বিজ্ঞাপন

চাপ-অভিযান নয়, জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করতে সমঝোতায় জোর

March 17, 2024 | 10:20 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ কিংবা সামরিক অভিযান নয়, সমঝোতার মাধ্যমে জিম্মি দশা থেকে বাংলাদেশি জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করে আনার ওপর জোর দিচ্ছে মালিকপক্ষ ও সরকার। এ জন্য জিম্মি জাহাজে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে অভিযানের প্রস্তাব এলেও তাতে সাড়া দেয়নি মালিকপক্ষ।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, সর্বশেষ অবস্থানে নেওয়ার পর জিম্মি জাহাজটিতে সশস্ত্র প্রহরা বাড়িয়েছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তবে এখন পর্যন্ত নাবিকদের ওপর তেমন কোনো চাপ তৈরি করছে না। বরং স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে জিম্মি নাবিকদের তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও দিয়েছে। জলদস্যুদের পক্ষ থেকে মুক্তিপণ চেয়ে এখনো কোনো যোগাযোগও করা হয়নি। এর মধ্যেই মালিকপক্ষ ও সরকার তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে এখন সোমালিয়ার নুগাল প্রদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা শহর গদবজিরান থেকে আনুমানিক চার নটিক্যাল মাইল দূরে উপকূলে রাখা হয়েছে। গত শুক্রবার (১৫ মার্চ) দুপুর নাগাদ জাহাজটিকে সেখানে নিয়ে নোঙর করে জলদস্যুরা। ওই দিনই স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে নাবিকদের তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দেয় জলদস্যুরা।

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের ভাই আসিফউল্লাহ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুক্রবার বিকেলে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে কল করেছিল। আমরা কথা বলেছি। আমার ভাই জানিয়েছেন, পাইরেটসদের সঙ্গে এখনো তাদের কোনো কনফ্লিক্ট হয়নি। দিনে তাদের কেবিনে থাকার সুযোগ দিচ্ছে। রাতে ঘুমানোর সময় সবাইকে জাহাজের ব্রিজে (ডেকের ওপর কাঁচের ঘেরা অংশ) নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝে মাঝে জলদস্যুদের মুড খুব ভালো থাকে, মাঝে মাঝে খারাপ থাকে। তবে তেমন কোনো খারাপ আচরণ করছে না বলেই জানিয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন-

আতিকুল্লাহর বরাত দিয়ে তার ভাই আরও বলেন, ‘জাহাজে উনারা নাবিক আছেন ২৩ জন। অন্যদিকে জলদস্যুদের ৪০ থেকে ৪৫ জন সার্বক্ষণিক থাকছেন। জাহাজে খাবার ও পানির যে মজুত আছে, সেখান থেকে জলদস্যুরাও ব্যবহার করছেন। পানি দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে বললেন। এটা নিয়ে উনাদের একটু দুশ্চিন্তা আছে। জাহাজে কার্গো আছে কয়লা। এগুলো বেশিদিন ফেলে রাখা যায় না। এটা নিয়েও উনারা টেনশন করছেন। আমাদের ফ্যামিলির খোঁজখবর নিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব তাদের যেন ফিরিয়ে আনা হয়, সেটা বলেছেন।’

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, এরপর শনিবার (১৬ মার্চ) রাত ৮টার দিকে জাহাজের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, গদবজিরানের কাছাকাছি নোঙরের পর জলদস্যুরা জাহাজে সশস্ত্র প্রহরা আরও বাড়িয়েছে। এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই নাবিকদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। জলদস্যুরা তাদের মাঝে মাঝে কেবিনে থাকার অনুমতি দেয়, আবার ব্রিজে নিয়ে যায়।

ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সামুদ্রিক নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওই অঞ্চলে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য রুখতে ও চলাচলকারী জাহাজগুলোর নিরাপত্তায় ইইউ পরিচালিত ‘অপারেশন আটলান্টা’র আওতায় একটি জাহাজ জিম্মি জাহাজটিকে অনুসরণ শুরু করেছিল। এরপর ইইউ জাহাজের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশি নাবিকদের মুক্ত করার প্রস্তাব এসেছিল।

অন্যদিকে জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজকে সহায়তায় রণতরী এবং একটি দূরবর্তী টহল জাহাজ মোতায়েনের কথা গত শুক্রবার জানায় ভারতের নৌবাহিনী। এরপর শনিবার (১৬ মার্চ) ভারতীয় নৌবাহিনী জানায়, ওই অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালিয়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কাছ থেকে এমভি রুয়েন নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ তারা উদ্ধার করেছে। ১৭ নাবিককে উদ্ধারের পাশাপাশি জাহাজে থাকা ৩৫ জলদস্যুর সবাইকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে তারা।

কিন্তু ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম খবর ছড়িয়ে দেয়, ভারতীয় নৌবাহিনী সামরিক অভিযান চালিয়ে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকদের উদ্ধার করেছে। কিন্তু বাংলাদেশি জাহাজটির মালিকপক্ষ চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম এ খবরকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে জিম্মি নাবিকদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।

বিজ্ঞাপন

তবে একটি সূত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছে, মাল্টার জাহাজে অভিযানের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ বাংলাদেশি জাহাজটিকেও সোমালিয়ার জলদস্যুদের কাছ থেকে মুক্ত করার একটি প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু ইইউ ও ভারতের প্রস্তাবে সম্মত হয়নি জাহাজের মালিকপক্ষ।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইইউ সামুদ্রিক নিরাপত্তা বাহিনী একটি প্রস্তাব দিয়েছিল প্রথমেই। মালিকপক্ষ সেটাতে রাজি হয়নি। আমরাও বারবার বলছি যে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ কিংবা সামরিক অভিযানের কারণে নাবিকদের ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া এখন বাংলাদেশি জাহাজটিকে জলদস্যুরা যে অবস্থানে রেখেছে, সেখানে ইইউ কিংবা ভারতীয় রণতরীর সেটাকে অনুসরণের সুযোগ তেমন নেই।’

জানতে চাইলে কেএসআরএমের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমঝোতার মাধ্যমে নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনাটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা প্রথম থেকেই এটা বলে আসছি। নাবিকদের সঙ্গে আমাদের সর্বশেষ যোগাযোগের সময় আমরা তাদের এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছি। তাদের পরিবারকেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। আমরা বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু জলদস্যুরা এখনো কোনো ধরনের সাড়া দেয়নি।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও সর্বশেষ জানিয়েছেন, বিমা প্রদানকারী ও জাহাজ মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা ‘পিঅ্যান্ডআই ক্লাবে’র মাধ্যমে ‘সমঝোতা’র মধ্য দিয়ে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে।

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুরা গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টার দিকে ২৩ নাবিকসহ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজটিকে দখলে নেয়। জাহাজটি আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যাচ্ছিল। জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন।

জাহাজে থাকা নাবিকেরা হলেন— জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।

বিএমএমওএ জানিয়েছে, জিম্মি নাবিকদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের ও দুজন নোয়াখালীর। বাকি ১০ জনের বাড়ি ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, খুলনা, নেত্রকোনা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও বরিশাল।

কেএসআরএম গ্রুপের মোট ২৩টি জাহাজ আছে, যেগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করছে। ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ‘এমভি আবদুল্লাহ’ গত বছর কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানায় আসে।

এর আগে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের উপকূলে আরব সাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন