Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উপকূলে রেমালের তাণ্ডব, জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত নিম্নাঞ্চল

সারাবাংলা ডেস্ক
২৭ মে ২০২৪ ০৮:৪৮

সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত একটানা উপকূলে তাণ্ডব চালিয়েছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। মূল ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশে মোংলার পাশ দিয়ে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া উপকূলে প্রবেশ করে সাতক্ষীরার শ্যামনগর হয়ে উত্তর দিকে ধাবিত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ও পরে স্থল নিম্নচাপ হিসেবে। তবে আঘাত হানা এলাকায় দগদগে ক্ষত রেখে গেছে রেমাল। পাশাপাশি জোয়ার ও তীব্র জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের বেশ কয়েকটি জেলাতেই নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে গোটা সুন্দরবন।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২৬ মে) সকালেই রেমাল ঘূর্ণিঝড় থেকে রূপ নেয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছিল এটি। ক্রমেই উত্তরে অগ্রসর হয়ে ঘূর্ণিঝড়টি মোংলা ও পায়রা বন্দরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। রোববার সন্ধ্যা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ স্থলভাগ অতিক্রম করতে শুরু করে।

আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, রোববার রাত ৯টার দিকে ঘূর্ণিঝড়ের মূল অংশ তথা কেন্দ্র উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে। মধ্যরাত নাগাদ কেন্দ্রটি উপকূল অতিক্রম শেষ করে। এরপর ঘূর্ণিঝড়টির নিম্নভাগ উপকূল অতিক্রম শেষ করেছে আজ সোমবার (২৭ মে) ভোর নাগাদ। এখন এটি স্থল নিম্নচাপ আকারে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

আরও পড়ুন-

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শনিবার রাতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, বরিশালসহ উপকূলের কয়েকটি জেলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। রোববার সকাল থেকে বৃষ্টিপাত বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় বাতাস। ঝড়ো ও দমকা হাওয়া আকারে উপকূলীয় প্রায় ১৫টি জেলায় বয়ে যেতে থাকে বৃষ্টি-বাতাস।

বিজ্ঞাপন

ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করলে পটুয়াখালী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, ঝালকাঠি উপকূলীয় জেলাগুলোতে তীব্র গতিতে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে থাকে। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, রোববার রাত সাড়ে ১১টা/১২টার দিকে পটুয়াখালীতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ একটানা ১০২ কিলোমিটার পর্যন্ত গতির ঝড়ো হাওয়া তারা রেকর্ড করেছেন। প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে কোনো কোনো জায়গায় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্তও হয়ে পারে। আজ (সোমবার) সকালে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে বলে জানান তিনি।

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি জোয়ার আর জলোচ্ছ্বাসও উপকূলীয় জেলাগুলোর বাসিন্দাদের বিপাকে ফেলে। বিশেষ করে ভোলা, বরগুনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশালের নিম্নাঞ্চল ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বরিশাল বিমানবন্দরের সব ফ্লাইটি বাতিল করা হয়। বন্ধ করা হয়েছে চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু টানেল।

অন্যদিকে জলোচ্ছ্বাসে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় প্রায় সব জেলার নদীর বন্দরের কার্যক্রমই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামসহ সংলগ্ন এলাকাগুলোতে সব নৌ রুটেই নৌ যান চলাচল এখনো বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরেও সব জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সারাবাংলার বরিশাল ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জানিয়েছেন, রোববার রাতেই নদীর পানি বরিশাল নগরীর বিভিন্ন সড়কে উঠে যেতে দেখা গেছে। নগরীর রূপতলীর জিয়ানগর, খ্রিষ্টানপাড়া, পলাশপুর, বেলতলা, রসুলপুর, মোহাম্মদপুর, দক্ষিণ রূপাতলী, ভাটিখানা, কাউনিয়া, প্যারারা রোড, সদর রোড, কেডিসি, ত্রিশ গোডাউন, দপদপিয়া, কালিজিরা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যায়। এসব এলাকায় বসতবাড়িতেও উঠে যায় পানি। গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সড়ক চলে গেছে পানির নিচে।

রাত ৯টার দিকে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সৈয়দ আরশাদ আলী বলেন, ‘কীর্তনখোলা নদীর পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।’ জোয়ারের সময় এ পানি আরও বেড়ে যায়।

বাগেরহাট ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জানিয়েছেন, বাগেরহাটের ভারী বর্ষণে সন্ধ্যার পর থেকেই পশুর নদীর পানি বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস যুক্ত হলে তলিয়ে গেছে গোটা সুন্দরবন।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র ও পর্যটন স্পটের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, (রোববার) রাতে স্বাভাবিকের চেয়ে চার ফুট পানি বেড়ে সুন্দরবন তলিয়ে গেছে। পানির চাপ আরও বাড়বে। তবে বণ্যপ্রাণীর কোনো ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

কক্সবাজার ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্টের তথ্য, রেমালের প্রভাবে সাগরে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট বাড়তি ছিল। এতে কক্সবাজার সদরের কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতি পাড়া, গোমাতলী, পোকখালী, ইসলামপুর, মহেশখালী ও কুতুবদিয়াসহ জেলার নিম্নাঞ্চলের ২০টি গ্রামে সাগরের জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে। সাগরের পানি ঢুকে পড়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপেও।

জেলার মহেশখালী পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদার পাড়া এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে রোববার বিকেলে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন এলাকার মানুষ। এ ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী মূল বাধের বেশকিছু এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ টিকিয়ে রাখতে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে একটানা মেরামতের কাজ করছেন শ্রমিকরা।

সারাবাংলার চট্টগ্রাম ব্যুরোর খবর, রেমালের প্রভাবে সাগর উত্তাল হয়ে গেলে দুপুর থেকেই নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় বেড়িবাঁধসংলগ্ন লোকালয় প্লাবিত হতে শুরু করে। পানি ঢুকে পড়ে বাড়িঘর, দোকানপাটে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় বেশকিছু মাছ ধরার নৌকা। তবে রেমালের আঘাতের শঙ্কায় সকাল থেকেই এই পাড়ার বাসিন্দারা মালপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করেন। সন্ধ্যা-রাত নাগাদ গোটা এলাকাই প্লাবিত হয়ে পড়ে।

রেড ক্রিসেন্ট জোনাল কো-অর্ডিনেটর তৌসিফ রেজওয়ান বলেন, মূল বেড়িবাধের ক্ষতি না হলেও সংলগ্ন বিভিন্ন ঘেরের বাধের একাংশ ভেঙে পড়েছে। জেলেপাড়ার ভেতরে পানি ঢুকে গেছে।

ভোলা ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জানিয়েছেন, সদরসহ জেলার পাঁচ উপজেলার ১০ ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলসহ ৭৪টি এলাকার ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। রেমালের আঘাতে জলোচ্ছ্বাসের কারণে প্লাবিত হয়েছে এসব এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে— ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের রামদাসপুর, ভোলার চর, কানিবগার চর, চর মোহাম্মদ; চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগর ইউনিয়ন; লালমোহন উপজেলার চর কচুয়া ও চর শাহাজালাল; তজুমদ্দিন উপজেলার চর মোজাম্মেল, চর জহিরুদ্দিন; এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুর।

জেলা দুর্যোগকালীন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভোলার আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ ও প্রায় দুই হাজার গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের শুকনো খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন-

রেমালের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে বরগুনার নিম্নাঞ্চলও। রোববার সন্ধ্যার পর থেকেই জেলাজুড়ে বাতাসের গতি বাড়তে থাকে। শুরু হয় বৃষ্টি। রাতে সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করলে সবাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। জলোচ্ছ্বাস আর পানির তোড়ে এই সড়ক ভেঙে গেলে সবাইকে পথে বসতে বলে জানান বাসিন্দারা। এ ছাড়া পাথরঘাটার বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় আশপাশের গ্রামগুলোতে পানি ঢুকেছে। এ অবস্থায় জেলার ৬৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ২০২টিতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

সাতক্ষীরা ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের বরাত দিয়ে জানান, রাত ১০টা নাগাদ সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানে রেমাল। গভীর রাত পর্যন্ত জেলাটিতে তাণ্ডব চালিয়েছে এই ঘূর্ণিঝড়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জোয়ারের পানির তোড়ে শ্যামনগর ও আশাশুনির বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। প্রচণ্ড গতিবেগের বাতাস আর বৃষ্টিতে জেলাজুড়ে বিপুল পরিমাণ গাছপালা ভেঙে পড়েছে। অনেক এলাকায় কাঁচা ও আধাপাকা ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়াসহ জেলাটি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।


লক্ষ্মীপুরেও রেমালের প্রভাবে মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রামগতির চর আবদুল্লাহ, বয়ারচর, তেলিরচর, চর গজারিয়া ও বড়খেরী; কমলনগর উপজেলার লুধুয়া, মাতাব্বরহাট ও নাছিরগঞ্জ; রায়পুর উপজেলার চর কাচিয়া, চরইন্দ্রুরিয়া, চরবংশী, চর জালিয়া ও চর খাসিয়া; এবং সদর উপজেলার চরমেঘা পানিতে তলিয়ে গেছে।

একইভাবে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় রেমালের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের তুলনায় চার থেকে পাঁচ ফুট বেশি হওয়ায় অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের মোল্লা গ্রাম, মুন্সি গ্রাম, আদর্শ গ্রাম, বান্দাখালী গ্রাম, ডুবাইয়ের খাল গ্রাম, ইসলামপুর গ্রাম, আনন্দগুচ্ছ গ্রাম, বাতায়ন গ্রাম, বসুন্ধরা গ্রাম, ধানসিঁড়ি গ্রাম ও পূর্বাচল গ্রাম; হরণী ইউনিয়নের চর ঘাসিয়া ও বয়ারচর গ্রাম; নলচিরা ইউনিয়নের তুফানিয়া গ্রাম; তমরদ্দি ইউনিয়নের পশ্চিম তমরদ্দি গ্রাম রয়েছে প্লাবিত হওয়া গ্রামের তালিকায়।

নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আফছার মো. দিনাজ উদ্দিন বলেন, রোববার দুপুর থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জোয়ারের পানিও ঢুকেছে। এতে নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/টিআর

কক্সবাজার খেপুপাড়া ঘূর্ণিঝড় ঘূর্ণিঝড় রেমাল ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব চট্টগ্রাম জলোচ্ছ্বাস জোয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত প্রবল ঘূর্ণিঝড় বরগুনা বাগেরহাট মোংলা রেমাল সাতক্ষীরা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর