বিজ্ঞাপন

ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি থামাতে তৎপর পুলিশ

July 22, 2019 | 8:10 am

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: ছেলেধরা সন্দেহে গুজব রটিয়ে দেশের অনেক জায়গায় গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে নারী ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা এর শিকার হচ্ছে বেশি। গুজব থামাতে পুলিশ এরই মধ্যে নানারকম পদক্ষেপ নিয়েছে। তবুও থামছে না গণপিটুনি।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২১ জুলাই) সকালেও নওগাঁর মান্দায় ছেলেধরা সন্দেহে ছয়জনকে গণপিটুনি দিয়েছে গ্রামবাসী। পুকুরে মাছধরাকে কেন্দ্র করে মালিকের সাথে দ্বন্দ্বের জের ধরে এক পর্যায়ে মারের হাত থেকে বাঁচতে দৌড় দেয় ছয় জেলে। এ সময় এলাকাবাসী ছেলেধরা সন্দেহে তাদের আটক করে গণপিটুনি দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।

এর আগে শনিবার (২০ জুলাই) সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রেনু নামে এক নারী তার মেয়েকে ভর্তির জন্য গেলে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। পরে ওই নারীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। একইদিন নারায়ণগঞ্জে এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী গণপিটুনিতে মারা যায়। এছাড়া ওইদিন বিকেলে সিলেটের বড়লেখায় তিনজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। তারাও এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন।

গত ১৮ জুলাই নেত্রকোনা শহরের নিউ টাউন পদ্মপুকুর পাড় এলাকায় এক যুবকের বস্তা থেকে শিশুর কাটা মাথা উদ্ধার করে স্থানীয়রা। পরে তাকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মূলত ওইদিন থেকেই ছেলেধরা আতঙ্ক সারা দেশে চরম মাত্রা পায়।

বিজ্ঞাপন

পুলিশ সদর দফতর সুত্রে জানা যায়, গুজব রটিয়ে গণপিটুনি বন্ধ করতে এরই মধ্যে প্রত্যেক জেলার পুলিশ সুপারকে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের টহল বাড়াতে বলা হয়েছে। দিনে ও রাতে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসতে বলা হয়েছে। এছাড়া গ্রাম পুলিশ এবং ওয়ার্ড মেম্বারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে বৈঠক করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কোথাও কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে তাকে মারধর না করে পুলিশের হাতে বা সংশ্লিষ্ট মেম্বারের হাতে তুলে দিতে বলা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতর থেকে আরও বলা হয়েছে, অনেক হয়েছে আর নয়। কেউ যেন আইন হাতে তুলে না নেয় সেজন্য পুলিশকে আরও বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। পিটিয়ে মানুষ মারা বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধ। এর জন্য যারা দায়ী তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গুজব বন্ধ ও ছেলেধরা আতঙ্ক যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যেক জেলার জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনায় বলা হয়, একটি মহল সারাদেশে গুজব ছড়িয়েছে যে, পদ্মা সেতুর পিলারে মাথা লাগবে। সেজন্য ছেলেধরা সন্দেহ হলেই তাকে প্রতিহত করতে হবে- এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। পদ্মা সেতুর পিলারে কোনো মাথা লাগবে না। গুজব ছড়িয়ে দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই চক্রান্তকারীদের লক্ষ্য। কেউ যেন ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে পেটাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দেশের বেশকয়েকটি জেলায় এ ধরনের ঘটনা এরই মধ্যে ঘটে গেছে। আর যেন একটি প্রাণও না ঝরে সেজন্য সকলকে সজাগ থাকতে হবে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে ছেলেধরা গুজবে সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক এলাকায় সন্ধ্যার পর কেউ বের হচ্ছেন না। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার অনেক কমে গেছে। অনেকেই রাতে একা বের হতে ভয় পাচ্ছেন। গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে সন্ধ্যার পর তেমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। দোকান পাটও তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (গোপনীয় শাখা) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সারাদেশে এখন যেটি চলছে, সেটি সামাজিক সমস্যা। বাঙালি হুজুগে মাতাল। একজনকে সন্দেহ হলেই পেটাতে হবে- এটা কোন থিউরিতে কাজ করে তা আমার বোধগম্য নয়। এছাড়া এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে, গণপিটুনির শিকার ব্যক্তিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। সন্দেহ হতেই পারে। সেক্ষেত্রে তাকে ধরে পুলিশের হাতে দিলেই হয়। অথবা এলাকার মাতব্বরের কাছে নিয়ে যান, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন। মনে রাখা দরকার, আপনি বা আমিও এর শিকার হতে পারি। এই সমস্যাকে এখন সামাজিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। সকলকে বোঝাতে হবে, আমরা যেটা করছি- সেটা ঠিক নয়। ’

‘ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির মত সামাজিক সমস্যা সমাধানে এই মুহূর্তে কি করা দরকার?’- জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন। একটা পর্যায়ে গিয়ে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু ততদিনে অনেক নিরাপরাধ তাজা প্রাণ ঝরে যাবে। এই সমস্যা সামাজিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এই মুহূর্তে মানুষকে সচেতন করা জরুরি। তারা যেন বিনাকারণে কাউকে না পেটায়।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে মসজিদের ইমামরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। ইমামরা দেশের প্রতিটা মসজিদে খুতবা ও আলোচনায় সকলকে সচেতন করলে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির হার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি তরুণদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তবেই এই সমস্যা থেকে তাড়াতাড়ি উদ্ধার হওয়া সম্ভব।’

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম/টিএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন