা উইকেটে লক্ষ্য ছোঁয় ইংল্যান্ড।
গোটা টুর্নামেন্ট দুর্দান্ত খেলে টানা ১০ ম্যাচে জয় তুলে নিয়ে ফাইনালের পরাজয় মেনে নেওয়াটা ছিল ভীষণ কঠিন। ছবি: আইসিসি
এ বছরের আগে-পরে ২০২১ আর ২০২৩ সালে আরও দুই ফাইনালে উন্নীত ভারত। এই দুটি ফাইনাল ছিল ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে। তবে ফরম্যাট বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি ভারতের। প্রথমটিতে সাউদাম্পটনে নিউজিল্যান্ডের কাছে আর পরেরটিতে ওভালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফিও ছোঁয়া হয়নি ভারতের।
এর পাঁচ মাস পরই ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালেও ভারতকে বরণ করে নিতে হলো একই পরিণতি। সবশেষ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের মতো এবারও তারা বধ হলো প্যাট কামিন্সের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়ার কাছে। শুধু তাই নয়, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও ১৬৩ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস খেলে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ট্রাভিস হেড, ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালেও তার ১৩৭ রানের ইনিংসের কোনো জবাব খুঁজে পায়নি ভারত।
রোববারের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার ‘ক্লিনিক্যাল ক্রিকেটে’র সামনে লা-জওয়াব বনে যাওয়া ভারতকে ঘিরে ফের ‘চোকার’ তকমাটি ফিরে এসেছে আলোচনায়। ফেসবুক আর এক্সে (সাবেক টুইটার) ভারতীয় সমর্থকরাই নিজেদের দলকে ‘চোকার্স’ বলতে আর দ্বিধা করছেন না।
ফাইনালের পর আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়ার সময়ও অনেককে একই কথা বলতে শোনা গেছে। বিরাট কোহলির জার্সি গায়ে দেওয়া আবির সাইনি যেমন একটি গণমাধ্যমকে বলছিলেন, ‘ভারতই প্রকৃত চোকার্স, তারা নতুন চোকার্স। তারা খুবই ভালো খেলে। কিন্তু শেষ ধাপটি তারা অতিক্রম করতে পারে না।’
আহমেদাবাদে লক্ষাধিক দর্শককে ফাইনালে স্তব্ধ করে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ছবি: আইসিসি
ভারতীয় ক্রীড়া সাংবাদিক আর কৌশিক এএফপিকে বলেছেন, এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে এক দশক ধরে তাদের কোনো বৈশ্বিক শিরোপা নেই। এই সময়ে তাদের খেলা সেমিফাইনাল ম্যাচগুলো দেখলেই বোঝা যায় তাদের পরিকল্পনাতেই কিছু গলদ রয়েছে। বলা যেতেই পারে যে বড় মঞ্চের চাপ তারা নিতে পারছে না।
ভারতের ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব অবশ্য গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরপরই ভারতকে ‘চোকার্স’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ওদের চোকার্স বলতে পারি। তারা শিরোপার খুব কাছে গিয়ে চোক করছে। ফলে তাদের এটা (চোকার্স) বলা ঠিক আছে।’
ভারতীয়দের জন্য যতই বেদনার হোক না কেন, তাদের জন্য ‘নতুন চোকার্স’ উপাধি হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য কিছুটা হলেও মানসিকভাবে সান্ত্বনার কারণ হবে। ক্রিকেটে ‘চোকার্স’ হিসেবে তাদেরই যে এতদিন এককভাবে ‘চোকার্স’ তকমা বহন করতে হয়েছে!
আরও পড়ুন-
সারাবাংলা/টিআর