বিজ্ঞাপন

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ১ বছর, আসেনি শৃঙ্খলা, কমেনি দুর্ঘটনা

July 29, 2019 | 5:28 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা এলাকায় দুই বাসের রেষারেষিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী। এ ঘটনার সূত্র ধরে দেশব্যাপী শুরু হয় শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। রাজধানীতে টানা ৯ দিন রাজপথে অবস্থান নিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। সড়কে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে কঠোর আইন প্রণয়ন করে তা কার্যকরের দাবি ছিল তাদের। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতেও ছিল বিভিন্ন দাবি।

বিজ্ঞাপন

দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েই শিক্ষার্থীদের রাজপথ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিলে স্কুল-কলেজে। এরপর কেটে গেছে একবছর। কিন্তু সড়ক নিরাপদ করতে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে কতটুকু?

নিরাপদ সড়কের জন্য যে আইন, সে আইন এখনো কার্যকর হয়নি। আন্দোলনের সময় বিশেষজ্ঞরা ঢাকা শহরে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালুর কথা বললেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি সেই উদ্যোগ। এখনো আগের মতোই চুক্তিতে চলছে রাজধানীর পরিবহনগুলো। এখনো বন্ধ হয়নি সড়কে বাসের গতি প্রতিযোগিতা। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করার পুরনো অভ্যাস থেকেও বেরিয়ে আসতে পারেনি বাসগুলো। যে কারণে এখনো থামেনি সড়কে মৃত্যুর মিছিল।

শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনের দুই মাস পর গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বিল’। অবহেলা বা বেপরোয়া মোটরযান চালনার কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে ৫ বছরের করাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয় ওই আইনে। তবে সংসদে আইন পাসের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও তা কার্যকর করতে সরকার গেজেট প্রকাশ না করায় সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। সে নোটিশের জবাব না পেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করলে হাইকোর্ট রুলও জারি করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই আইন কার্যকরের কোনো গেজেট এখনো প্রকাশ করেনি সরকার। অর্থাৎ, আইন পাস হলেও নিরাপদ সড়কের জন্য প্রণয়ন করা সেই আইন কেবল কাগজেই রয়ে গেছে, এর কোনো কার্যকারিতা নেই।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় রাজধানীতে বাস থামানো ও যাত্রী ওঠানামা করার জন্য ১২১টি স্থান নির্ধারণের কাজ শুরু করেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ। বেশ কয়েকটি জায়গায় বাস স্টপেজ তৈরির কাজও শুরু হয় তখন। কিন্তু সে উদ্যোগও বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো নির্দিষ্ট বাস স্টপেজে থামছে না বাস, যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে, নামানো হচ্ছে।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীতে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক বাস চালু নিয়ে বেশ তোড়জোড় শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর। ওই সময়ই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঢাকা শহরে ছয়টি কোম্পানির আওতায় চলবে বাস। এরপরও একাধিকবার রাজধানীর দুই মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা একই কথা বলেছেন। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি বা কোম্পানিভিত্তিক বাস চালুর ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর উদ্যোগই এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। কেবল মুখের কথাতেই আটকে রয়েছে সেই উদ্যোগ।

গত বছরের ১৮ আগস্ট সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা আনতে ১৭টি নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন সংক্রান্ত বৈঠকও হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি টিম ঢাকার বিভিন্ন সড়ক পরিদর্শন করে। পরে ১৭টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেসব নির্দেশনার কোনোটিই বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শেষ পর্যন্ত কোনো প্রভাবই ফেলেনি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যে। এই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গত বছরের ১ জুলাই থেকে এ বছরের ১ জুলাই পর্যন্ত একবছরে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের প্রায় ৩৮ শতাংশই পথচারী।

এদিকে, এ বছরের ১৯ মার্চ সকালে রাজধানীর বসুন্ধরা গেট এলাকায় বেপরোয়া বাসের চাপায় প্রাণ হারান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের রাজধানীর সড়কে নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ সংশ্লিষ্টরা শিক্ষার্থীদের রাজপথ থেকে সরাতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রতিশ্রুতি দিলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফেরেন। এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে অন্যতম ছিল বসুন্ধরা গেট এলাকায় তিন মাসের মধ্যে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ ও সড়কে শৃঙ্খলার উদ্যোগ মনিটরিংয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ে মনিটরিং টিম গঠন। ওই বৈঠকের চার মাস পেরিয়ে গেলেও বসুন্ধরা গেট এলাকায় আবরারের নামে ফুটওভারব্রিজ স্থাপন করতে পারেননি মেয়র আতিকুল। শিক্ষার্থীদের নিয়ে মনিটরিং কমিটিও গঠন করা হয়নি।

শিক্ষার্থীদের গত বছরের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন অবশ্য একটি ক্ষেত্রে সুফল এনেছে। আন্দোলনের সময় থেকেই মোটরসাইকেলের চালকদের হেলমেট পরতে বাধ্য করা হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন আছে। প্রায় শতভাগ মোটরসাইকেলচালক ও আরোহীর মাথাতেই এখন দেখা যায় হেলমেট।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনের পর বিমানবন্দর সড়কে অবশ্য দু’টি নতুন ফুটওভারব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। ফুটওভার ব্রিজের নিচে দেওয়া হয়েছে উঁচু বেড়া। রাস্তায় বাস বে নির্মাণের কাজও চলছে। বিমানবন্দর সড়কে বসছে অত্যাধুনিক যাত্রী ছাউনি। এক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তৎরতা দেখা গেলেও সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কার্যক্রম খুব বেশি এগোয়নি। এক্ষেত্রে পরিবহন মালিকদের মধ্যেও সমন্বয় নেই।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, পুলিশের সঙ্গে মালিক সমিতির একাধিক বৈঠক হয়েছে। তারা ধীরে ধীরে বাস সার্ভিসকে একটি সমন্বিত উদ্যোগের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছেন।

চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধে নিজেরা তৎপর দাবি করে এনায়েত উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, চুক্তিতে বাস চালালে ওই বাসের সমিতির নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়া আরও শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসবে।

রাজধানীতে কোম্পানিভিত্তিক বাস রুট চালুর প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছেন পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরপরই ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস রুট চালুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই তৎপর হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ১০টি বৈঠক হয়েছে।

এসব বৈঠকে আলোচনার অগ্রগতি কতটুকু— জানতে চাইলে ড. সালেহ বলেন, রাজধানীর সম্ভাব্য সব রুট নিয়ে সমীক্ষার কাজ এখনো চলছে। এ বছরের মধ্যেই ঢাকার যেকোনো একটি রুটে কোম্পানিভিত্তিক বাস চলাচল শুরু হবে। এটি কতটুকু কার্যকর হবে, তা বিশ্লেষণ করে ধাপে ধাপে বাকি রুটগুলোতেও ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস চালু করা হবে।

আরও পড়ুন
আইন মেনে নিরাপদ সড়ক গড়ার প্রত্যয়
ছবিতে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
নিরাপদ সড়ক: আইন-সুপারিশ-প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন শূন্য
শাহবাগে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে সংহতি ডাকসু ভিপি নুরের
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শাহবাগে অবরোধ, বিভিন্ন সড়কে শিক্ষার্থীরা
নিরাপদ সড়ক চেয়ে মিছিলের পরদিন ট্রাক্টর চাপায় জীবন গেল শিশুটির
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ১৪ শিক্ষার্থীর জামিননিরাপদ সড়ক আন্দোলন: ৩২ শিক্ষার্থীর জামিন

 

সারাবাংলা/এসএ/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন