বিজ্ঞাপন

ভালো বইয়ে ঝুঁকছে তরুণ পাঠক

February 12, 2024 | 11:30 pm

আসাদ জামান

কী মাঘ, কী ফাল্গুন, কী ভ্যালেন্টাইনস ডে, কী ছুটির দিন, কী কর্মদিবস— বইপ্রেমীদের কাছে বইমেলার প্রতিটি দিনই সুন্দর, প্রতিটি দিনই আকর্ষণীয়, প্রতিটি দিনই সীমাহীন আবেগ-অনভূতিতে মোড়নো! বন্ধু-বান্ধব, মা-বাবা, সহযোদ্ধা-সহকর্মী, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন-শুভাকাঙ্ক্ষী অথবা পছন্দের মানুষের সঙ্গে বইমেলায় ঢুঁ মারার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় না। শরীরিক সুস্থতা আর কিছু পাথেয় থাকলেই নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে সোজা বইমেলায় ছুটে যাওয়া যায়। জগতের সব কিছু থেকে আলাদা হয়ে কিছু সময় সুখানুভূতিতে ডুবে থাকার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষে রাঙানো পৃথিবীর দীর্ঘতম, বৃহত্তম ‘অমর একুশে বইমেলা’র মিষ্টি বিকেল বেছে নেওয়া যায় অনায়াসেই।

বিজ্ঞাপন

বইমেলার ১২তম দিন সোমবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বিকেল ৩টায় বইমেলার প্রবেশ পথগুলো খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারি বেঁধে নানা বয়সী নারী-পুরুষ ভেতরে প্রবেশ করেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে টিএসসিসংলগ্ন প্রবেশপথে রীতি মতো দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। মানুষের এই সারিতে তরুণীদের ভিড় ছিল বেশি। বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে পছন্দের রঙ ও নকশায় মানানসই শাড়ি পরা তরুণীরা তরু-পল্লবশোভিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আঁকাবাঁকা ও বৃত্তাকার পথ ধরে বইমেলার দিকে ধাবিত হলে চারিদিকে প্রাণের সঞ্চার হয়। তরুণদের মেপে মেপে পথ চলা এবং ডানে-বামে ‘দৃষ্টিবাণ’ নিক্ষেপ যে বার্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তা বোঝার জন্য মহাকবি কালিদাস হওয়ার প্রয়োজন নেই, হেলাল হাফিজ হলেই চলবে!

এবারের বইমেলার বহিরঙ্গ সাজাতে খুব একটা রুচির পরিচয় দিতে পারেনি বাংলা একাডেমি। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে না ডেকে নিজেরা বইমেলার অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে পরতে পরতে দারিদ্র্যের ছাপ রেখে দিয়েছে। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই রুচির দারুণ খরা। বাংলা একাডেমির নিজস্ব প্যাভিলিয়ন, তথ্যকেন্দ্র এবং বুথগুলোও আগের মতো হয়নি। ডিসপ্লে বোর্ড, তোরণ ও পথনির্দেশিকার সাজ-সজ্জায় ‘কী যেন নেই, কী যেন নেই’ অবস্থা!

আরও পড়ুন- ১২তম দিনে এসেছে ১১৫টি নতুন বই

বিজ্ঞাপন

অবশ্য এ নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও আক্রোশ নেই বইপ্রেমীদের। তারা প্রতিদিন নিয়ম করে বইমেলায় আসছেন। বই দেখছেন, বই খুঁজছেন, বই কিনছেন, পছন্দের বইয়ের তালিকা তৈরি করছেন। কেউ বা বই কেনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার শিল্পীদের দিয়ে নিজের ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছেন। টিএসসিসংলগ্ন প্রবেশপথ পেরিয়েই ফ্রিল্যান্সাররা তাদের রং-তুলির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। শ পাঁচেক টাকা খরচ করলে যে কেউ নিজের পোর্ট্রেট তৈরি করিয়ে নিতে পারবেন। সোমবার (১২ ফ্রেব্রুয়ারি) এই ফ্রিল্যান্সার জোনে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই নিজের অথবা ভালোবাসার মানুষের ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছিলেন সেখান থেকে।

বইমেলা জুড়ে এরকম অসংখ্য টুকরো টুকরো গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রয়োজন কেবল দেখার মতো চোখ, লেখার মতো হাত, আর জুতসই ভাষা। বর্ণাঢ্য বর্ণনা ভঙ্গীর অভাবে সেটা পেরে ওঠা মুশকিল। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’ ঠিক-ই পেরে উঠেছে। ‘সবার অংশগ্রহণে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে গেলে মেধার বিকাশ ঠেকায় কে’ স্লোগানের ‘বিকাশ’ শব্দটি দিয়ে তারা এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করেছে। ঠিক যেন ‘মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি’-এর মতো।

বিজ্ঞাপন

শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ— সব বয়সী পাঠকেরই দেখা মেলে বইমেলায়। ছবি: হাবিবুর রহমান/ সারাবাংলা

গল্পে গল্পে বেলা বয়ে যাওয়ার আগেই মূল প্রসঙ্গে ঢোকা প্রয়োজন। বইমেলায় স্টল-প্যাভিলিয়নে দায়িত্বরত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা সবসময় বই বিক্রি না হওয়া বা কম হওয়া নিয়ে আফসোস করলেও বড় ও মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশকরা এবার বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, বইয়ের বিক্রি গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার ভালো যাচ্ছে।

বিক্রয়কর্মীদের তথ্যমতে, ফিকশন, নন-ফিকশন, সৃজনশীল, মননশীল— সব ধরনের বই-ই পাঠক কিনছেন। শর্ত কেবল মানসম্মত হওয়া। বিগত কয়েক বছর তথাকথিত সেলিব্রেটিদের বই নিয়ে উঠতি বয়সীদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ থাকলেও এবার তাতে ভাটা পড়েছে।

বইমেলার দ্বাদশ বিকেলে বাতিঘর প্রকাশনীর স্টলে গিয়ে দেখা যায় তরুণ-তরুণীদের ভিড়। ইতিহাস-ঐতিহ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থ ও রাজনীতি বিষয়ক বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাতিঘর স্টলের এই ভিড় ‘হুমায়ূন আহমেদ-ইমদাদুল হক মিলন যুগের ভিড়’-এর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অর্থাৎ ফিকশনের (কল্পকাহিনী) ঝোঁক কমিয়ে নন-ফিকশনের (বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ত, ইতিহাস, ঐতিহ্য) প্রতি তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ যে ঝুঁকছে, এটা আশা-জাগানিয়া বৈকি!

বিজ্ঞাপন

বাতিঘরে নন-ফিকশনের সংগ্রহ বেশি। তার বিক্রিও কম নয়। ছবি: বাতিঘর

‘বাতিঘর’ থেকে সুনীতিভূষণ কানুনগোর ‘বাংলার ইতিহাস প্রাচীন যুগ’ এবং এইচ জি ওয়েলসের ‘পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ বই দুটি কিনলেন তরুণ গবেষক সা’দ ইসলাম। সারাবাংলার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপকালে তরুণ এই গবেষক বলেন, ‘বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পাঠাভ্যাস বদলায়। একসময় গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়তাম। এখন ইতিহাস-ঐতিহ্য পড়ছি। আমার গবেষণার বিষয়ও ইতিহাস-ঐতিহ্য। বাতিঘরে ভালো দুটি বই পেলাম। কিনে নিলাম। আরও কিছু বই কিনব।’

বাতিঘরের ম্যানেজার তারেক আব্দুর রব সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ফিকশন কম, নন-ফিকশন বেশি। বইয়ের ক্যাটাগরি বিচারে আমাদের বেচা-বিক্রি খুবই ভালো। বিশেষ করে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বিক্রি ভালো। প্রত্যাশাতি মাত্রায় বই বিক্রি হচ্ছে।’

নতুন ৫০টি বইসহ প্রায় ৩৫০টি বইয়ের প্রকাশক বাতিঘরের ম্যানেজার তারেক আব্দুর রবের মতে, কলকাতা, দিল্লী, নিউইয়র্ক, ফ্রাংকফুর্ট এবং দুবাই আন্তর্জাতিক বইমেলার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় অমর একুশে বইমেলা। ব্যাপ্তি, স্থায়িত্ব, পরিসর, ঐতিহ্য— সব দিক থেকেই বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা বিশ্বমানের। সমস্যা কেবল ধুলা আর মানহীন বই। এই দুটি দিক নজর দিলে আমাদের বইমেলাও হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মানের।

প্রথমার ম্যানেজার জাকির হোসেন এবং ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর ম্যানেজার এ কে এম কামরুজ্জামানের অভিমতও একই রকম।

সারাবাংলাকে জাকির হোসেন বলেন, ‘বই বিক্রি সন্তোষজনক। মানসম্পন্ন বই হলে পাঠকের সাড়া মেলে। আমরা বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি।’

সারাবাংলা/এজেড/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন