বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি অনুদান তলানিতে, প্রত্যাবাসনের আভাসও নেই

May 13, 2024 | 10:25 pm

ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

কক্সবাজার: মিয়ানমারের জান্তা সরকারের তীব্র আক্রমণের মুখে ২০১৭ সালে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল পাঁচ লখেরও বেশি রোহিঙ্গা। পরেও সে ঢল ছিল অব্যাহত। কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থান হয় তাদের। এরপর গত সাত বছরে বাড়তে বাড়তে দেশের ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১১ লাখ।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের পথে মিয়ানমার থেকে সবকিছু হারানো রোহিঙ্গাদের ঢলকে সারা বিশ্বই দেখেছিল মানবিক বিপর্যয় হিসেবে। রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের জান্তা সরকারের হামলাকে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ তথা জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল খোদ জাতিসংঘ। বাংলাদেশও মানবিক বিবেচনাতেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। বিভিন্ন দেশের সরকারসহ দাতা গোষ্ঠী এই মানবিক বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম বছরে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা এসেছিল ১২৬ মিলিয়ন পাউন্ড। এরপর রোহিঙ্গাদের সংখ্যা যত বেড়েছে, বিপরীতে ততই কমেছে সহায়তা-অনুদান। গত বছর যা কমতে কমতে নেমে এসেছে ১১ মিলিয়ন পাউন্ডে।

এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের বাড়তি চাপ পড়ছে সরকারের ওপর। পাশাপাশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও রয়েছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকেই এক ও অদ্বিতীয় সমাধান হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সবাই, যেটি বলে আসা হচ্ছে শুরু থেকেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো— গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। চলমান প্রক্রিয়া থেকেও সবার আশঙ্কা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো আভাসও কেউ নিকট ভবিষ্যতে দেখছেন না।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা হচ্ছে শুরু থেকেই। মিয়ানমার সরকারও মুখে মুখে স্বীকার করে, প্রত্যাবাসনেই রয়েছে রোহিঙ্গা সংকটের প্রকৃত সমাধান। দুই দেশ প্রত্যাবাসনের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, কমিটি করেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাখাইন ঘুরিয়েও আনা হয়েছে। সাত বছর ধরে দফায় দফায় বৈঠক আর নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও শেষ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও এখন পর্যন্ত ফিরতে পারেননি রাখাইনে, নিজ ভূমিতে।

বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পাহারা থাকলেও রোহিঙ্গারা প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইরে চলে যায়। সারাবাংলা ফাইল ছবি

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি ক্যাম্পে রয়েছেন রোহিঙ্গারা, মিয়ানমার যাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়নি কখনো। এসব রোহিঙ্গা নাগরিকও রাখাইনে নিজ ভূমিতে ফিরতে আগ্রহী। তবে তার জন্য তারা মিয়ানমারের নাগরিকত্বের মর্যাদার পাশাপাশি সেখানে নিরাপত্তাও চান। বর্তমানে মিয়ানমারে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর চলমান বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন নিয়ে আগ্রহও নেই তাদের।

রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, রাখাইনে আমাদের সব ছিল। সেই গ্রাম, সেই ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, ক্ষেতখামার— সবকিছুর কথা সবসময় মনে পড়ে আমাদের। আমরা সেখানে আবার ফিরতে চাই। কিন্তু আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের সহায়-সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। তা না হলে আমরা ফিরে যাব না। কারণ এগুলো না থাকলে আবার আমাদের আগের মতোই ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার হতে হবে।

আশ্রয় পেয়ে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ রোহিঙ্গা নারী রহিমা বেগম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাদের সন্তানদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। এরপরও নিজের দেশের মায়া আলাদা। আমরা মিয়ানমারে আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে চাই। তবে আমাদের অধিকারটা বুঝিয়ে দিতে হবে। তাহলেই আমরা ফিরে যাব।

বিজ্ঞাপন

জাফর আলম নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের দেশে (মিয়ানমার) আরকান আর্মি আর জান্তা সরকারের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। তাদের একটি দল আমাদের নিতে চায়। মূলত আমাদের সামনে রেখে যুদ্ধ করতে চায়। কিন্তু আর ভুল নয়। জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের সব অধিকার ফিরিয়ে দিলেই কেবল নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাবে। এর আগে নয়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিনিধি দল। ছবি: সারাবাংলা

রোহিঙ্গারা যেসব শর্ত উল্লেখ করে মিয়ানমারের রাখাইনে ফেরার কথা বলছেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন উদ্যোগের পর সেসব শর্ত পূরণ আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবই মনে হচ্ছে। প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ উদ্যোগ হিসেবে গত বছর রোহিঙ্গা নাগরিকদের একটি দলকে পাঠানো হয় রাখাইনে। পরে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল এসে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে। একাধিক দফায় এই প্রক্রিয়া চালানো হলেও ফল আসেনি তাতে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের এমন পরিস্থিতিতে চাপ পড়ছে সরকারের ওপর। ফলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে করণীয় কী— সেটি দেখার জন্য গতকাল রোববার (১২ মে) রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। কমিটির সভাপতি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন এই প্রতিনিধি দলে। রোহিঙ্গাদের জীবনযাপন পর্যবেক্ষণসহ প্রত্যাবাসন নিয়েও তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে এই কমিটি।

প্রতিনিধি দলের সদস্য কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমল সারাবাংলাকে বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে উত্তেজনা চলছে। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে তারা ফিরে যাবেন। বিষয়টি সংসদীয় সভায় উত্থাপন করা হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জীবনমান দিন দিন উন্নত হচ্ছে। তারা এ দেশে ভালো আছে। তাদের শিক্ষার মান বাড়ছে। রোহিঙ্গা নেতারাই জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে তাদের মধ্যে শিক্ষিত (স্নাতক ডিগ্রিধারী) ছিল ৫২ জন। এখন সেই সংখ্যা ১৩০ জন। তারপরও তারা তাদের দেশে ফিরতে চায়। তবে নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে যেতে চায়।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ছবি: সারাবাংলা

সরকারের ওপর চাপের কথা তুলে ধরে ড. মোমেন বলেন, ‘বিদেশি অনুদান দিন দিন মাত্রাতিরিক্ত কমছে। ২০১৭ সালে বিদেশি অনুদান এসেছিল ১২৬ মিলিয়ন পাউন্ড। আর গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১ মিলিয়ন পাউন্ডে। ফলে এখন এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার ভরণপোষণের দায় সরকারকে বহন করতে হচ্ছে। তা করতে গিয়ে সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা আগেও প্রত্যাবাসনের পক্ষেই সবসময় কথা বলেছি। এই মুহূর্তেও লক্ষ্য একটাই— প্রত্যাবাসন।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ নিজেও প্রত্যাবাসনকেই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান মনে করছেন। তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় নানা সমস্যার কথাও স্বীকার করে নিচ্ছেন। বলছেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের নানা নেতিবাচক প্রভাবের কথা।

মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এর প্রভাব দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও পড়ছে। কিন্তু প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার একাধিকবার বৈঠক করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। উলটো মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। বিজিপি (মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী) সদস্যরা বারবার এসে আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে, যদিও তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কর্মরত মানবাধিকার কর্মী ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারাও প্রত্যাবাসনকেই সমাধান মানছেন। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় সেই প্রত্যাবাসন শিগগিরই সম্ভব না বলেও স্বীকার করছেন তারা। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে কীভাবে আলাদা রাখা যাবে, সেটি নিশ্চিত করতে বলছেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলকে নিয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর বারবার চাপ প্রয়োগের তাগিদও তারা দিচ্ছেন।

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন