বিজ্ঞাপন

প্রমাণ ছাড়া এস কে সিনহার বিরুদ্ধে মামলা নয়: দুদক

September 24, 2018 | 5:15 pm

।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সুনির্দিষ্ট দালিলিক প্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে তদন্ত ও মমলা করা যায় না বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

সোমবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নিজ কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।

প্রসঙ্গত, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রোববার বিকেলে নারায়ণগঞ্জে জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির অভিষেক ও ডিজিটাল বার ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্বোধন শেষে বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ দুদক খতিয়ে দেখছে। দুদক তার বিরুদ্ধে যখন মামলা করবে, তখনই মামলা হবে। সরকার এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।

বিজ্ঞাপন

‘এস কে সিনহার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং মামলা করা হতে পারে’- সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের উত্তরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রীর কথায় তো মামলা হবে না। মন্ত্রীর কথায় অনুসন্ধানও হবে না। সরকার নিজেরাই বলে স্বাধীন কমিশন। মন্ত্রী যা বলেছেন উনি ওনার কথা বলেছেন। মাননীয় মন্ত্রীর কোনো কথার প্রভাব দুদকে পড়ার কোনো রকমের সম্ভাবনা নেই। আমরা আপনাদের গ্যারান্টি দিচ্ছি। আমার কথা পরিষ্কার কারও বিরুদ্ধে এভিডেন্স ছাড়া আমরা কনক্লুসিভ কনভিন্সড না হলে কারও বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধান হবে না, তদন্তও হবে না।’

কোনো অভিযোগ পেয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আই হ্যাভ নো কমেন্ট। ৪ কোটি টাকার যে অনুসন্ধান, তা কবে শেষ হবে আমি বলতে পারব না। টাকাটা কোথায় গেছে তা আমাদের বের করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, অনুসন্ধান তাড়াতাড়ি শেষ করতে। তারা সম্ভবত কালকেও গেছে। আজকেও গেছে। ওই টাকা কোথায় গেল, কীভাবে গেল; তা তো জানতে হবে।’

দুদকে চলমান ‘ফারমার্স ব্যাংকের চার কোটি টাকা কেলেঙ্কারি’ প্রসঙ্গে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘দুজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ঋণ প্রদান ও ঋণের টাকা অন্য কোথাও যাওয়া, সেটার অনুসন্ধান চলছে। সেই চার কোটি টাকার ব্যাপারে আপনারা এক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন (যে সেই টাকা সিনহার অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে)। আমরা কিন্তু সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো কিছু বলিনি। তদন্ত চলছে। এখনও এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার সময় আসেনি।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে গত ২১ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান করছে দুদক।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘দুদকের আইনজীবী তো আমাদের মুখপাত্র না। সে আমাদের স্থায়ী উকিলও না। তিনি যে কোনো ব্যক্তির উকিল হতে পারেন, আপনারও হতে পারে। আইনজীবী যেটা বলেছে, সেটা তার নিজস্ব বক্তব্য। তিনি দেশে নেই, আমি তার কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না।’

বেসিক ব্যাংকের মামলা স্থবির হয়নি জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের মামলা স্থবির হয়নি। বেসিক ব্যাংকে কত টাকা জমা হয়েছে আপনারা খবর নিয়ে দেখুন। আপনারা দেখছেন এ আসামি ধরা হচ্ছে না। ওই আসামি ধরা হচ্ছে না। আবদুল হাই বাচ্চুকে ধরা হচ্ছে না। আপনারা কী জানেন কত টাকা জমা হয়েছে?’

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি বিদেশ পাড়ি জমান। ওই সময়ে সিনহার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেন, নৈতিক স্খলনসহ বেশকিছু অভিযোগ ওঠে।

বিজ্ঞাপন

গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর আমন্ত্রণ পেয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে দেখা করতে যান আপিল বিভাগের চার বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। আলোচনার এক পর্যায়ে বিচারপতিদের কাছে সিনহার অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগের প্রমাণাদি হস্তান্তর করেন।

গত ১ অক্টোবর আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতি বৈঠকে মিলিত হয়ে উক্ত ১১টি অভিযোগ বিশদভাবে পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ওইসব গুরুতর অভিযোগগুলো প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে অবহিত করা হবে। তিনি যদি ওইসব অভিযোগের ব্যাপারে কোনো সন্তোষজনক জবাব বা সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন তাহলে তার সঙ্গে বিচারালয়ে বসে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এ সিদ্ধান্তের পর ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অনুমতি নিয়ে উল্লিখিত পাঁচ বিচারপতি মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। পাঁচ বিচারপতি জানান, অভিযোগগুলোর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তারা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বেঞ্চে বসবেন না।

প্রধান বিচারপতি জানান তিনি পদত্যাগ করবেন। গত ২ অক্টোবর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটির আবেদন করেন এবং রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেন।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। নয়জন আইনজীবীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে রায় দেন।

গত ৩ জুলাই আপিল বিভাগও ওই রায় বহাল রাখেন। যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় ১ আগস্ট।

রায়ের পর্যবেক্ষণের প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।’ ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে সরকার, সংসদ, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সামরিক শাসন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে এমন অনেক পর্যবেক্ষণ উঠে আসে।

এরপরই প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দেয়া রায় ও পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা। সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগও দাবি করেন।

প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগ হলো

১. তার আয়-ব্যয়ের হিসাব সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জ্ঞাত উৎসের বাইরে থেকে ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংকে টাকা পাওয়া গেছে।

২. বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সিঙ্গাপুরে একটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করেছেন। ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অন্তত দেড়কোটি টাকা রয়েছে। এ ধরনের অ্যাকাউন্ট করার ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমতি নেননি।

৩. অস্ট্রেলিয়ায় একটি ব্যাংকে বিচারপতির একটি অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই অ্যাকাউন্টেও বাংলাদেশি টাকায় এক কোটির বেশি টাকা রয়েছে। ওই অ্যাকাউন্ট করার ক্ষেত্রেও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

৪. কানাডায় একটি ব্যাংকে বিচারপতি সিনহার একটি অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ওই অ্যাকাউন্ট বিচারপতি সিনহা লেনদেন করেছেন।

৫.  বিচারপতি সিনহা তথ্য গোপন করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে অবৈধভাবে প্লট নিয়েছেন।

৬. বিচারপতি সিনহার সুপ্রিম কোর্ট সোনালী ব্যাংকের বেতন অ্যাকাউন্টে চার কোটি টাকা ব্যাংক ড্রাফট আকারে জমা হয়। এই আয়ের কোনো উৎস তিনি জানাতে ব্যর্থ হন।

৭. পাঁচজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিভিন্ন মামলায় অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার জন্য বিচারপতি সিনহা অন্তত ৬০ কোটি টাকা বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রহণ করেন।

৮. বাংলাদেশের ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়ে অবৈধ পন্থায় বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করেছেন। যে ব্যক্তিকে দিয়ে টাকা পাচার করিয়েছেন তিনি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

৯. সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই একজন সাবেক বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা বন্ধ করতে দুদককে চিঠি দিয়েছেন।

১০. সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার এবং অধস্তন আদালতে বিচারক বদলির ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহণ করেছেন।

১১. একজন নারী কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, যার ভিডিও রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া হয়।

প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগের পাঁচটি তদন্তে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক চারটি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দুটির তদন্ত করছে।

গত সপ্তাহে ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ নামে সিনহার লেখা একটি বই প্রকাশ হয়েছে। ওই বইয়ে সিনহা দাবি করেছেন, তাকে সরকার জোর করে নির্বাসনে পাঠিয়েছে।

বিদেশে যাওয়ার এক বছর পর নতুন করে আলোচনায় এলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সুরেন্দ্র কুমার বিদেশে বসে ভুতুড়ে কথা লিখেছে। মূলত গাত্রদাহের কারণে তিনি ওই বইটি লিখেছেন।

বইটি সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে বলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দাবি।

সারাবাংলা/ইএইচটি/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন