বিজ্ঞাপন

ঘূর্ণিঝড়ে জীবনের প্রতিরক্ষার আন্দোলন সুন্দরবন

May 27, 2024 | 5:27 pm

সজীব ওয়াফি

২৬ মে রাত থেকে উপকূলে আছড়ে পরেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। রাত যতোই গভীর হচ্ছিলো উপূলবাসীর ভয় কেবল ততটাই বেড়েছে, কখন ছোবল দেবে বিধ্বংসী, জীবন টিকবে কিনা সংশয়! সকাল রাতের এক একটা দমকা বাতাসের ঝাপটা বুকের ভিতর কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল। ঘন্টায় ১২০ কি.মি. বাতাসের গতিবেগ, মাঝারি বর্ষণ আর ৪-৫ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের জলোচ্ছ্বাস। গাছপালা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হচ্ছিল একের পর এক। বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো তো পূর্ব থেকেই নাজেহাল অবস্থা। নারিকেল, মেহগনী, সুপারি গাছগুলো দুমড়ে মুচড়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি ভূমি ভাঙ্গন রোধ করে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতায় বাঁধা দিচ্ছিল কোনমতে।

বিজ্ঞাপন

১৫ নভেম্বর ২০০৭ সালে বিস্তৃত উপকূল অঞ্চল আক্রান্ত হয় ঘূর্ণিঝড় সিডরে। পরবর্তীতে সাপের ছোবলের ন্যায় আবারো পর্যাক্রমে আঘাত হানে আইলা, নাসরিন, জামালা, মহাসেন, আম্পান নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়ে। সিডর খুলনা-বরিশাল উপকূল দিয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করেছিল বলে প্রায় সরল রেখায় বাংলাদেশকে অনেকটা বাগে পেয়েছিল। সারারাত প্রচন্ড বাতাসের সাথে ভারী বর্ষণ, বিদ্যুৎ চমকানি, বজ্রপাতের গর্জনে প্রলয়কারী অবস্থা। শেকড়সুদ্ধ কড়াই, মেহগনী,বট গাছগুলো উৎপাটিত হচ্ছিল। বিশাল বিশাল গাছ ঘরের উপরে পরে চাপা দিচ্ছিল। দেশীয় তাল, নারিকেল, হিজল গাছগুলো দুমড়ে মুচড়ে গেছে কিন্তু টিকে ছিল। গভীর টিউবয়েলগুলো উঠিয়ে ফেলে। সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ভাটা অবস্থাতেই ৫-৬ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে নদীতে টেনে নিয়ে যায় প্রাণী। বাগেরহাটের স্মরণখোলাসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে গাছের ডালে, জঙ্গলে পরে থাকে মানুষের মৃত দেহ। নদীতে ভেসে যাচ্ছিল অসংখ্য মৃত প্রাণী, চতুর্দিকে মৃত্যুমাখা দুর্গন্ধ। সংকট দেখা দিয়েছিলো বিশুদ্ধ পানির। সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত হয়েছিল সেই বন। বুক পেতে ঝড়ের আঘাত প্রায় পুরোটা নিজে সয়ে বাংলাদেশকে কতটা রক্ষা করেছিল, সিডরের লেজের ঝাপটায় উপকূলবাসী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল সেদিন। আজকেও কি তার ব্যতিক্রম হয়েছে? হয়নি। বরং মায়ের কোলের মতো এবারও সন্তানকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে! নিজের শেষটুকু উজাড় করে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আর কত! আমরা যে গিলে ফেলেছি, উন্নয়নের নামে বেনামে শেষ করে ফেলেছি ক্রমে ক্রমেই! ঘূর্ণিঝড় আসলেই উপকূলের উন্নয়ন নগ্ন হয়ে পরে। আর আমাদের ভদ্র সমাজ শহরের অট্টালিকায় এসির বাতাস খেতে খেতে অট্টহাসি হেসে জিকির তুলবে— বন পুড়িয়ে হলেও বিদ্যুৎ চাই।

ঘূর্ণিঝড় আসলেই সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে উৎপাটিত হয়ে পরে। বাঘ হরিণ সহ অসংখ্য প্রাণী মরে পরে থাকে, মৃত প্রাণী ভাসতে থাকে সুন্দরবনের ভিতরে নদীতে। লোকালয়ের দিকে ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস- জলোচ্ছ্বাস প্রবাহের ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তুলেছিলো প্রতিবার। সুন্দরবন ছিলো বলেই ঘুর্ণিঝড়ের রাতে ভাঙ্গনের কবলে পরতে হয়নি উপকূলীয় এলাকায়। নিরাপদে আগলে রাখার পরও প্রাণ হানিসহ যে ক্ষতি হয়েছিল, সুন্দরবন না থাকলে সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য খুব সামান্য অনুভব করা যায়। ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে পুরো বন। ঘন্টায় ১২০ কি.মি. শক্তিশালী বাতাসে বাঁধা সৃষ্টি করে লোকালয়ে পৌঁছেছে ৮০ কি.মি. বেগ। শক্তি হারিয়ে রূপ দিয়েছে দমকা বাতাসে। সন্তান রক্ষার শর্তে প্রবল ঢেউয়ে বাঁধা দিয়ে উচ্চতা কমিয়ে দিয়েছে। উপকূলবাসী কে ঘূর্ণিঝড়-সুনামির মত দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষায় এক ধরনের দেয়াল তৈরী করে বনায়ন। অথচ আমরা জেনে বুঝে সেই বন ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় নেমেছি। জীবনের প্রতিরক্ষাকারী এ সুন্দরবনের কাছেই রামপালে তৈরী হয়েছে দেশের বৃহত্তম কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা ক্রমে ক্রমে সুন্দরবন ধ্বংস করে দিচ্ছে, কালের গহ্বরে প্রতিরক্ষাহীন করে দেবে উপকূলীয় মানুষের জীবন।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত খনিজ কয়লার ফ্লাই অ্যাশ, চিমনি থেকে নির্গত কালো দূষিত ধোঁয়া বাতাসে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পরছে সুন্দরবন এবং লোকালয়ে। মারা যাচ্ছে পরিচিত অপরিচিত হাজারো গাছপালা। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পশুর নদীতে ইঞ্জিন চালিত জাহাজ চলাচল করছে, কয়েকদিন পর পরই পত্রিকার পাতা জুড়ে ভেসে আসছে কয়লাসহ জাহাজ ডুবে যাওয়ার খবর। পাশাপাশি অন্যদিকে কয়লা বহনের জন্য যোগযানে তৈরী করছে শব্দ দূষণ। ঢাকনা ব্যবহার করলেও কিছু কয়লার গুড়া পথে থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। আলকাতরার মত বর্জ পদার্থ যা নিষ্কাশন হচ্ছে পশুর নদে। মারা পরছে জলজ উদ্ভিদ, কাঁকড়া, বিলুপ্ত হচ্ছে বিশ্বের বিরল প্রজাতির নীল শুশুক যা কিনা একমাত্র পশুর নদীতেই জাগে। বছরে দুই লিটার পারদ উৎপন্ন হচ্ছে যা কিনা গড়িয়ে পরছে সুন্দরবনের উপর দিয়েই। ধ্বংস হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহ ছোট বড় অসংখ্য প্রাণ প্রকৃতি। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই উচ্চ মাত্রায় শব্দ দূষণ, মানুষের অতিরিক্ত চলাচল বৃদ্ধিতে নিঃশেষিত হরিণের চারনভূমি, ধ্বংসের দারপ্রান্তে বাঘের অভায়ারণ্য।

বিজ্ঞাপন

রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভিত্তি করেই ইতোমধ্যে প্রভাবশালী পক্ষগুলো ভূমি কিনে দখল করে আছে সুন্দরবনের পাশে, স্থাপন হয়েছে ১৯আধিক করাত কল। বলুন তো এই ১৯ টি করাত কলগুলো কিসের জন্য !! বুঝতে তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, নিশ্চিত সুন্দরবনের গাছ দিন দুপুরে বলি হবার জন্য। যখন ভারতসহ বহিঃবিশ্বে পরিবেশ ঝুঁকির জন্য তাদের কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প বাতিল করে দিচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের চড়া সুদে ঋণের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগের ৭০% ঋণ নিলাম। বাংলাদেশের নিজস্ব বিনিয়োগ ১৫% ভারতের ১৫% । ভারতে বাতিল হওয়া এ প্রকল্পে বন উজাড় হবে আমাদের, ভূমি ব্যবহার হবে আমাদের, ঋণের সম্পূর্ণ বোঝা এবং প্রকল্পের ঝুঁকি বহন করব আমরা; আবার ঝড়েও মরবো আমরা। কেবল উচ্চ হারে বিক্রিত বিদ্যুতের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৮৫% বিনিয়োগ করেও, লভ্যাংশের ভাগবাটোয়ারা সমান সমান! আর চাকরির বেলায়?

রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেমনি সুন্দরবন ধ্বংস করবে তেমনি ধীরে ধীরে এর বিষাক্ত প্রভাব পরবে মানুষের উপর। কিছু দিন আগেও বনে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কারা লাগালো এ আগুন? স্থানীয় মানুষের বিস্তার তো আছেই। জলদস্যুর থেকে যদি রক্ষা করা না যায় তবে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বন বিভাগ কিসের জাবর কাটে? পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লোনাপানির প্রাকৃতিক এই ম্যানগ্রোভ বন যদি আমাদের হেয়ালীমনোভাবে ধ্বংস হয়, তবে প্রকৃতিতে তার পরিণতি বেশি একটা ভাল হবে না। সিডর-আইলা-রেমালের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দেবে যথাসময়ে। তার সংকেত আমরা পাচ্ছি। সুন্দরবন আচ্ছাদিত এলাকা মোটামুটি একটা লাইনে ভারসাম্যতা রক্ষা করে আছে। খেয়াল করলেই স্পষ্ট বোঝা যায় ক্রমেই সুন্দরবন ফুরিয়ে যাওয়ার পরেই ধীরে ধীরে মেঘনা অববাহিকা উত্তর পূবে কত গভীরে প্রবেশ করেছে। মেঘনা সহ অন্যান্য নদীর স্রোত এবং উপকূলীয় বনের অনুপস্থিতি উভয়ই এর জন্য দায়ী। মোটা দাগে বললে উপকূলীয় বন ধ্বংস করে আগামী প্রজন্মের লাশের উপরে দাড়িয়ে রামপালের খামখেয়ালী উন্নয়নের প্রায়শ্চিত একদিন করতে হবে নিশ্চিত। যার যায় সে বুঝে, অট্টালিকাবাসী কি করে বুঝবে দক্ষিণে হাওয়া, তারা তো দক্ষিণেশ্বরীর আদরমাখা সন্তান নয়।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে মানুষ পাহাড় ধ্বসের যে হুমকির মুখে পরেছে তা শতগুণ বেড়েছে বন উজাড় করায়, পাহাড় কেটে হোটেল অফিস অট্টালিকা তৈরি করায়। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা দিনে দিনে আরও বাড়বে, আরও বেশি বেশি আক্রান্ত হবে খুলনা-বরিশাল-নোয়াখালী-চট্টগ্রাম জুড়ে আমাদের উপকূল। উপকূলীয় এলাকার প্রাকৃতিক বন শুধু উপকূল নয়, পুরো বাংলাদেশকেই রক্ষা করে। সেই রক্ষাকবজ বন নষ্ট হলে পুরো দেশই অরক্ষিত হয়ে যায়। শুধুমাত্র সুন্দরবন কেন, কোন বনকেই ধ্বংস নয়, বরং উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে দেয়াই আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়। প্রতি বছর ধারাবাহিক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতেও যদি হুঁশ না হয়, এই অসভ্য সভ্যতার ভব্যতায় আর কবে ঘুম ভাঙ্গবে!

বিজ্ঞাপন

সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন শুধুমাত্র প্রতিবেশ আন্দোলন না, জীবনের প্রতিরক্ষার আন্দোলন। জীবনের প্রয়োজনে দাঁড়াও, বাঁচাও জীবন বাঁচাও সুন্দরবন।

লেখক: পরিবেশবাদী, মানবাধিকারকর্মী ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন