বিজ্ঞাপন

ভোটের বছরে রাজনীতির সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

January 1, 2024 | 12:17 am

তরিকুর রহমান সজীব, অ্যাডিশনাল নিউজ এডিটর

ঢাকা: রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনাদের বর্জন আর প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলে দেশে শুরু হলো নতুন খ্রিষ্টীয় বছর ২০২৪। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচন শেষে গঠন হবে নতুন এক সরকার। চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে ঠিকই থেকে যাচ্ছে। একইসঙ্গে সদ্য বিদায় নেওয়া বছরে অর্থনৈতিক নানা সংকট জেঁকে ধরেছিল দেশকে। নতুন বছরে সেই সংকট উত্তরণের চ্যালেঞ্জের মুখেও থাকবে দেশ।

বিজ্ঞাপন

সদ্য বিদায় নেওয়া ২০২৩ সালে দেশজুড়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত শব্দ ছিল ‘নির্বাচন’। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বছরের শুরু থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। বিএনপি ও সমমনারা বছরের শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিল সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা অনির্বাচিত কারও হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার বিষয়ে অনড় অবস্থান নেয়।

এর মধ্যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল হয়েছে। নির্বাচনও চলে এসেছে একদম দোড়গোড়ায়। বিএনপি ও সমমনারা এই নির্বাচন বর্জন করেছে। বামপন্থি ধারার রাজনৈতিক দলগুলোরও বড় একটি অংশ এই নির্বাচনে নেই। শেষের দিকে এসে অবশ্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটর দুয়েকটি দল এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বিএনপির বর্তমান ও সাবেক বেশ কয়েকজন নেতাও স্বতন্ত্র বা বিভিন্ন দলের প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন এই নির্বাচনে। পাশাপাশি আগের মতোই সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আগের মতোই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা আসন সমঝোতাও করেছে।

পাশাপাশি নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগও দলের মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বেশির ভাগ সংসদীয় আসনেই তাই নৌকা বা আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের বিপক্ষে শক্তিশালী প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন দলীয় স্বতন্ত্ররা।

বিজ্ঞাপন

এ পরিস্থিতিতে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগেরই আরেকবার জয় এবং টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পথ অনেকটাই সুগম বলে মনে করছেন ভোটারর। তবে টানা সরকার গঠনের সুবিধা থাকলেও নতুন সরকারের সামনেও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে বলে অভিমত রাজনীতিবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের।

চলমান রাজনৈতিক সংকটকে জনগণ নয়, কেবলই ক্ষমতার লড়াই থেকে উদ্ভূত সংকট হিসেবে মনে করছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা একটি রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের মধ্য বন্দি হয়ে পড়েছি। একদিকে গণতন্ত্রহীনতা, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট— দুইয়ে মিলে জনগণকেই রাজনীতির বলয় থেকে বের করে দিয়েছে। এখন ব্যবসায়ী, আমলা আর ক্ষমতার সুবিধাভোগীদের দখলে রাজনীতি। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেই যারা পলিটিক্যাল, তারাও ধীরে ধীরে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন।

গণতান্ত্রিক চর্চার ধারায় না ফিরতে পারলে এ পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সিপিবি সভাপতি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কিন্তু বারবারই তৃতীয় শক্তির ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে সেই তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে, সেরকম ইঙ্গিত কিন্তু রাজনীতিতে রয়েছে। ফলে আমাদের গণতন্ত্রে ফিরতে হবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলগুলো সবসময়ই ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে, তারা নিওলিবারেল ইকোনমির অনুসারী। সেখান থেকে জনগণের স্বার্থের রাজনীতিতে ফিরতে হবে।

বিজ্ঞাপন

নতুন বছরের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে শাহ আলম আরও বলেন, যে কেউ যদি এখন দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার লড়াইয়ে যুক্ত হতে চায়, তাদের জনসম্পৃক্ত হয়ে জনগণকে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। কেবল রাজনৈতিক দল নয়, প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে এই লড়াইয়ে যুক্ত হতে হবে। নতুন বছরে আমরাও নিওলিবারেল ইকোনমির বাইরে গিয়ে আরও বেশি জনসম্পৃক্ত হয়ে রাজনীতি করব।

বিদায়ী বছরে বারবারই ঘুরেফিরে এসেছে অর্থনৈতিক সংকটের কথা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকা, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, ব্যাংক খাতে অনিয়ম— এগুলোর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ ক্রমেই বাড়িয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৩-২৪: চলমান সংকট ও করণীয়’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, ব্যাংকে ঋণখেলাপি ও অবৈধ আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ আয় হচ্ছে সরকার পরিচালনায় ব্যয় করে ঋণের টাকায় বাস্তবায়ন হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার কারণে অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়েছে। রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না। ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে মানুষের কষ্ট বাড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। বাজার পরিস্থিতি আরও উসকে দিচ্ছে সিন্ডিকেট।

এই সংকটগুলোই নতুন বছরেও বাংলাদেশের পিছু ছাড়বে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। অর্থনৈতিক খাতে কার্যকর নেতৃত্বহীনতাকেই এর প্রধান কারণ মনে করেন তিনি। শুরু থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ না নিতে পারলে অর্থনৈতিক সংকট থেকে রাতারাতি উত্তরণের পথ নেই বলেও অভিমত তার।

বিজ্ঞাপন

ড. সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, মূল্যস্ফীতি থেকে শুরু করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণ বেড়ে যাওয়া, ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা, খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যর্থতা, সুদের হার, মুদ্রা বিনিময় হার— অর্থনীতির বিভিন্ন খাতেই আমরা ব্যাপক দুর্বলতা দেখেছি। এসব সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও শক্তিশালী ভূমিকা আমরা দেখিনি। এসব সংকটের কোনোটিরই সমাধান আসেনি এবং এগুলোর রাতারাতি কোনো সমাধানও দেখছি না।

সরকারের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কর খাতে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন ড. সেলিম। বলেন, কর খাতের সংস্কারে সরকারও দীর্ঘদিন ধরে অঙ্গীকারবদ্ধ। আওয়ামী লীগ সরকার প্রণীত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও এর কথা বলা আছে। আইএমএফ ঋণ দেওয়ার সময় যে শর্তগুলো দিয়েছিল, তার মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর শর্তও ছিল। কিন্তু সেটি সরকার করে দেখাতে পারেনি। সরকারের অঙ্গীকার থাকলেও আগ্রহ দেখিনি। ব্যাংক খাতের সংস্কারেও কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এর ফলেই এই সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হয়েছে। নতুন যে সরকারই আসুক, খুব দ্রুত এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে সংকট আরও গভীর হবে।

২০২৩ সালে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে চাপ বাড়িয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে বাজার খরচে। এ বিষয়ে ড. সেলিম বলেন, মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে যেভাবে দেশকে সংকটে ফেলেছিল, রাতারাতি এর উন্নতি হবে তেমন নিদর্শন দেখছি না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে মুদ্রানীতি, রাজস্ব আদায়, বাজার ব্যবস্থাপনাসহ সমন্বিত উদোগ প্রয়োজন হবে।

অর্থনৈতিক খাতে গত প্রায় দুই বছর সময়ে নেতৃত্বহীনতাকেই সংকটগুলো সমাধান না হওয়ার বড় কারণ মনে করেন ড. সেলিম রায়হান। বলেন, ‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো— গত দেড়-দুই বছরে অর্থনীতির এত গভীর সংকটেও অর্থনৈতিক খাতে কোনো নেতৃত্ব দেখা যায়নি যারা সঠিক নির্দেশনা দেবে। নতুন বছরে এসে অর্থনৈতিক সংকটগুলো থেকে উত্তরণের কথা ভাবলে অনেক কিছুই করতে হবে। শুরুতেই সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় বা এই খাতের নীতি নির্ধারক যারা আছেন, তাদের নিয়ে নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। আমার প্রত্যাশা থাকবে, শুরুতেই এই খাতে শক্তিশালী একটি নেতৃত্ব তৈরি হবে, যারা সমস্যাগুলোকে গভীর ও সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করে তার সমাধান নিয়ে কাজ করবে।’

তবে নতুন বছরের শুরু থেকেই ব্যাংকিং খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও কঠোর হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সময় তিনি গণমাধ্যমে বলেন, দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এখনই সাবধান না হলে নির্বাচনের পরপরই কঠোর হস্তক্ষেপ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেকোনো মূল্যে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন