বিজ্ঞাপন

‘এত মানুষ মরলো, কেউ একটু খোঁজও নিলো না’

March 9, 2019 | 4:33 pm

।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘বৃহস্পতিবার রাইত থেইক্কা (রাত থেকে) আমরা ইয়ানো (এখানে) বসে আছি (সদরঘাট)। আমগো পরিবারের এত মানুষ মরল। আমাগো অসহায় কইরা গেলো, কিন্তু কেউ একটু দেখতেও আইছিল না (আসেনি)। খাওন দেওয়া তো দূরে থাক, পানি পর্যন্ত এনে দেয়নি কেউ। না খাইয়্যা, না ঘুমাইয়া এহনও বইসা আছি। জীবিত তো আর পামু না অন্তত লাশটা নিয়া যামু এ আশায়’— বলছিলেন সদরঘাটে নৌকাডুবিতে স্বজন হারানো একজন।

বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) রাত নয়টার দিকে শরীয়তপুরের এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নৌকাযোগে কামরাঙ্গীর চর থেকে সদরঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন তারা। নৌকায় ছিল একই পরিবারের দুই ভাই, তাদের স্ত্রী এবং দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ ৭ জন। সদরঘাটে এসে লঞ্চযোগে যাওয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু নৌকা থেকে নামার আগেই সুরভী-৭ লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায় নৌকাটি।

খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সদরঘাটে ছুটে আসেন নিখোঁজদের স্বজনরা। এ ঘটনার দু’দিন পর উদ্ধার হয় ৫ জনের মরদেহ, এখনও নিখোঁজ রয়েছেন একজন।

বিজ্ঞাপন

নিখোঁজদের সন্ধানে আসা প্রায় ১০ জন আত্মীয় ওইদিন রাত থেকে গত দু’দিন সদরঘাটের ১ নম্বর পন্টুনে দিন-রাত অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু তাদের অভিযোগ, গত দু’দিন সেখানে অবস্থান করলেও লঞ্চমালিক কিংবা সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার লোকজন আসেনি তাদের কাছে। স্বজনদের অভিযোগ, এমন একটা বিপদের সময় সাহায্য তো দূরের কথা, খাবার পর্যন্ত পাননি তারা।

সাহেদা আক্তার (৩২) যিনি এখনও নিখোঁজ, তার স্বামী শাহজালাল নৌকা ডুবে যাওয়ার সময় লঞ্চের ইঞ্চিনের পাখায় দুই পা হারিয়ে এখন পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায়। তাদের দুই মেয়ে মীম এবং মাহির মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস।

শাহজালালের ছোট বোন মাইসুরা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাই মইরলে আমগো মরছে, কার কী আসে যায়। সবাই আইসা শুধু ছবি তোলে আর চলে যায়। একবার জিজ্ঞেসও করে না আমরা কী হালতে আছি। সঙ্গে যে টাকা ছিল সেগুলো দিয়ে রুটি-কলা খেয়ে আছি। লঞ্চ মালিক বা সরকারের কোনো লোকের দেখা পর্যন্ত পেলাম না যে, তাদের কাছে আমাদের দুঃখটা বলমু।’

বিজ্ঞাপন

ভাই হারিয়ে বোনের কান্না

অন্য এক স্বজন নার্গিস আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমগো একটা পরিবার পুরা ধ্বংস কইরা দিলো। আমরা এখন কী নিয়া বাঁচমু। আমগো এখন কী হইবো? শুনছি ঘাটের সরকারি কর্তারা আনন্দ করতে মুন্সীগঞ্জে গেছে। আর আমরা দুঃখে মরি। আমগো দুঃখ দেখার কে আছে কন?’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদরঘাটের বিআইডব্লিউটিএর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুন্সীগঞ্জে বনভোজনে গিয়েছেন। জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ এর যুগ্ন-পরিচালক (সদরঘাট) আরিফ উদ্দিন বিষয়টি স্বীকার করে সারাবাংলাকে বলেন, ‘পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আজ আমরা মুন্সীগঞ্জে পিকনিকে আসছি।’

স্বজনদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের অভিযোগ ঠিক নয়। আমাদের আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক তাদের খোঁজ নিচ্ছেন। তারা তো আমাদের বলেনি যে, তাদের খাবার পানি লাগবে। এগুলো তো তারা নিজেরাই ব্যবস্থা করেছে শুনেছি।’

আপনি নিজে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি যাইনি। তবে আমি চেষ্টা করেছি যেন সবাইকে দ্রুত উদ্ধার করা হয়। আমাদের ব্যস্ততা ছিল সেদিকে। তাদের আমরা সান্তনা দিয়েছি, কিন্তু মনোযোগ দিয়েছি উদ্ধার কাজে।’

বিজ্ঞাপন

আহাজারিতে ভারী সদরঘাট

বুড়িগঙ্গা নদীতে সকাল থেকে ভেসে উঠছে একের পর এক মরদেহ। মিলেছে পাঁচ জনের লাশ, এখনও নিখোঁজ একজন। তাকে উদ্ধারে এখনও অভিযান চালাচ্ছে ডুবুরি দল।

ডুবুরি দলের সদস্যরা ভেসে ওঠা লাশ সদরঘাটের পন্টুনে নিয়ে আসার পরই লাশ বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে আশপাশের পরিবেশ।

প্রিয়জন হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া এক স্বজন

শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায় বুড়িগঙ্গার বাবু বাজার ব্রিজ এলাকায় ভেসে ওঠে শিশু মীমের (৮) মরদেহ। দুপুর পৌনে বারোটায় ভেসে ওঠে মীমের ছোট বোন মাহির (৬) মরদেহ। এরপর দুপুর সাড়ে বারোটায় ভেসে ওঠে দেলোয়ার (৩৮) ও এর কিছু সময় পর পৌনে ১টার দিকে পাওয়া যায় দেলোয়ারের শিশু জুনায়েদের (৭) লাশ।

এর আগে, গতকাল দুপুর বারোটার দিকে ভেসে উঠেছিল দেলোয়ারের স্ত্রী জামসেদা। এখনও নিখোঁজ আছেন শাহজালালের স্ত্রী সাহিদা।

সারাবাংলা/এসএইচ/এমও

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন