বিজ্ঞাপন

‘থ্যাংক ইউ, তোমরা অনেক ভালো’

June 2, 2019 | 7:17 pm

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জামিলা খাতুন। বয়স ৭৫ কিংবা ৮০। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এসে কিছুটা থমকে গেলেন তিনি। একে তো বৃদ্ধা সেই সঙ্গে হাঁটু ব্যথা। ঘরমুখো এত মানুষের ভিড় ঢেলে কীভাবে তিনি সামনের পথ পেরিয়ে ট্রেনে উঠবেন? কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না! তবুও ধীর পায়ে তিনি প্ল্যাটফর্মের দিকে এগুতে থাকেন। এরপর থমকে দাঁড়ান।

বিজ্ঞাপন

এ দৃশ্যটাই চোখে পড়ে পাঁচ তরুণ-তরুণীর। পাঁচজনের দলের দুই তরুণী এগিয়ে আসেন জামিলা খাতুনের দিকে। দুই তরুণী সঙ্গে নিয়ে আসেন হুইল চেয়ার। খুব যতনে জামিলা খাতুনকে সেই হুইল চেয়ারে বসিয়ে তারা নিয়ে গেলেন রেল স্টেশনের ৬ নং প্ল্যাটফর্মে। হুইল চেয়ার থেকে ট্রেনে নিয়ে ওই তরুণীরা জামিলা খাতুনকে বসিয়ে দিলেন তার নির্ধারিত আসনে।

আর এই ‘অপ্রত্যাশিত’ সেবা পেয়ে মুগ্ধ জামিলা খাতুন। চোখের কোণায় এরইমধ্যে জমেছে কিছুটা আনন্দ-অশ্রু। তিনি বলেন, ‘থ্যাংক ইউ, তোমরা অনেক ভালো, অনেক ভালো কাজ করছো। আর সবসময় ভালো থেকো এই দোয়া করি।’

বিজ্ঞাপন

নিজেদের স্বেচ্ছাশ্রমের বিনিময়ে উপকারভোগীদের কাছ থেকে এরকম অভিবাদন বাণী পাওয়া যেন পরম মূল্যবান কিছু পাওয়া।

কমলাপুর রেল স্টেশনে স্বেচ্ছাকর্মীদের একজন বৃষ্টি বলেন, ‘আমার কাছে বড় বিষয় যে, একজন বৃদ্ধা নারীকে তার সিটে বসিয়ে দিতে পেরেছি। এরকম স্বেচ্ছাশ্রম করতে পেরে আমরা আনন্দিত।’

অপর স্বেচ্ছাকর্মী বর্ষা বলেন, ‘আমরা চাই, সকলের ঈদযাত্রা সুন্দর হোক, নির্বিঘ্ন হোক। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের স্বেচ্ছাশ্রমে ঘরমুখো মানুষেরা ‍খুশি এর থেকে বড় পাওয়া আমাদের আর নেই।’

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা শেষ করেই অন্য যাত্রীর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন ওই দুই কর্মী।

সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা হারিয়ে কৃত্রিম পা লাগানো মানুষটি যাবেন রাজশাহীতে। উঠবেন বনলতা এক্সপ্রেসে। মূল প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনে উঠতে তার কষ্ট হচ্ছিল, তাই তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ট্রেনের আসনে বসিয়ে দিয়ে আসেন মাহফুজুর রহমান মেহেদী নামে আরেক তরুণ।

অপর যাত্রী কাঁকন। স্টেশনের দিকে আসতে গিয়ে কীভাবে যেন পা কেটে গেল তার! গলগল রক্ত পড়া দেখে মূর্ছা যান তিনি। সেখানেও ছুটে আসে তরুণদের টিম। এরপর কাকনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর কাকনের জ্ঞান ফিরে আসে। এরপর তিনি রওয়ানা হন গন্তব্যে। যাওয়ার সময় স্বেচ্ছাসেবকদের ধন্যবাদ দিতে ভুললেন না কাঁকন।

বিজ্ঞাপন

কমলাপুর রেল স্টেশনের ভেতরে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই চোখে পড়ে সাদা শান্তির পায়রার মতো সাদা পোশাক পরে পাঁচ কর্মী বসে আছেন পাঁচটি চেয়ারে। সামনে রাখা একটি টেবিলে রয়েছে ফাস্ট এইড বক্স, গজ, তুলা, হ্যান্ডরাব ও প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ। টেবিলের একপাশে একটি হুইল চেয়ার আরেক পাশে একটি স্ট্রেচার। পেছনে টানানো রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসা ও যাত্রী সেবা কেন্দ্র, আয়োজনে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।

স্টেশনে আসা যাত্রীরা কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে এলেই তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে। কারও হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন। কাউকে হুইল চেয়ারে করে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে আসছেন। আবার অনেক যাত্রী আছেন যারা ট্রেনের শিডিউল ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না। তাদেরকেও শিডিউল বুঝিয়ে দিয়ে সাহায্য করছেন তারা।

কথা বলে জানা গেল, গত ১ জুন থেকে এখানে কাজ শুরু করেছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবীরা। তাদের স্বেচ্ছাশ্রম চলবে চাঁদরাত পর্যন্ত। প্রতিদিন একটি গ্রুপ কাজ করছেন সকাল সাতটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। আবার একটি গ্রুপ কাজ করছে দুপুর ২টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কাজ করছে মোট ১৫ জন।

রেলওয়ে স্টেশনে কী কাজ করতে হয় জানতে চাইলে তারা জানালেন, প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি স্ট্রেচারে যারা বৃদ্ধ রয়েছেন তাদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসা, হুইল চেয়ারে করে বগিতে তুলে দিয়ে আসছেন। প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১৫ জনের মতো পাচ্ছেন যাদের এ ধরনের সাহায্য দরকার হয়। আবার ট্রেনের শিডিউল বুঝিয়ে দিতে হয় অনেককে।

সাতবছর ধরে রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন আশিকুর রহমান। জানালেন পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় যেদিন আগুন লাগে, সেদিন সারারাত সেখানে ছিলেন। কাজ করেছেন সেখানেও।

কাজ করতে কেমন লাগে জানতে চাইলে আশিকুর বলেন, ‘এই ভালোলাগা ভেতর থেকে না এলে কাজ করা সম্ভব নয়। ভেতর থেকে ভালো লাগা আসে বলেই আমাদের সবাই একযোগে কাজ করছেন।’

আশিকুর যখন কথা বলছেন, তার পাশেই বসেছিলেন সাইফুল হোসেন হৃদয়। ন্যাশনাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনবছর ধরে কাজ করছেন রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে।

সোনিয়া হালদার বৃষ্টি এবার এ লেভেল পড়ছেন। রেড ক্রিসেন্টের হয়ে কাজ করছেন দুই বছর ধরে। কিন্তু এ ধরনের জায়গায় কাজ করছেন এবারই প্রথম। বাবাকে দেখে প্রভাবিত। তার বাবা চাকরি করেছেন রেডক্রসে ইন্টারন্যাশনালে। বাবাকে দেখেই ছোট বেলা থেকে প্রেরণা পেয়েছেন বৃষ্টি।

কাজ করতে অনেক ভালো লাগে, ‘হিউমিনিটি ইজ এভরিথিং, হিউমিনিটি পিস, হিউমিনিটি ধর্ম’ একইসঙ্গে বলে উঠলেন তারা।

কাজ করতে গিয়ে কখনও বিব্রতকর কোনো পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কি না জানতে চাইলে মুখে হাসি ফুটিয়ে বৃষ্টি বলেন, ‘হয়েছে। কিন্তু আমাদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সে সব গায়ে লাগে না। আমরা ওভারকাম করতে পারি। আমাদের সমস্যা হয় না।’

তিনবছর ধরে সানজিদা ইসলাম বর্ষা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন শিক্ষক খায়রুল আলম ‍দুলালের উৎসাহে।

পরিবার থেকে কারও কোনো বাধা আছে কি না জানতে চাইলে সবাই একযোগে বলে ওঠেন, ‘কারও পরিবারই বাধা দেয় না বরং মানুষের সেবা করতে পারবে, মানুষকে সাহায্য করতে পারবে এ জন্য পরিবারের প্রতিটি মানুষ কাজে উৎসাহ দেন।’

পরিবারের বাধার কথা শুনে হাসতে হাসতে আশিকুর রহমান জানালেন, তার পাশে বসে থাকা সাইফুল হোসেন হৃদয় তারই আপন ছোট ভাই। পরিবার থেকে বাধা এলে দুই ভাই একসঙ্গে কাজ করতে পারতেন না। পরিবারের প্রেরণা না থাকলে এই কাজ করা কখনও সম্ভব হতো না।

একই দলের আরেক সদস্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রেজওয়ানুল ইসলাম শোভন বলেন, ‘আমি আগে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না, কোথাও গেলে মিশতে পারতাম না মানুষের সঙ্গে, নার্ভাস লাগতো কিন্তু রেডক্রিসেন্টে কাজ করার সুবাদে আমার অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে, লিডারশিপ স্কিলড তৈরি হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, হিউমিনিটির চেয়ে বড় কিছু নেই জীবনে, হিউমিনিটি ধর্ম।’

এই যে মানুষের উপকারে আসতে পারছি, মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি। এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?

সারাবাংলা/জেএ/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন