বিজ্ঞাপন

লাজ – লজ্জা – ভয়, এই তিন থাকতে নয়

May 16, 2024 | 2:43 pm

আনোয়ার হাকিম

আমাদের মনস্তত্বে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা খেলা করে। কোনটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যায়। কোনটি ব্যাখ্যাতীত। মূলত: মানব মনস্তত্ব বিচিত্র রসায়নে ভরপুর। একটু প্রাপ্তিতেই সুখ উথলিয়ে ওঠে। একটু বঞ্চনায় দু:খের লহর বয়। আর ছলনা- প্রতারণায় ঘৃণায় গুলিয়ে উঠে দেহ-মন। শুধু কি এতটুকুতেই সীমিত থাকে মনের রসায়ন? মোটেই না। অজানা আশংকায়, দৃশ্যমান অঘটনে বা হারাবার ভয়ে মন থেকে থেকে শিউরে ওঠে। এর বাইরেও অপমানের প্যারা অসহনীয় হয়ে ওঠে। এক ভালোবাসাবাসি থেকেই কত কিছিমের রসায়নের ক্রিয়া-বিক্রিয়া যে শুরু হয় তা সংক্ষেপে বলে বুঝানো যাবে না।

বিজ্ঞাপন

পছন্দের মেয়েকে প্রেম নিবেদনে প্রথমেই থাকে রাজ্যের দ্বিধা, হাজারো সমীকরণ। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া মিললে মনের সুপ্ত প্যারাসুট সবেগে ইজেক্ট হয়ে আকাশে উড়তে থাকে মধুর উত্তেজনায়। আবার প্রত্যাখানের ভয়ে নিবেদনে কুন্ঠাও জাগে। এ এক বিষময় যাতনা। কৌষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা মানুষের নিত্যকার কষ্টের মত। আর পরিণাম যদি প্রত্যাখানে নিশ্চিত হয় তাহলে প্রেমিকার প্রতি ঘৃণা পাহাড়সম হয়। প্রতিশোধ স্পৃহা চাগাড় দিয়ে উঠতে চায়। লজ্জা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। জিঘাংসার বিষবাষ্প কেবলই উত্তেজনা ছড়ায়। মন তার ত্রিসীমানা মাড়াতে না চাইলেও লুকিয়ে লুকিয়ে বার বার দেখার লোভ বা বাসনাকে দমিয়ে রাখতে পারে না। আরো আরো জটিল রসায়ন থাকে মনের মধ্যে ইনবিল্ট। পেয়েও হারানো প্রেমিকার প্রতি মনে জাগে প্রচুর জিঘাংসা। আরাধ্য প্রেমিকার নব্য প্রেমিক প্রবর বা বরকে দুমড়েমুচড়ে হামাম দিস্তায় পিষে ভর্তা বানিয়ে প্রেমিকার সামনে উপস্থাপনের খায়েসও জাগে।

অতি লাজুক যে প্রেমিক, তার রসায়ন আরো জটিল ও আত্মবিনাশী। বিরহ বড় ভালো লাগে তার। সেই দহন জ্বালায় জ্বলেপুড়ে নিজের মনে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করার মধ্যেই সে সুখ খুঁজে পায়। শরৎ বাবু দেবদাসকে মডেল বানিয়ে ‘প্রেমের নাম বেদনা’র জাতীয় সংগীত লিখে গেছেন। ব্যর্থ প্রেমের দুর্বল চিত্তের প্রেমিক হঠাৎ করেই পরিশীলিত মনের অধিকারী হয়ে যায়, তার কাছে ‘ত্যাগেই সুখ’ বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র হিসেবে সাব্যস্ত হয়। হঠাৎ করেই তার মনস্তত্বে বাঁক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অসির চেয়ে মসিই তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। তার হাতেই কবিতা ফেনিয়ে উঠে, মনের ভেতর থেকে গল্প- উপন্যাসের প্লট উৎপাত শুরু করে দেয়।

যার দু’কলম শুদ্ধ বাংলা লেখার মুরোদ নেই সেও রাতারাতি যাদুবলে হয়ে উঠে চারণ কবি, ‘যাও পাখী বলো তারে’র অনুপম রাইটার। এত গেলো ব্যর্থ প্রেমের হতাশ প্রেমিকের চিরচেনা রূপ। আরো কিছু প্রেমিক আছে যারা প্রতিশোধে বদ্ধপরিকর, প্রেমিকাকে আহত করে, ক্ষত-বিক্ষত করে, সমাজের সামনে কলংকিনী করে, সার্বক্ষণিক টিজিংয়ের মধ্যে রেখে মানসিক পীড়নে, সামাজিক অপমানে বিব্রত রাখতে চায়। যার শেষ পরিণতি আত্মহনন বা প্রেমিকাকে হনন বা অপহরণ। আবার উগ্র কিন্তু দেওয়ানা টাইপের প্রেমিক লাজলজ্জার মাথা খেয়ে উলটো ¯্রােতে চ-ীদাসের মত রজকিনীর বাড়ীর পুকুরে বারো বছর বড়শী বাইতেও পিছপা হয়না। যদি দেবীর মন একটু গলে, যদি একটু সুপ্রসন্ন হয় তার অনুকম্পার স্বত্বা!

বিজ্ঞাপন

এগুলো আসলে লেখার আসল উদ্দেশ্য না। আজকাল চমক না থাকলে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না। পথপাশের অথবা ভ্রাম্যমাণ যানের ক্যানভাসারের মত ঔষুধ বিক্রিই মুখ্য কিন্তু তার আগের কেচ্ছা-কাহিনী আর ভেল্কি সবই গৌণ। উপলক্ষ্য মাত্র। কথা হলো লজ্জা-ঘৃণা- ভয় এই তিন থাকতে নয় নিয়ে। শ্রী রামকৃষ্ণের অমিয় বচনাশ্রিত এই বাণীতে বাঙ্গালী স্বত্বাকে জাগ্রত করার দাওয়াই বাৎলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তাঁর এই বাণীকে কিঞ্চিৎ সমকালীন করে শিরোনাম করেছি “লাজ-লজ্জা-ভয়, এসব থাকতে নয়”। আসি সে প্রসঙ্গেই।

লজ্জা নারীর ভূষণ। এই কথা সর্বকালে সর্বদেশে সর্ব জাতি-গোষ্ঠীর জন্যই ছিলো সমভাবে প্রযোজ্য। সভ্যতা ও শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে আধুনিকতার কা-ে লতিয়ে উঠা লজ্জার কোমল লতিকা তার চরিত্র অনেকটাই পালটে ফেলেছে। কিন্তু আমাদের এই ভূ-ভাগে এর আছর যথেষ্ট ভাবে পড়েনি। তাই, কেবল নারীই নয় পুরুষও লজ্জায় দ্বিধান্বিত থেকে পাছে লোকে কিছু বলের খোঁচায় সংস্কারের বেড়া টপকাতে পারে নি। তাই, বাঙ্গালি গতির ট্র্রেড মিলে উঠতে পারেনি। উঠলেও সমতালে দৌড়াতে পারেনি। কেউ কেউ চেষ্টা করলেও সমাজের সামনে হোচট খেয়ে পড়েছে, লজ্জিত হয়েছে, কুঁকড়ে গেছে। তা দেখে অন্যরাও গুটিয়ে গেছে।

তদ্রুপ, ঘৃণা। কখনো কখনো ঘৃণা প্রকাশ্য রূপ নেয়। তা হতে পারে সাম্প্রদায়িক, হতে পারে গোষ্ঠীগত, হতে পারে বর্ণগত। এক সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচ- ঘৃণা নিয়ে বাঙ্গালি ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে। এর জন্য তাকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। তবু প্রবল ঘৃণাই বাঙ্গালীকে এক প্লাটফর্মে জড়ো করেছিলো। বাঙ্গালী বীরের জাতি বলে আমরা আত্মসুখ পেতে চেষ্টা করি। বড়াই করি আর গর্ভ স্ফীত করে ফেলি। কিন্তু উপুর্যুপরি নিষ্পেষণে পর্যুদস্ত বাঙ্গালির মননে ভয়ের বোপিত বীজ অংকুরিত হয়ে ডালপালা মেলেছে বেশ। এত গেলো আবহমান কাল থেকে চলে আসা জীবন চিত্রের কথা। তাই বলে কি, বাঙ্গালির জীবন সেখানেই থেমে আছে? এর গতিপথ কি বাঁক নেয় নি, আবেগ আর বেগ কি সমদ্রুতিতে সম্মুখ পানে অগ্রসর হয় নি? এখন আসি সে কাসুন্দি ঘাটতে।

বিজ্ঞাপন

সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। প্রজন্মের পরম্পরায় নতুন প্রজন্মের উত্থান হয়েছে। সৃজনশীলতা আর অর্জনের পাশাপাশি রতি-ভীমরতিও বেড়েছে প্রচুর। বাঙ্গালী কী থেকে কী করবে ভেবে না পেয়ে যে যার মত ব্যাট হাঁকিয়ে যাচ্ছে। কোনটা শ্লীল, কোনটা অশ্লীল, কোনটা নৈতিক, কোনটা অনৈতিক, কোনটা গ্রহণীয়, কোনটা বর্জনীয়, কোনটা সভ্য, কোনটা অসভ্যতা এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা আছে প্রচুর। কিন্তু আধুনিক মানুষ এসবে আর পরোয়া করছে না। তাই, বেসুরো অর্কেস্ট্রা বেজে চলেছে ব্যাক্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে।

এখন আর লজ্জা নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যাথা নেই। সবাই জেনে গেছে, লজ্জা থাকলে কিছুতেই কিছু হবে না। ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে হবে, বঞ্চিত হতে হতে নি:স্ব হয়ে যেতে হবে অবশেষে। তাই, রাজনীতিতে লজ্জা ‘অক্ষমতা’র নামান্তর। যারা লজ্জাকে পোষণ করেন অন্তরে-বাইরে তাদের কোন ঠাঁই নেই রাজনীতিতে। যাদের অন্তরে ঘৃণা বোধ আছে প্রবল অথচ বাইরে তার উলটো প্রকাশ তাদের আজ পোয়াবারো। পাবলিক ভেতর দেখে না। বাইরের জৌলুশ দেখে আর মোহিত হয়। যারা ভীতু তারা সারাজীবন পেছনের সারিতে বসে টেবিল চাপড়ে বীর্যবানদেরকে বাহবা দেবে আর নিজেদের কপাল চাপড়াবে। তাই, রাজনীতিতে লাজ-লজ্জা-ভয় এই তিন থাকলে শিকে ছিঁড়বে না কোনদিন। ব্যাক্তি চরিত্রে এই তিনের সমষ্টি যাদের মধ্যে বাস করে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারা ছা পোষা কেরাণী গোত্রের। অপার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও মাছি মারতে হচ্ছে তাদেরকে আজকাল। সমাজে লাজুকলতার কোন দাম নেই। বীর ভোগ্যা এ জাতি বীরের গলাতেই কেবল মালা পড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত। পরিবারও এর বাইরে নয়। পরিবারের সবচেয়ে সফল সেই জন যে ‘লাজ-লজ্জা-ভয়’কে পায়ে দলে এগিয়ে গেছে সামনে। সমাজ তাকে কুর্ণিশ করে, আসন পেতে দেয়, ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়, তার চরিত্র ফুলের মত পবিত্র মর্মে সার্টিফিকেট দেয়। তাকে নেতৃত্বের আসনে উপবেশন করিয়ে কীর্তন শুরু করে।

সংস্কৃতির অঙ্গনে লজ্জার কমতি ছিলো বরাবর। ভয় থাকলে সংস্কৃতি তার জন্য উপযুক্ত প্লাটফর্ম না। এখানে সব কিছু দিল-খোলা, চলাফেরা অগোছালো। উঠাবসার ব্যাকরণ নিপাতনে সিদ্ধ। অর্থনীতিতে নীতিবোধ যত কম থাকে তত তার বৃদ্ধি হয়। তার অনুগামী আজ আমাদের ব্যাবসায়ী সম্প্রদায়, তথা তাদের সি-িকেট। এখানে কোন নীতি নেই, মূল্যবোধ অনুপস্থিত, লজ্জা-শরমের বালাই নেই, ঘৃণার কোন বিষয় নেই। ফেল কড়ি, ধরো পোয়া। সমাজ তাদের আনুকূল্যে ও দয়াদাক্ষিণ্যে বিকশিত হচ্ছে। রাজনীতিতে তারা অগ্রণী। প্রশাসনে তাদের অনুগামী লোকের অভাব নেই। আইন-শৃঙ্খলা আর বাছ-বিচারে তাদের রিমোট সেন্সর বেশ কার্যকর। তারা জোটবদ্ধ হয়, ব্যাংক খুলে, পাবলিকের টাকা নিজের কব্জায় নিয়ে পাচার করে দেয়। তারপর তাদের নাচের পুতুলরা মার্জারের পরামর্শ প্রদান করে। অনায়াসেই তা হয়েও যায়। পেছনের কেচ্ছাকাহিনী চাপা পড়ে যায়। পাবলিক অর্থনীতির এতসব মারপ্যাঁচ বুঝে না। গা-ও করে না। কারো কোন কিছু হয় না। পুরোনো কেচ্ছা শেষে আবারো কোন এক সময় কোন এক ঢংয়ে কোন এক নতুন আয়োজন শুরু হয়। আবার তা নিয়ে লেখালেখি হয়, টক অব দ্য কান্ট্রি হয়, টক-শো’র বিষয়বস্তু হয়, আবার তার অবসানও হয়। পাবলিক এসব কাহিনী-চিত্র দেখে দেখে ক্লান্ত- শ্রান্ত-ত্যক্ত-বিরক্ত-অতীষ্ঠ।

প্রশাসনে ‘লজ্জা’ আজ ডিলিটেড ফ্যাক্ট। প্রকল্প তৈরি হচ্ছে, ইচ্ছেমত মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। এসব নিয়ে মিডিয়ায় স্কুপ নিউজ হচ্ছে, নেট দুনিয়ায় ট্রল হচ্ছে, পাবলিক হাসি-তামাশা করছে। এত কিছুতেও কারো কোন বিকার নেই। কোন ব্যাখ্যা নেই। পুনঃ পুনঃ একই খেলা চলছে। প্রশাসনিক অধিকর্তারা নিজের ছন্দে-গন্ধে বিভোর। তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের, দুর্নীতির, বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। বিদেশে তাদের পুত্র-কন্যা- জায়াদের নিয়ে বেগম পাড়া আজ চাক্ষুষ বাস্তবতা। এরপরেও কারো কোন অসুবিধে হচ্ছে না। কেউ ন্যায়-নীতিবোধের কোন তোয়াক্কাও করছে না। হিজ মাস্টার্স ভয়েজ হিসেবে কন্ঠশীলনেও তাদের কোন আপত্তি নেই। বরং রয়েছে গর্বের-গৌরবের তৃপ্তিবোধ।

বিজ্ঞাপন

এ দৌড়ে বুদ্ধিজীবীরা কোনক্রমেই পিছিয়ে নেই। বরং সবাইকে পিছনে ফেলে তারা চ্যাম্পিয়নের ডায়াসে পদ, পদক আর পুরষ্কারে ভূষিত হয়ে শোভাবর্ধন করছেন। তারা বেছে বেছে কথা বলেন, অনুকূলে সাঁতার কাটেন, প্রতিকূলে ডুব দেন। দেশে থাকলে শ্বাস নেন, বিদেশের মাটিতে চরম তৃপ্তির প্রশ^াস ফেলেন। এদের মধ্যে যারা উঁচু বিদ্যায়তনের শিক্ষক পদে আসীন তারা চলনে-বলনে আরো এক কাঠি সরেস। শিক্ষার মান নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই, সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার কোন লক্ষ্মণ নেই, জ্ঞান-গরিমার কোন গবেষণা নেই। অথচ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নিয়ে গর্বের শেষ নাই। যদিও বিশ্ব পরিম-লে রেংকিংয়ে স্থান নেই। কোন লজ্জা নেই, ভয়ের লেশমাত্র নেই। পেটে ঘৃণার তপ্ত বাষ্প উৎপাত করে। বিসিএস এদের কাছে এলার্জি, অথচ সচিব হওয়ার খায়েসে দৌড়ঝাঁপ করতেও পিছপা হন নি। পত্রিকা আর মিডিয়ায় এদের দারুণ প্রিভিলেজ। সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরাও এই তিনের সংক্রমণে প্রকটভাবে আক্রান্ত। লজ্জার কোন বিষয় তাদের সিলেবাসে নেই। বেছে বেছে নিউজ করা, কারো পক্ষে হ্যাজাক লাইট তুলে ধরে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটানো, কারো উদ্দেশ্যমূলক মূ-ুপাত করা এখন অতি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাবলিক এসব নিয়ে মজা করে, নানারকম শব্দযোগে জব্দ করে মনের খায়েস মিটায়। তাই, আগের সেই চিত্র আর নেই।

বাঙ্গালি এখন যথেষ্ট স্মার্ট হয়েছে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত বোকামী আর করে না। তারই চমৎকার প্রতিফলন নেট দুনিয়ায় দেখা যায়। এখানে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষ প্রায় সবাই লজ্জার মাথা খেয়ে যে যার মত কনটেন্ট বানাচ্ছে। সেখানে না আছে মান, না আছে নীতিনৈতিকতা, না আছে সভ্যতা-ভব্যতা, না আছে বস্তুনিষ্ঠতা, না আছে কা-জ্ঞান। এরাই এখন আমাদের রোল মডেল। আইকন। সেলিব্রেটি। এদের কথাকেই আমরা এখন শিরোধার্য করি, এদের পিছনেই উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করি। রামকৃষ্ণ মহাশয় উঁচু মানের, সমৃদ্ধ মনের আধ্যাত্মিক ও ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তাঁর এই কথাকে বাঙ্গালি আজ এত বছর পরে হলেও গ্রহণ করেছে। শুধু গ্রহণ করেই থেমে থাকে নি প্রতিনিয়ত তা অনুশীলনও করছে। শুধু ঘৃণার বিষয়টা প্রকাশ্যে উদগীরণ না করে মনে-প্রাণে লালন করে বাস্তবে তা সুকৌশলে প্রয়োগে যথেষ্ট পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এই আর কি!

আজ আমাদেরকে যেন তেন হেন প্রকারে বিত্তবান হওয়ার নেশায় পেয়ে বসেছে। ভোগের অনুগামী হয়ে আমরা কেবলই আয়-উপার্জনের খাত বাড়াবার আর পরের ধনে পোদ্দারি করার ব্যাপারে নিজেদের সকল ধ্যান-জ্ঞান ব্যয় করছি। এ এক মোহ, চৌম্বকীয় আকর্ষণ। দুর্বিনীত নেশা। অজানা গ্যালাক্সীর পথে যাত্রা। এ থেকে ফিরে আসার প্রায় সব দরোজা বন্ধ করে দিয়ে আমরা কী নিজেদেরকেই বদ্ধ কূপে আবদ্ধ করে ফেলছি না? এখানে ফ্লাড লাইটের আলো আছে, চন্দ্রালোক নেই। আছে ক্যা-েল লাইট ডিনারের আমেজ কিন্তু নেই পূর্ণিমার রোমাঞ্চ। আছে শীতাতপের হাওয়া, নেই মৃদুমন্দ বাতাসের শিহরণ। আছে ভোগের সামগ্রী থরে থরে সাজানো, মালকড়ির বিনিময়ে যা ক্ষুন্নিবৃত্তি প্রশমন করে ঠিকই কিন্তু স্বয়ংক্রিয় তৃপ্তির ঢেকুর ওঠে না। লজ্জা যেখানে গায়েব হয়ে যায়, ভয় যেখানে শূন্য হয়ে যায় সেখানে ঘৃণা অবশ্যই দানা পাকিয়ে ওঠে। লজ্জাহীনরা শুধু ঘৃণাই ছড়ায় না, কলকাঠিও নাড়ে। ভয় শূন্য চিত্ত ঘৃণাকে জিঘাংসা ও নির্মূলের হাতিয়ার করে। এ থেকে মুক্তির কোন দাওয়াই নেই। কোন শল্য চিকিৎসা নেই। কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক সাধনা, পারিবারিক সুশিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, নীতি-নৈতিকতার অনুশীলন, লজ্জা-শরমের যৌক্তিক প্রয়োগ, ভয় প্রদর্শন নয় নির্ভিক চিত্তের বিকাশ ও সামাজিক-রাজনৈতিক- প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতাই পারে প্রকৃত সভ্য সমাজের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন