বিজ্ঞাপন

যেভাবে টানেলের যুগে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশ

February 10, 2019 | 4:39 pm

।। মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক ।।

বিজ্ঞাপন

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প এলাকা থেকে ফিরে: কর্ণফুলী নদীর ওপর তখন দুপুরের রোদ ঝকঝক করছে। কর্মব্যস্ত নদীর বুকে অসংখ্য বড় বড় জাহাজ—কোনোটা ছেড়ে যাচ্ছে, কোনোটা নোঙর করছে, কোনোটা আবার ছাড়ার অপেক্ষায়।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ন্যাভাল একাডেমির ওয়েস্ট পয়েন্ট ধরে টিম সারাবাংলা পাড়ি জমায় সোজা পথে। গন্তব্য ওপারের আনোয়ারা। নদীটা এখানটায় প্রায় এক কিলোমিটার প্রশস্ত। পানির গভীরতা ৬০ ফুটেরও বেশি। মালবাহী বৃহদাকার জাহাজগুলো চলছে অবলীলায়। আর ঠিক এখান দিয়েই নদীর তলদেশে থেকে আরও শতফুট কিংবা তারও বেশি গভীরতায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে চলে যাবে একটি টানেল।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: কর্ণফুলীর তলদেশ যেভাবে কাটবে দৈত্যাকৃতির টিবিএম

সে টানেল দেখতে কেমন? নদী পাড়ি দেওয়ার আগেই টিম সারাবাংলা যায় পতেঙ্গা অংশে টানেলের প্রকল্প এলাকায়। সেখানে প্রকল্প অফিসের বাইরে টানেলের একটি রেপ্লিকা দেখা যায়। তার ওপরে ইংরেজি ও চীনা ভাষায় লেখা—কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্প।

কিন্তু এখন আর কেবল রেপ্লিকা কিংবা পরিকল্পনায় আটকে নেই টানেল প্রকল্প। মাটির অনেক গভীরে এরই মধ্যে খনন কাজের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে বসানো হয়েছে টিবিএম বা টানেল বোরিং মেশিন।

দেখতে কেমন সে টিবিএম? সারাবাংলা টিম যায় টানেলের উৎসমুখে। সেখানে লোহার খাঁচায় ঘেরা ঘোরানো প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে প্রায় ৪০ ফুট পাতালে নেমে দেখা যায়, দৈত্যাকায় সে মেশিন নদীর তলদেশে তার দাপুটে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে।

হাজারো ‘কর্মবীরের’ ঘামে-শ্রমে রচিত হচ্ছে কর্ণফুলীর নতুন ইতিহাস

প্রায় তিন তলা সমান উঁচু দৈত্যাকৃতির এ টিবিএম কর্ণফুলীর পতেঙ্গা পয়েন্টের এই অংশ থেকে মাটি কেটে কেটে এগিয়ে যাবে। যা কোনো কোনো পয়েন্টে তলদেশের মাটি থেকেও ১৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত পাতালে ঢুকবে, যার মধ্য দিয়ে তৈরি হবে সুড়ঙ্গ পথ।

কীভাবে কাজ করবে সে টিবিএম? সে কথা জানা যায় প্রকল্পের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানালেন, মেশিনের ঠিক সামনে আছে ধারালো কাটার, যা মাটি কাটতে কাটতে এগিয়ে যাবে। আর পেছন দিক দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কংক্রিটের একেকটি সেগমেন্ট ঢুকে চারিদিকে গোলাকারের শক্ত দেয়াল তৈরি করবে। ফলে মেশিন যত এগুবে, ততই ধীরে ধীরে আকার পাবে টানেল।

বিজ্ঞাপন

কেমন দেখতে সে সেগমেন্টগুলো? জানা যায়, এরই মধ্যে চীন থেকে তৈরি হয়ে এসেছে এমন দুই হাজারেরও বেশি সেগমেন্ট। অদূরেই নদীর তীরঘেঁষে রাখা হয়েছে সেগুলো। সেটা দেখতে সারাবাংলার ক্যামেরা চোখ মেলে প্রকল্প এলাকার আকাশ থেকে। সেখানে মনিটরে ধরা পড়ে গোটা প্রকল্প এলাকা।

নদী জানবেও না তলদেশে নির্মাণযজ্ঞের খবর!

অদূরেই নদীর তীরঘেঁষে চলে যাওয়া পাকা সড়কের এ পাশে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেগমেন্টগুলো। ঝাঁ চকচকে সেগমেন্টগুলো চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জেংজিয়ান শহরে টানেল সেগমেন্ট কাস্টিং প্ল্যান্টে তৈরি হয়েছে। পুরো টানেল তৈরিতে এমন ২০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট প্রয়োজন হবে। এ পর্যন্ত দুই হাজারের কিছু বেশি সেগমেন্ট পৌঁছেছে।

প্রকৌশলীরা জানালেন, কংক্রিটের সেগমেন্টগুলো একটি রেল ট্র্যাক দিয়ে ঢুকবে। সুড়ঙ্গপথে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে সে রেল ট্র্যাক। সারাবাংলার চোখ ঘুরে আসে সে পথও। প্রকৌশলীরা আরও জানান, আটটি সেগমেন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে এসে একটির সঙ্গে অন্যটি লেগে যাবে। এভাবে টিবিএমের সামনের অংশ খনন করতে করতে এগুতে থাকবে, আর পেছনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেগমেন্ট এসে যুক্ত হতে থাকবে। প্রতি আটটি সেগমেন্টে দুই মিটারের একটি রিং তৈরি হবে। এভাবে ২০ হাজার সেগমেন্ট বসলেই পুরো আড়াই কিলোমিটার টানেল তৈরি হয়ে যাবে। টানেল কর্তৃপক্ষ জানালো, প্রতিদিন এভাবে ৪ থেকে ৫ মিটার করে টানেল তৈরির কাজ এগুবে।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এই বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত রয়েছে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)।

বিজ্ঞাপন

এখনপর্যন্ত যা কিছু কাজ চলছে, তা ঠিক কর্ণফুলী নদীর অংশে নয়। মূল নদী আরও এক কিলোমিটার দূরে। ফলে মূল নদীর অংশ বাদ দিলেও দুই পাশে প্রায় এক কিলোমিটার করে টানেল এগিয়ে গিয়ে তবেই খোলা আকাশের নিচে উঠে আসবে।

টানেলের মূল কাজ ছাড়াও পতেঙ্গা প্রান্তে ওয়ার্কিং শাফট ও কাট অ্যান্ড কভার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে কভারের গাইড ওয়াল ও ৯৮ মিটার ডায়াফ্রেম ওয়াল তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।

ওপারে আনোয়ারা পয়েন্টেও থেমে নেই অগ্রগতি। নদী পাড় হয়ে এক কিলোমিটার এগিয়ে গেলে দেখা যাবে সেখানে টানেলের বহির্গমন পথ তৈরির কাজ চলছে ধুন্ধুমার।

তবে মূল খনন কাজ শুরু হবে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন সুইচ চেপে উদ্বোধন করবেন টিবিএম। এরপর প্রতিদিন গড়ে পাঁচ মিটার করে মাটি কেটে কেটে এগিয়ে যাবে টিবিএম। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ঢুকে পড়বে টানেলের যুগে।

প্রকল্পের কিছু তথ্য

প্রকল্পের প্রাক্কলিত মোট ব্যয় (মিলিয়ন): ৯৮৮০.৪০৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ৩ হাজার ৯৬৭ দশমিক ২১১৪ কোটি টাকা ব্যয় করবে এবং চীন প্রকল্প সহায়তা দেবে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯২৪ কোটি টাকার।

চট্রগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপোযুগী সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থার আধুনিকায়নই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এর মধ্য দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হবে বাংলাদেশ। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সঙ্গে ডাউন টাউনকে যুক্ত করা হবে, যার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়বে। প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ কাজও ত্বরান্বিত করবে এই টানেল। সর্বোপরি ঢাকা-চট্রগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন একটি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করবে কর্ণফুলী টানেল।

চীনের সাংহাইয়ের আদলে বন্দর নগরী চট্টগ্রামও হয়ে উঠবে ওয়ান সিটি টু টাউন।

আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে হলেও এই টানেলের নাম হতে পারে বঙ্গবন্ধু টানেল। সে প্রস্তাব এরই মধ্যে করা হয়েছে চট্টগ্রামের এমপি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের তরফ থেকে। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই তিনি সে প্রস্তাব তুলে ধরেন। আর সে প্রস্তাবকে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বিবেচনায় রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কর্ণফুলী নদীর তলদেশের এই টানেল যার স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন।

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন